ভোরের আবছা আলোয় গাড়ি চালাচ্ছি এক অশরীরীর মতো, প্রতিদিন, সারা সপ্তাহ ধরে এবং নির্জন রাস্তা ধরে কারফিউ-এর সন্ধ্যেয় আবার ঘরে ফিরছি রোজ। প্রতিদিন আমার গাড়ি সময় মেনে শূন্য হাইওয়ে, নিস্তব্ধ মৃতপ্রায় শহরের বুক চিরে ছুটে চলেছে। এমনই এক দিন গাড়ি চালাচ্ছি, বাবা ফোন করে জানতে চায় আমি বাড়ি থেকে কাজ করার সুযোগ পাব কিনা, পেলে কবে থেকে পাব, ইত্যাদি। বাবাকে বোঝাতে বলি – “আমি কী করি তুমি তো জান।” লোকটা তবু অবুঝের মতো বলে চলে আমার সুরক্ষা, নিরাপত্তা এসব কতটা জরুরি। বোঝাতে চায় আমার নিরাপত্তা ওঁদের জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। সেদিন বাবাকে কোনও যুতসই উত্তর দিতে পারিনি।
কারণ আমি ভুলেই গেছি যে জীবন ঝুঁকির, যা থেকে লোকে দূরে সরে যায় আমি সেই জীবন বেছে নিয়েছি স্বেচ্ছায়। এখন শুধু জানি আমাকে এগিয়ে যেতে হবে। কোথাও আগুন লাগলে যেমন ফায়ার মার্শালরা পিছিয়ে যায় না, কোনও অপরাধ ঘটলে যেমন আইনরক্ষকদের যেকোনও পরিস্থিতির জন্য তৈরি থাকতে হয়, তেমনই স্বাস্থ্যকর্মীদেরও সংক্রমণের ভয়ে পিছিয়ে গেলে চলে না। এটাই আমাদের পরীক্ষা।
আমাদের মতো যারা স্বাস্থ্য পরিষেবায় সঙ্গে যুক্ত, তাদের এখন নিজেদের উজাড় করে দেবার সময়। কর্তব্যে অটল থেকে নিজেদের সবটুকু অভিজ্ঞতা, সাহস, সহানুভূতি ঢেলে দিয়ে কাজ করে যাওয়ার সময়। বাবাকে বোঝাতে বলি “আমি জীবনভর তো এটাই করতে চেয়েছি বাবা। এই জন্যই দীর্ঘ আট বছর পড়াশোনা করেছি, ট্রেনিং নিয়েছি, নিজেকে তৈরি করেছি। এখন সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর সময়।”
এই দু মাসে যা অভিজ্ঞতা হয়েছে তাতে আমি হতবাক। আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াই করতে নেমেছি কিন্তু আমাদের না আছে অস্ত্র না আছে রসদ। সঠিক চিকিৎসা রূপায়নের জন্য অনবরত স্বাস্থ্যপরিষেবার সঙ্গীদের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারীতা চলেছে। লড়াকু নার্স, ফার্মাসিস্টরা ব্যস্ত আইসোলেশন বিভাগের প্রস্তুতিতে অথচ তাদের আত্মরক্ষার বর্ম অর্থাৎ পিপিই সুটেরই যথেষ্ট জোগান নেই।
সহৃদয় প্রবীন উচ্চ পদে আসীন মানুষরা হাসপাতালময় তদারকি করে বেড়াচ্ছেন যেন সঠিক বিশ্রাম এবং সময়ে খাবার পায় কর্মীরা। স্বাস্থ্যবিভাগের প্রসাশকরা যেন নতুন করে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন ফ্লোরে ঘুরে ঘুরে, রোগীর পাশে দাঁড়িয়ে। নিজেদের অফিসের সুরক্ষার গন্ডি ছেড়ে বেরিয়ে লাইন অফ ফায়ারে এসে দাঁড়িয়েছেন সহকর্মীদের সাহায্য করতে, তাদের সাহস যোগাতে।

গত দু মাসে, শুধু নিউ জার্সি রাজ্যে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১,৩১,৮৯০-এর কিছু বেশি। মৃত্যু হয়েছে ৮৫৫০-এর বেশি রোগীর। মাত্র কয়েকশো রোগী দিয়ে শুরু করে সংখ্যাটা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে বাড়তে এখন এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি আমরা। এদেশে অর্থনীতির পতনের বিপ্রতীপে এই রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি। হাসপাতালের ভেতরে রোগীর সংখ্যা যত বেড়েছে, বাইরে মানুষের সংখ্যা তত কমেছে। ক্রমশ শুধু জরুরী পরিষেবার কর্মীদের রয়ে গেছে।
স্মৃতির ভেতরে কত কাতর রোগীর মুখ ভেসে ওঠে। কত অসহায় মাকে দেখেছি হাসপাতালের গেটে – সন্তানের জন্য রান্না করা খাবার নিয়ে এসেছেন। মেয়ের হাতে ল্যাপটপ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে – বাবার জন্য; যদি ভিডিও কল করে একবার দেখতে পাওয়া যায়, গলা শোনা যায়। বয়স্ক ক্যানসার রোগী সাটল্ সার্ভিসের জন্য উতলা, কেমো নিয়ে ফিরতে হবে। তাদের জীবনরেখা। বিশেষভাবে সক্ষম শিশু প্রতিবেশীর গাড়িতে করে প্রতিষেধক নিতে এসেছে। পানীয়জল এবং খাদ্যবস্তু সরবরাহের কর্মীরা ক্যাফেতে ব্যস্ত। সামাজিক স্তরে বিচ্ছিন্ন থাকা জরুরী এ অবস্থায়।
কিন্তু বিচ্ছিন্ন বা নিরপেক্ষ থাকলে আমার চলবে না। রোগীর কাছে পরিষেবার পৌঁছে দিতেই হবে। অসহায়ের পাশে দাঁড়াতে হবে। সকলের সঙ্গে হাতে হাত পায়ে পা মিলিয়ে চলতে হবে। অপ্রতুল সুরক্ষার মধ্যেই কাজ চালাতে হবে। দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে এই রোগ। কিন্তু সেইসঙ্গেই বেড়েছে আমাদের ঝুঁকি নেবার সাহস, বেড়েছে নতুন নতুন চাপের মুখে উদ্ভাবনী ক্ষমতা। এখন আমাদের সামনে একটাই লক্ষ্য – সংক্রমণের হার কমানো।
এই ভয়ানক পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়া কোনও স্বাস্থ্যকর্মীরই কাম্য নয়। কিন্তু এই দুঃসময় কেটে গেলে যখন এই দিনগুলোর দিকে আমি ফিরে তাকাব, শুধু এক দল লড়াকু সৈনিকের মুখ মনে পড়বে। যারা সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়ে চলেছে, সময়কে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বলছে – “আমি ভয় করব না ভয় করব না। দুবেলা মরার আগে মরব না, ভাই মরব না।”
পেশাগতভাবে ক্লিনিকাল ফার্মাসিস্ট দেহলী দীর্ঘদিনের প্রবাসী। পড়াশোনা করেছেন কলকাতার প্রেসিডেন্সী কলেজে। পরবর্তীকালে ডক্টরেট অফ ফার্মাসি ডিগ্রী অর্জন করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। বর্তমানে নিউ জার্সির এক টিচিং হসপিটালে কর্মরত এবং ক্লিনিকাল রিসার্চের সঙ্গে যুক্ত।
তোর জন্য আমি আমরা সবাই গর্বিত ❤️❤️ খুব ভালো থাকিস, অভিনন্দন রইল ❤️❤️আগামী দিনের জন্য অনেক শুভেচ্ছা রইল ❤️❤️
Sei deholi….aj kato baro kaj korche…proud of you….anek anek subhechya….