সত্যজিৎ রায়। বাঙালির চিরকেলে আইকন। ঘরের লোক। এ বছর তাঁর জন্মশতবর্ষ। শতবর্ষে সত্যজিতের অজস্র মণিমানিক্য থেকে গুটিকয়েক তুলে নিয়ে বাংলালাইভ সাজিয়েছে তাদের শ্রদ্ধার্ঘ্যের ছোট্ট নিবেদন। আজ থেকে এক পক্ষকাল বাংলালাইভে চলবে সত্যজিত উদযাপন। কখনও তাঁর সুরের মায়া, কখনও তাঁর ক্যামেরার আঙ্গিক, কখনও তাঁর তুলিকলমের দুনিয়া – আমরা ধরতে চেয়েছি বিভিন্ন বিশিষ্টজনের লেখায়-ছবিতে-চলচ্ছবিতে-সাক্ষাৎকারে। আজ, তাঁর  সম্পাদনার গল্প নিয়ে লিখছেন বিশিষ্ট সরোদিয়া অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায়।  

আশির দশকের গোড়ার দিকে আমি ‘গ্রন্থালয়’ নামে একটি বাংলা বই প্রকাশনা সংস্থায় চাকরি করতে শুরু করি। ওই দশকের মাঝামাঝি আমাদের সংস্থায় নিজেদের ও বাইরের কাজ করার জন্য ফোটো টাইপ সেটিংয়ের একটা যন্ত্র বসানো হয়। সে সময়ে অফসেট ছাপার জগতে, বিশেষ করে ভারতবর্ষে ওই যন্ত্রটা একেবারে নতুন। কলকাতায় হাতে গোনা কয়েকটা যন্ত্র বসানো হয়েছিল। তার মধ্যে একটা আমাদের সংস্থায়। সে যন্ত্রের বরাতজোরে আমরা নানা রকম কাজ পেতে শুরু করলাম। তার মধ্যে অন্যতম ছিল, বিখ্যাত ছোটদের পত্রিকা ‘সন্দেশ’ ছাপার কাজের বরাত। কারণ সেই সময় সন্দেশ অফসেট ছাপার দিকে এগোচ্ছিল। ফোটো টাইপ সেটিং-এ ফোটো পেপার বা ছবি তোলার কাগজে ডেভলপ করে যে প্রুফ বেরত তাকে বলা হত গ্যালিপ্রুফ। লম্বা স্ক্রলের মতো দেখতে এই গ্যালিপ্রুফ দেখা হত পেনসিল দিয়ে।

সে সময় ‘সন্দেশ’ প্রত্রিকার সম্পাদক ছিলেন সত্যজিৎ রায়। যেহেতু ফোটো টাইপ সেটিং বিভাগের দায়িত্বে  ছিলাম আমি, ওই প্রুফগুলো সত্যজিৎবাবুকে পৌঁছে দেওয়ার কাজটা আমার ওপরেই এসে পড়ল। দায়িত্বটা পাবার পর যেমন খুশি হয়েছিলাম, তেমনই আবার কিছুটা ভয় আর সংকোচও হয়েছিল। আর পাঁচজন বাঙালির মতো আমিও ছিলাম ওঁর গুণগ্রাহী ভক্ত। সেইসঙ্গে সম্ভ্রম এবং সমীহও ছিল। তাই কী ভাবে ওঁর সামনে গিয়ে দাঁড়াব সেটা বেশ ভাবনায় ফেলে দিয়েছিল। যাইহোক, উনি বলে দিয়েছিলেন যে বিকেল চারটে থেকে সাড়ে চারটের মধ্যে যেন ওঁর বাড়ি যাই। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল যে, এর আগে আশির দশকের একদম গোড়ায় আমি একবার ওঁর বাড়ি গিয়েছিলাম আমার গুরুপুত্র আশিস খানের সঙ্গে। তবে সেদিন বি.বি.সি-র বাংলা বিভাগের বেশ কয়েকজনও ওঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। ঘরে আমরা বেশ কয়েকজন ছিলাম। কিন্তু কেন জানি না, সেদিন আমার বিশেষ ভয় বা সংকোচ হয়নি। উনি নিজে দরজা খুলে আমাদের আপ্যায়ন করাতে বেশ আশ্চর্য হয়ে গেছিলাম। যদিও পরে জেনেছি যে কলিং বেল বাজলে বরাবর উনি নিজেই দরজা খুলতেন এবং নিজেই সব ফোন ধরতেন। কাজের সূত্রে ওঁকে যতবার ফোন করতে হত ততবারই ওঁর ওই রাশভারি গলা শুনে বুক ঢিপ ঢিপ করত।

letter from Satyajit Ray
অজয় মুখোপাধ্যায়কে লেখা সত্যজিৎ রায়ের চিঠি। সৌজন্যে অনিন্দ্য বন্দ্যোেপাধ্যায়।

