তাঁর ‘অ্যান অ্যাক্টর প্রিপেয়ারস’ বইতে স্তানিস্লাভস্কি লিখেছেন, মানুষটার মধ্যে বিশেষ কিছু একটা থাকা দরকার। তাহলে তার পক্ষে অভিনেতা হয়ে ওঠা সম্ভব। না হলে কিছুতেই নয়। কিন্তু সেই বিশেষ জিনিসটা যে কী, সেটা আর খুলে বলেননি। দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা (এনএসডি)-র বিখ্যাত ছাত্রদের অন্যতম ইরফান খান বলতেন – হ্যাঁ, বলতেন, আর তো বলবেন না – আমার শিক্ষক থেকে শুরু করে বন্ধু, সহকর্মী, বিখ্যাত অভিনেতা-অভিনেত্রী, কত জনকেই না জিজ্ঞেস করেছি, ওই বিশেষ জিনিসটা কী?

ইরফান খানের বৈশিষ্ট্য ছিল, ঠিক এইখানেই থামতেন। উত্তরটা যে পাননি, বা হয়তো অনেক উত্তরই পেয়েছেন, কিন্তু কোনওটাই যে তাঁর মনে ধরেনি, সেটা আর বলতেন না। টিভি সাক্ষাৎকারে দেখছিলাম, কথার শেষে একটা বাঙ্ময় চাহনি, একেবারে নিজস্ব একটা শরীরী ভঙ্গি, তার থেকেই বাকিটা বুঝে নিতে হবে।

Irrfan Khan
এই চোখ দেখেই অভিনেতার জাত চিনেছিলেন শর্মিলা ঠাকুর। ছবি সৌজন্য – latestlY.com

‘নেমসেক’ (২০০৬) যখন রিলিজ করেছিল, শর্মিলা ঠাকুর তখন সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ফিল্ম সার্টিফিকেশন-এর মাথায়। জহুরি শর্মিলা ছবি দেখেই ইরফানকে মেসেজ করেছিলেন, “একটি অসাধারণ প্রতিভার জন্ম দেওয়ার জন্যে তোমার মা-বাবাকে অভিনন্দন।” আজ মৃত্যু সংবাদটা পাওয়ার পর শর্মিলা ঠাকুরকেই জিজ্ঞেস করলাম, ইরফানের মধ্যে কী ছিল সেই বিশেষ জিনিস? স্বতঃস্ফূর্ত উত্তর এল, “কেন? ওর বড় বড় চোখ!” পরের শব্দগুলো ইংরেজিতে… “ম্যাগনিফিসেন্ট, ইম্প্রেসিভ, ব্রাইট। যখন যে চরিত্রে অভিনয় করেছে, সেটাকেই তো সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পেরেছে! আর সেই কাজটা করতে দারুণ ব্যবহার করত ওর অসাধারণ চোখ দুটো।”

ভারতীয় ছবিতে চোখের ব্যবহারের জন্যে অবিস্মরণীয় নায়িকার হয়তো এই কথাটা মনে হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু ইয়ে দিল যে মাঙ্গে মোর! খেয়াল করলাম, একটি সাক্ষাৎকারে ইরফান নিজে বলছেন, “দর্শক আর অভিনেতার মধ্যে ক্ষমতার বিন্যাসে একটা মস্ত তফাৎ থেকে যায়। পর্দায় যাকে দেখছি, তাঁর ক্ষমতা যেন অপিরিসীম। যে কোনও অসম্ভবকে সে সম্ভব করতে পারে। আর আমি, দর্শক? ক্ষমতার বিচারে ওর কাছে আমি তো নিঃস্ব। এই বৈষম্যটা আমার কুৎসিত মনে হয়। অভিনয় করতে গিয়ে আমি কখনই ক্ষমতার এই সমীকরণের ফাঁদে পা দিইনি। আমি যে চরিত্রে অভিনয় করছি, সে ঠিক সেটুকুই করতে পারে, যা একজন সাধারণ দর্শকও পারে। যখন যে চরিত্রে অভিনয় করেছি, এই কথাটাই বলতে চেয়েছি।”

কিন্তু এই দর্শনের নেপথ্যে যে ভাবনা, রাজস্থানের টঙ্ক জেলার অখ্যাত গ্রাম খাজুরিয়ার টায়ার ব্যবসায়ী ইয়াসিন আলি খান আর তাঁর স্ত্রী সয়িদা বেগম খানের তিন সন্তানের জ্যেষ্ঠ ইরফানের (জন্ম ১৯৬৭) মাথায় তা অঙ্কুরিত এবং বিকশিত হল কী করে?

মা নবাব-বংশীয়, তবু জাতীয় অনূর্ধ্ব-২৩ ক্রিকেট প্রতিযোগিতা সিকে নাইডুতে নির্বাচিত হয়েও ইরফানের খেলা হয়নি, টাকার জোগান ছিল না বলে। জয়পুরে এমএ শেষ করেই দিল্লি গেলেন এক চান্সে এনএসডি-র স্কলারশিপ নিয়ে। সহপাঠী সুতপা শিকদারের সঙ্গে সেখানেই পরিচয়, বন্ধুত্ব, প্রেম এবং পরিণয়। অ-বাঙালি স্বামীদের বাংলা শেখানোর যে অনন্য গুণটিতে সিদ্ধহস্ত বেশির ভাগ বঙ্গতনয়া, সুতপার মধ্যেও সেটি হাজির পূর্ণ মাত্রায়। যদিও তিনি কলকাতার বাঙালি নন, অসমের। “গড়গড় করে, প্রায় আমাদের মতো বাংলা বলত ইরফান। আমি তো অবাক!” বলছিলেন শর্মিলা ঠাকুর। আর ইরফান বলেছেন, “ক্লাসে এনএসডি-র অধ্যাপকদের নাম ধরে ডাকত দিল্লির মেয়ে সুতপা! আমি তখন গো-বলয়ের গন্ডগ্রাম থেকে পৌঁছে স্যর ছাড়া কিছু ভাবতেই পারি না।”

পথিক নবকুমার অবশ্য অবিচল নিষ্ঠায় খুঁজে নিয়েছিলেন ঠিক পথ। বছর দুয়েক আগে একটি রিটুইটে ইরফান জানিয়েছিলেন, “God forbid, but if this nation ultimately fails, I believe it will be because opinions, propaganda, and superstitions replaced facts as the basis for our governance.”

এই যে পথ-সন্ধানের সাধনা, তার গোপন রহস্যটা কী? ইরফান বলছেন, “একেবারে ছোটবেলা থেকে যখন যে কাজটাই করেছি, মন-প্রাণ ঢেলে করেছি। সে ঘুড়ি ওড়ানোই হোক, বা ক্রিকেট, বা প্রেম। যা করেছি, নিজেকে তাতে ডুবিয়ে দিয়েছি। জিসকো বোলতে হ্যাঁয় হোঁশ খো দেনা! বাকিটা ভাগ্য, নিয়তি।”

Irrfan Khan Tweet
ইরফান খানের ট্যুইট । ছবি সৌজন্য twitter.com

নব্বই দশকের শুরুতেই চলে এসেছিলেন মুম্বই। টেলিভিশন তখন নতুন দিগন্তের দিকে চলেছে। চুটিয়ে কাজ করে গেছেন দূরদর্শন আর স্টার প্লাসের বহু ছবি এবং ধারাবাহিকে। প্রথমে নায়কের চরিত্রে ভেবেও ‘সালাম বম্বে’-তে (১৯৮৮) মীরা নায়ার শেষ পর্যন্ত দিলেন একটি ছোট চরিত্র। কিন্তু চূড়ান্ত সম্পাদনায় কেটেছেঁটে প্রায় কিছুই রইল না সে চরিত্রের। “মীরা নায়ার কথা দিয়েছিলেন তাঁর পরের কোনও ছবিতে একটি বড় চরিত্রই অপেক্ষা করছে আমার জন্যে, তবু আকুল হয়ে কেঁদেছিলাম সারা রাত।” বলেছেন ইরফান। বাসু চ্যাটার্জি নিলেন ‘কমলা কি মৌত’-এ (১৯৮৯), রূপা গঙ্গোপাধ্যায়, পঙ্কজ কপুরের সঙ্গে। শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যের জাতীয় পুরস্কার পেল ছবিটা, কিন্তু বক্স অফিসে তেমন চলল না। ‘এক ডাক্তার কি মৌত’-এ (১৯৯০) নিলেন তপন সিংহ। সেরা পরিচালকের জাতীয় পুরস্কার পেলেন তিনি সে বছর এবং অনেকেরই নজর কাড়ল অমূল্য চরিত্রটিতে ইরফান খানের অভিনয়। তবু ইন্ডাস্ট্রিতে যে বিশেষ সুবিধে হল, তা নয়। আরও কয়েকটি ছবিতে কাজ করে গেলেন বেশ কয়েক বছর ধরে। বলার মতো তেমন কিছুই ঘটল না।

ইতিমধ্যে সুতপা শিকদারকে বিয়ে করেছেন ১৯৯৫ সালে। বড় ব্রেকটা এল আরও কয়েক বছর পর, লন্ডনবাসী পরিচালক আসিফ কাপাডিয়ার ঐতিহাসিক ছবি ‘দ্য ওয়ারিয়র’ (২০০১)-এর নায়কের চরিত্রে অভিনয় করে। লন্ডনের ইন্টারন্যশনাল ফিল্ম ফেস্টিভালে সে বার দেখানো হয়েছিল ‘দ্য ওয়ারিয়র’। ওই ছবিতেই দেশে-বিদেশে একটা পরিচয় পেলেন ইরফান। শর্মিলা ঠাকুর ফোনে বলছিলেন, “গিরীশ কারনাড তখন নেহরু সেন্টারের ডিরেক্টর। ব্রিটিশ ফিল্ম ফেস্টিভালের উদ্বোধন হবে। গিরিশ ডেকে নিয়ে গেলেন একটি অসাধারণ ছবি দেখাতে। সেই প্রথম দেখলাম ইরফানের কাজ। আর প্রথম দেখাতেই বুঝলাম ও কোন দরের, কোন জাতের অভিনেতা।”

তারপর এল শেক্সপিয়রের ম্যাকবেথ অবলম্বনে বিশাল ভরদ্বাজের ‘মকবুল’ (২০০৩), যেখানে ইরফান খান স্বয়ং ম্যাকবেথ, অর্থাৎ মিয়াঁ মকবুল। না, তারপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি ইরফান খানকে। ঝুম্পা লাহিড়ির উপন্যাস অবলম্বনে ইংরেজি ছবি ‘নেমসেক’ (২০০৬) করলেন মীরা নায়ার। কথা রাখলেন তিনি। অশোক গঙ্গোপাধ্যায়ের ভূমিকায় অভিনয় করলেন ইরফান। আবার জয়জয়কার। তারপর ২০০৭ সালে অনুরাগ বসুর ‘লাইফ ইন আ মেট্রো’, ২০০৮ সালে আটটা অস্কার পাওয়া ‘স্লামডগ মিলিওনেয়ার’। ২০১২ সালে ‘পান সিং তোমর’-এর নাম ভুমিকায় অভিনয় করে পেলেন শ্রেষ্ঠ অভিনেতার জাতীয় পুরস্কার। সে বছরেই আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের দুনিয়া তোলপাড় করল ইরফানের ‘লাইফ অফ পাই’। তবে তাকেও ম্লান করে দিয়েছিল ‘লাঞ্চ বক্স’ (২০১৩)। কান ফিল্ম ফেস্টিভালে পুরস্কার পাওয়া এই ছবিটিকে ভারত থেকে অস্কারের জন্যে মনোনীত করে যে কেন পাঠানো হয়নি, সে ক্ষোভ আজও কাটেনি সে বছরের প্রধান নির্বাচক গৌতম ঘোষের। এরপর শেক্সপিয়রের হ্যামলেট অবলম্বনে ‘হায়দার’ করলেন বিশাল ভরদ্বাজ। ‘নেমসেক’, ‘মকবুল’-এর মতো এই ছবিতেও ইরফান ফাটিয়ে দিলেন টাবুর সঙ্গে জুটি বেঁধে। কাজ করেছেন আরও অনেক। কোলোনের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার আগে এবং পরেও।

Irrfan Khan
পিকু ছবিতে দীপিকা পাডুকোনের সঙ্গে। ছবি সৌজন্য – indiatoday.in

কিন্তু যদি একটাই ছবি বেছে নিতে হয় ইরফান খানের? সুজিত সরকারের ছবি ‘পিকু’-র (২০১৫) মনোনয়ন সম্ভবত প্রশ্নহীন এবং তর্কাতীত। চূড়ান্ত খিটখিটে বাবা অমিতাভ বচ্চন আর জীবিকায় সফল কিন্তু সমস্যা-পীড়িত নাক-উঁচু মেয়ে দীপিকা পাড়ুকোনের সঙ্গে ছাতে কমোড-আঁটা গাড়ির চালকের চরিত্রে একটা অবিশ্বাস্য উচ্চতায় অভিনয় করে গেলেন ইরফান খান।

তাহলে স্বাভাবিক, বাস্তবানুগ অভিনয়ই কি তাঁর সাফল্যের চাবি? জিজ্ঞেস করায় এক সাক্ষাৎকারে ইরফান উত্তর দিয়েছিলেন, “আগে তা-ই মনে হত। কিন্তু যাঁদের স্বাভাবিক, বাস্তবানুগ অভিনয় দেখে চিরকাল তারিফ করে এসেছি, তাঁরা ওই স্টাইলেই এমন একঘেয়ে সব কাজ করেছেন! বুঝলাম, ওটা দরকারি। কিন্তু অভিনয়ের শেষ কথা নয়। আমি যখন কাজ করি, তখন একটা নিরন্তর সন্ধান চালাই – এই চরিত্রের বৈশিষ্ট্যটা কী? ঠিক কোন জিনিসটা আমাকে সবচেয়ে টানছে? এই সন্ধানই থাকে আমার সব কাজের কেন্দ্রে।”

ভালো কাজের জন্যে প্রশংসা তো অনেক পেয়েছেন। কার প্রশংসা মনে রেখে দিয়েছেন? অনেক সাধ্যসাধনার পর এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গিয়েছিল ইরফান খানের কাছ থেকে। “যিনি বলেছিলেন, তিনি নিজেই আমার অন্যতম অনুপ্রেরণা। বলেছিলেন, আমি বড় হয়ে ইরফান খান হতে চাই।”

আদতে ছিলেন সাংবাদিক, তারপর কর্পোরেট কর্তা। অবসরের পর শান্তিনিকেতনে বসে লেখাজোকায় মন দিয়েছেন। বেশ কিছু প্রবন্ধ আর গল্প লিখেছেন আজকাল, অনুষ্টুপ আর হরপ্পা-য়। প্রথম উপন্যাস 'গোলকিপার' প্রকাশিত হয়েছে বাংলালাইভে। আপাতত ডুবে রয়েছেন ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে। আজকালের রবিবাসর ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর ধারাবাহিক রচনা - সিনেমাতলার বাঙালি।

3 Responses

  1. ধ্রুবদা,
    ইরফান নিজেকে যে উচ্চতায় নিয়ে যেতে পেরেছেন তার প্রমাণ তার চলে যাবার পর এই আকুলতা।
    আমি যে কতবার পিকু দেখেছি, আজও দেখলাম।
    এই বিষণ্ণতা কাটিয়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখছিনা।
    তোমার লেখাটা খুব ভালো লেগেছে।

    কৌশিক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *