২৫শে বৈশাখের প্রাক্কালে মুম্বই মহানগরীর উত্তাল করোনা পাথারে এমন লেখা যখন লিখতে বসেছি লকডাউনের এই অশেষ ঋতুতে, পাঠকমাত্রেই প্রথমেই ভেবে বসবেন আমি সেই একমেবাদ্বিতীয়ম, আপামর বাঙালির রবীন্দ্রনাথের কথায় গানে গঙ্গাজলে গঙ্গাপূজা করতে বসেছি হয়তো। তবে না, তাঁর কথা মনে রেখে দিয়ে আজ বরং বলি আরেক মনীষার কথা, যাঁর জন্মদিনের দিনটি না মিললেও তারিখটি গুরুদেবের সঙ্গে মিলে যায়। আচার্যগুরু জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ। আজকের সঙ্গীত শিক্ষার্থীরা, যাঁরা কালকে শিল্পী হয়ে উঠতে চান, তাঁদের জন্য এ লেখায় তথ্যের কচকচি রাখব না। তার জন্য অনেক প্রামাণ্য গ্রন্থ আছে। আছে সর্বাগ্রে তাঁর “তহজীব-এ-মৌসিকী” , যাতে একদিকে যেমন রয়েছে তাঁর স্বচক্ষে দেখা উত্তর ভারতীয় মার্গসঙ্গীতের তৎকালীন রূপের বর্ণচ্ছটা, তেমনই রয়েছে সেইসব আসরের, চরিত্রের, যবনিকার পেছনের অদ্ভুত সমস্ত আদানপ্রদানের কথা, যা কখনও খুব সপ্রতিভ আবার কখনও বেসামাল… এই তথাকথিত জীবন নামের বস্তুটির মতোই। আমি সেসবে না গিয়ে বরং সেই জ্ঞানদাদুর কথা কিছুটা লিখব, যাঁকে আমাদের গানের ঘরে বা আসরে বহুবার দেখেছি খুব কাছ থেকে আর গল্পে গল্পে জেনেছি বাবার কাছ থেকে।
আমার চিরকালই মনে হত, গানবাজনার জগৎটা হল একটা অদ্ভুত রূপকথার জগত। যেখানে আসলে সবাই রাজা, কোনও না কোনও সময়ে দাঁড়িয়ে। যেখানে আজ গল্পের রাজা যদি বৈজু বাঁওরা হন, তো কাল তানা ও রিরি অথবা অনতিদূর অতীতের ওঙ্কারনাথ ঠাকুর বা রসুলন বাঈ! সঙ্গীতের ইতিহাসের আদি, মধ্য আর বর্তমান যুগের এইসব গপ্পগাথা শুনতে শুনতে যখন বড় হয়ে উঠছি, তখন তালিমের সঙ্গে সঙ্গে এইসব গল্প আর আসরযাপন থেকে শিখে নিতাম তরবিয়ত আর সহবতের রীতি-রেওয়াজও। অদ্ভুত সুর-তালে বাঁধা থাকত যেন শিল্পীদের ব্যবহার, ভাষা আর আদানপ্রদান। এমনকী শ্রোতারাও ছিলেন একেক আসরের রাজা, যেখানে কখনও কখনও ভেসে উঠত এমন কারও কারও মুখ, যাঁরা কিনা পান্ডিত্যে চুপ করিয়ে দিতে পারতেন প্রথিতযশা শিল্পীদেরও। আর তাঁদের আসনও ছিল তাই অনেক উঁচুতে। এই গৌরচন্দ্রিকাটিকে পাঠক যদি আলাপ ধরে নেন, তবে এখান থেকে বিস্তারের মধ্যে ঢুকে পড়া যাক।
আমি সে সময়ে সম্ভবতঃ প্রাইমারি স্কুলে পড়ি, খুবই ছোট। একদিন বিকেল বিকেল দরজায় কলিং বেল বাজতেই দুদ্দাড় করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গিয়ে নিচের সদর দরজা খুলতেই দেখি ভারী কাচের কালো ফ্রেমের চশমা পরা এমন একজন দাঁড়িয়ে আছেন যাঁকে আমি অজস্র ছবিতে দাদুর আর বাবার সঙ্গে এক আসরে সঙ্গত করতে দেখেছি, গল্পও শুনেছি প্রচুর সেইসব আসরের। ঢিপ করে প্রণাম করলাম পায়ে হাত দিয়ে। “বেঁচে থাকো মা” বলে দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে আমার চিবুকটি ধরে জিজ্ঞাসা করলেন “প্রণাম করলে যে, তুমি জানো আমি কে? আমি যদি খারাপ লোক হই?” আমি মাথা নেড়ে বললাম “না, আমি জানি, আপনি তো জ্ঞানদাদু!” একগাল হেসে বললেন “ঠিক চিনেছ তুমি, মানস আছে নাকি বাড়িতে?” আমি তাতে ঘাড় কাত করে হ্যাঁ বলে তাঁকে হাত ধরে উপরে নিয়ে এসে গানের ঘরে বসাতেই বাবা এসে ঢুকলেন। পারস্পরিক কুশল বিনিময়ের মাঝেই বাবা আমায় জিজ্ঞাসা করলেন “দাদুকে প্রণাম করেছ?” আমি ঘাড় কাত করে হ্যাঁ বলতেই রসিক মানুষটি বলে উঠলেন “ মানস, আমার নাতনিটি অপূর্ব নামখানা দিয়েছে কিন্তু আমায় – জ্ঞানদাদু! গানদাদু হয়েছি বহুবার, এইবারে জ্ঞানদাদুও হয়েছি!” বাবা হেসে উঠে বললেন, “এই নাম তো আপনাকেই মানায়, আপনি তো সর্বময় হয়ে আছেন, শুধু গানের একার তো নন!” দু’জনেই হেসে উঠলেন উচ্চৈঃস্বরে – গমগম করে উঠল হলঘরখানা।
তারপর চা সহযোগে বেশ খানিক্ষণ আলোচনা গানবাজনার বিভিন্ন অলিতে গলিতে ঘুরেছিল দুটি সঙ্গীতময় মনীষা, যেখানে একজন আর একজনের পিতৃতুল্য আর অন্যজন স্নেহধন্য। কিন্তু যখন সঙ্গীতের তত্ত্ব নিয়ে আলোচনায়, তখন সেই ভেদ মিটে যেতে দেখেছি। সেখানে অনেক অনেক উপরে ছিল শিল্পী হিসেবে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা। একজনের মতকে যুক্তিসহ খন্ডন করতে অপরজনের কোথাও বাধা ছিল না। সেই জন্যেই হয়তো বাবার গান শুনে বলেছিলেন “মানস কিছু মনে কোরও না, তোমার বাবার মত শিল্পী ভারতবর্ষে আর জন্মাননি। কিন্তু তোমার বাবার তুলনায় সঙ্গীতের বিষয়ে ভাবনা চিন্তা তুমি অনেক বেশি করেছ।” এই কথা হয়ত একমাত্র আচার্য জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষই বলতে পারতেন।
পরে জেনেছিলাম, সেবার যখন এসেছিলেন, বাবাকে রেডিওতে শিল্পী হিসেবে ফিরে আসবার কথা বলাটাই ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য। তারপরেও এই বিদগ্ধ গুণী মানুষটি আরও অনেকবার এসেছেন ওই গানের ঘরে। বেশি করে মনে আছে তারাপদ মিউজিক কনফারেন্সের সূচনার আগে, আবার পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সঙ্গীত আকাদেমি প্রযোজিত “গান শিখি গান গাই” নামক সঙ্গীতশিক্ষামূলক অডিও ক্যাসেটের রেকর্ডিং চলাকালীন দিনের পর দিন একসঙ্গে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা। সেই সময় দেখেছিলাম কী অগাধ আস্থায় বাবার উপর নির্ভর করেছিলেন পুরো বিষয়টায়। এই সব সময়ে বাবার পাশে পাশে ছায়ার মতো হয়ে থাকতে থাকতে এই গুণী মানুষটির থেকেও যে কতকিছু শেখা হয়ে গেছে, টেরও পাইনি তখন।
এই মানুষটিই আমার কাছে আচার্য জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, আমার সেই জ্ঞানদাদু, যিনি জন্মেছিলেন ৩৮ নং ক্রিক রো-র বাড়িতে, কলকাতায় এই ২৫শে বৈশাখেই। বাঙালি ঐতিহ্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ডোয়ার্কিনের হারমোনিয়াম যাঁর নামে, সেই দ্বারকানাথ ঘোষের পৌত্র এবং বাবা কিরণচন্দ্র ঘোষ, মা নলিনী দেবীর সন্তান তিনি। তৎকালীন ব্রিটিশ কলকাতার সংস্কৃতিবান পরিবারে বেড়ে ওঠা মানুষটা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পালি ভাষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্নাতক ছিলেন। খেলাধূলার সঙ্গে সঙ্গে তবলা, পাখোয়াজ, ঢোল, খোল থেকে হারমোনিয়ম, পিয়ানো, বেহালা, অর্গ্যান, কর্নেট বাজানোয় মশগুল থাকতেন ছোট থেকেই। ফুটবল খেলতে গিয়ে স্নাতকোত্তর পড়াকালীন একটি চোট পেয়ে তাঁর একটা চোখ নষ্ট হয়ে যায়। তারপর থেকে নিজেকে সঙ্গীতের বিভিন্ন ধারার মধ্যে সম্পূর্ণ ডুবিয়ে দেন তিনি। মসীত খাঁয়ের কাছে তাঁর তবলার পাঠ শুরু হয় এবং সেই সময়েই ডোয়ার্কিনের পরবর্তীতে বাবার রেডিওর ব্যবসা শুরু হওয়ার সুবাদে বাড়িতে বিভিন্ন শিল্পীদের আনাগোনা শুরু হয়। যুবক জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের তখন গুরুর অভাব ঘটেনি। একের পর এক শিল্পীদের সঙ্গ করেছেন আর চিনে নিয়েছেন গান-বাজনার অলিগলি। পরে অল ইন্ডিয়া রেডিওর প্রডিউসার হিসেবে কাজ করেছেন বহুদিন।
তারপর সেই ডিক্সন লেনের বাড়ির মধ্যে দিয়ে অনেক সময় বয়ে গেছে। তাবড় তাবড় শিল্পীরা এসে গানবাজনা করেছেন। কিন্তু জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ মনে করতেন অগ্রজ, অনুজ এই সমস্ত শিল্পীদের কাছ থেকে তিনি প্রতিনিয়ত শিখে নিয়েছেন সঙ্গীতের খুঁটিনাটি সম্পদ। ভরে উঠেছে ওঁর ভাঁড়ার। আর তাই তিনি শেষদিন পর্যন্ত শিখিয়ে গিয়েছেন তাঁর পরবর্তী প্রজন্মকে, যাঁদের মধ্যে অনেকেই পরে সঙ্গীতজগতের এক একজন নক্ষত্র হয়ে উঠেছেন। তবু, আজ যখন তাঁর জন্মের শতবর্ষ পার করেও পুরোনো ছবির অ্যালবামে সাদায়-কালোয় দাদুর সঙ্গে, বাবার সঙ্গে এক আসরে সঙ্গত করার ছবিগুলি দেখি, আমি যেন দেখতে পাই তাঁরই কথায় এক বিদগ্ধ চির-শিক্ষার্থীকে যার শেখার আগ্রহ কোনওদিন শেষ হয়নি।
সঙ্গীতজ্ঞ মানস চক্রবর্তীর সুযোগ্যা কন্যা শ্রীদর্শিনী উত্তর ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে তালিম নিয়েছেন এক্কেবারে শিশুবয়স থেকে। সঙ্গীত তাঁর শিরা-ধমনীতে। টাইমস মিউজিক থেকে বেরিয়েছে গানের সিডিও। মুম্বইয়ের ইন্ডিয়ান আইডল অ্যাকাডেমিতে মেন্টরের ভূমিকা পালন করেন শ্রীদর্শিনী। লেখালিখিও তাঁর পছন্দের বিষয়।তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ 'শীতের অব্যর্থ ডুয়ার্স', 'এসো বৃষ্টি এসো নুন', 'রাজা সাজা হল না যাদের' এবং 'জ্বর-জ্বর ইচ্ছেগুলো' পাঠকমহলে সমাদৃত।
‘বয়স্য’ শব্দটির অর্থ বন্ধু বলেই জানতাম। এখানে জ্ঞানবাবুকে প্রথম দর্শনের বিবরণে কি অর্থে ব্যবহার হলো জানতে উৎসুক হয়ে আছি।