আশিসদা-র সঙ্গে যে দিন গিয়েছিলাম, সেদিন ওঁকে প্রণাম করে চুপচাপ বসে ওঁদের কথাবার্তা শুনছিলাম। একটা টুঁ শব্দ অবধি করিনি। অবশ্য পরবর্তীকালে যখন কাজের ব্যাপারে যেতাম তখনও যতটুকু কথা বলা প্রয়োজন ততটুকুই বলেছি। যদিও মনে ছিল হাজারও প্রশ্ন। ওঁর বিশাল ঘর, ওঁর চেহারা, ব্যক্তিত্ত্ব, গলার আওয়াজ সবকিছু আমায় এমন আচ্ছন্ন করে দিত যে আমি যেন তখন এক সম্মোহিত মানুষ। ফলে কোনওদিন এমনকি সই নেবার আবদারটুকুও করতে পারিনি। বলতে পারিনি, যে আমার এক দাদু অর্থাৎ মায়ের পিসেমশাই ছিলেন ওঁর একাধিক ছবির অভিনেতা প্রসাদ মুখোপাধ্যায়। উনি ঘরের 

letter from Satyajit ray
চিঠির বাকি অংশ। সৌজন্যে অনিন্দ্য বন্দ্যোেপাধ্যায়।

জানালা ঘেঁষে একটা লাল রেক্সিন মোড়া চেয়ারে বসে ডান পা’টা সামনে রাখা একটা ছোট টুলের ওপর তুলে বসে কাজ করতেন। প্রুফও দেখতেন। প্রুফ খুব তাড়াতাড়ি দেখতেন এবং ছাপার কোনও ভুল থাকলে খুব তাড়াতাড়ি ধরে ফেলতেন। কিন্তু ওই গমগমে গলায় উনি যে কোনও বিষয়ে আমাকে যাই বলতেন, আমার কাছে ধমক বলে মনে হত। উনি যতক্ষণ প্রুফ দেখতেন আমি ততক্ষণ অবাক হয়ে ওঁর ঘরটা দেখতাম। চারিদিকে কেবল বই, ম্যগাজিন, খাতায় ভর্তি। যেহেতু বই আমার খুব প্রিয়, এই ঘরটাও আমার দারুণ লাগত। গোড়ার দিকে একদিন উনি আমায় চা খাবার অনুরোধ করেছিলেন। আমি চা খাই না জেনে নিজে ভেতরে গিয়ে জল নিয়ে এসেছিলেন। আমি লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়েছিলাম।

 

পরবর্তী কালে ওঁর সঙ্গে সামনাসামনি হবার সুযোগ হয়েছিল দু’বার। আনন্দশঙ্করের বাড়িতে রবিশঙ্করজির অনুষ্ঠানে আর আমার মায়ের বাল্যবন্ধু সীতামাসির ছোট মেয়ের বিয়েতে। প্রণাম করে শুধু জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেমন আছেন। এইসব ঘটনার বেশ কয়েকবছর বাদে একবার ওঁর কাছে গিয়েছিলাম আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইংরাজির অধ্যাপক অম্লান দাশগুপ্তের সঙ্গে। অম্লানের বাবা অমলেন্দু দাশগুপ্ত ছিলেন সত্যজিৎবাবুর বিশিষ্ট বন্ধু। সেই সুবাদেই যাওয়া। উনি সেই সময়ে অসুস্থ ছিলেন এবং কানে কিছু কম শুনছিলেন। আমরা গিয়েছিলাম আমার গুরু আলি আকবর খাঁ সাহেবের গাওয়া গান এবং অন্নপূর্ণা দেবীর সুব়বাহারের রেকর্ডিং ওঁকে শোনাতে। উনি সেগুলো ওয়াকম্যান-এ কানে হেডফোন দিয়ে শুনে আমাদের ফেরত দিয়েছিলেন। একটু আফশোস করে বলেছিলেন, ‘এঁরা এখনও কত কাজ করে চলেছেন, দেশ-বিদেশ ঘুরছেন, আমি যে আবার কবে ওঁদের মতো কাজ করতে পারব কে জানে।’ কথাটা শুনে সেদিন আমাদের খুব খারাপ লেগেছিল। কষ্ট হয়েছিল।        

এরপর আর দেখা হয়নি। কলকাতার আরও অনেকের সঙ্গে ভিড়ে মিশে গিয়ে দূর থেকে ওঁর শেষযাত্রা দেখেছিলাম। সই নিতে পারিনি সেই সময় ঠিকই, কিন্তু তার প্রায় কুড়ি বছর বাদে অভিনেতা অজয় মুখোপাধ্যায়কে লেখা ‘মানিকদা’ সই করা একটা চিঠি যোগাড় করেছিলাম ওঁর আর এক বন্ধু ও সংগ্রাহক পরিমল রায়ের কাছ থেকে। তাতে আমার আফশোস খানিকটা হলেও কমে গিয়েছিল। 

সরোদবাদক পণ্ডিত অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার তথা ভারতের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জগতে পরিচিত নাম। সঙ্গীতচর্চার পাশাপাশি চলে পড়াশোনা ও লেখালেখি। 'আপনাদের সেবায়', 'প্রসঙ্গ ঠুমরি', 'সুরের গুরু' ওঁর কিছু জনপ্রিয় বই। সরোদচর্চার পাশাপাশি নিয়মিত অভিনয় করেন বাংলা ছবিতে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *