বাতাসে ভাসে বারুদের বাস। আয়ূধের আবহে মানুষের বসবাস। শীতকালে আকাশ থেকে ঝরে বরফের কুচি। বছরের বাকি সময় ধুলো ওড়ে। সারাদিন সারারাত উর্দি পরা ফৌজি ঘোরে। কেউ দেশি আবার কেউ বা বিদেশি। প্রত্যেকেই সশস্ত্র। গিরি-কন্দরে বা জনবসতির অভ্যন্তরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সন্ত্রাসবাদীদের হাতেও অস্ত্রের অভাব নেই। সবমিলিয়ে আধুনিকতম আগ্নেয়াস্ত্রের এক দুর্লভ সমাহার।

সান্ধ্য আইন বা কারফিউ প্রতিরাতে সাত ঘণ্টার জন্য জড়িয়ে রাখে এখানকার জনজীবন। বর্ম আচ্ছাদিত দ্রুতগামী ফৌজি গাড়ির তখন অবাধ বিচরণ। প্রয়োজনে সাঁজোয়া গাড়িও পথে নামে। রাত এগারোটার পর অথবা ভোর ছ’টার আগে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে কিছু করার নেই। রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। ভোরের আলো ফোটার লগ্নে শুরু হয় ফৌজি হেলিকপ্টারের গগন বিহার। অথবা প্রায় মাটি ছুঁয়ে নগর পরিক্রমা। আকাশ থেকে ভূ-পর্যবেক্ষণ সন্তোষজনক ভাবে সম্পন্ন হলে প্রত্যাহৃত হয় আগের সান্ধ্য আইন। প্রতি মুহূর্তে যেখানে প্রাণ সংশয়ের আশঙ্কা, মন যেখানে সবসময়ই আতঙ্কিত, সেই শহরের নাম কাবুল।

 

।।দুই।।।

জুন মাসের প্রথম দিনের প্রভাতে পাহাড় ঘেরা ছোট্ট বিমানবন্দরে সামান্য কয়েকজন সহযাত্রীর সঙ্গে গুটিগুটি অবতরণের পর বোঝাই যায়নি শুরু হতে চলেছে নির্বাসিতের জীবন। রোদ ঝলমলে আকাশের নিচে চারদিকে ছড়িয়ে থাকা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত শহরটিকে মন্দ লাগেনি। রাষ্ট্রপুঞ্জের গাড়িতে ঝড়ের গতিতে ব্যাগ-বাক্স সমেত আরোহীকে তুলে নিয়ে যাত্রা হল শুরু। চালক পাথরের মতো মুখ করে গাড়ি চালাচ্ছেন। এখনও পর্যন্ত কোনও শব্দ উচ্চারণ করেননি। আরোহীর পরিচয়ও জানতে চাননি। মিনিট পনেরোর মধ্যেই কড়া নিরাপত্তার ঘেরাটোপে আঁটা এক বিশাল প্রাঙ্গণে পৌঁছনোর পর বোঝা গেল, সঠিক জায়গায় হাজির হওয়া গেছে। এতক্ষণ তো মনের মধ্যে তোলপাড় চলছিল, না জানি কোন অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে গাড়ি গড়িয়ে চলেছে। সেই মানসিক আলোড়ন কী মৃত্যুভয়! হবেও বা।

সাজানো গোছানো দপ্তরের দরজায় অপেক্ষারত জনৈক কর্মী এগিয়ে এসে সদ্য আগত বিদেশি বিশারদকে সাদর সম্ভাষণ জানালেন। ভাঙা ভাঙা ইংরেজি। মুখে নির্ভেজাল হাসি ছড়িয়ে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে রাষ্ট্রপুঞ্জের আমন্ত্রণপত্রটি চেয়ে নিলেন। ইশারায় তাঁকে অনুসরণ করতে অনুরোধ জানিয়ে এগিয়ে চললেন। বাধ্য হয়েই তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করতে হল।

 

।।তিন।।

আফগানিস্তানে অবস্থিত রাষ্ট্রপুঞ্জের দপ্তরের প্রধান বা কান্ট্রি-হেড হাসিখুশি সদালাপী মানুষ। ফরাসি নাগরিক। স্বাগতম জানানোর জন্য এত জোরে হাত ঝাঁকালেন, ভয় হচ্ছিল হাতটা খসে না পড়ে। এক কাপ কফি খাওয়া শেষ হলে নিজের সহকারিকে কিছু একটা নির্দেশ দিলেন। ইংরেজি বা হিন্দি নয়। বাংলা তো নয়ই। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বিদায় জানাতে গিয়ে বলে দিলেন যে কান্ট্রি ম্যানেজারের দপ্তরে গিয়ে কাগজপত্রের কাজ মিটিয়ে কন্ট্রোল রুমে যেতে হবে।

কান্ট্রি ম্যানেজার স্থানীয় মানুষ। বেশি সময় নিলেন না। বেশ কিছু সইসাবুদ করিয়ে কয়েক দফা ফোটো তুলে সহকারির সঙ্গে কন্ট্রোল রুমে পাঠিয়ে দিলেন। কন্ট্রোল রুম সামলাচ্ছেন এক জাঁদরেল চেহারার ভদ্রলোক। গমগমে গলায় বসতে অনুরোধ করেই হাতে তুলে দিলেন এক রেশমি ফিতের মালা। তাতে লকেটের মতো ঝুলছে পরিচয়পত্র বা আইডি কার্ড। বললেন- ‘এখন থেকে আই কার্ড সবসময় গলায় ঝুলিয়ে রাখতে হবে।’ অর্থাৎ জীবনটা শেকলে বাঁধা হয়ে গেল। আর নাম নয়, আই কার্ডের নম্বরই হয়ে গেল আমার পরিচয়।

প্রায় একই সঙ্গে হাতে তুলে দেওয়া হল একটি মোবাইল ফোন এবং ভিএইচএফ (ভেরি হাই ফ্রিকোয়েন্সি) রেডিও। মোবাইল ফোনেরই ব্যবহার জানা নেই, তার সঙ্গে যুতে দেওয়া হচ্ছে বেশ ভারি এক যন্ত্র। গ্রাহকের অস্বস্তি বুঝতে পেরে ভদ্রলোক রীতিমতো হাতে ধরে শিখিয়ে দিলেন যন্ত্র দু’টি কী করে ব্যবহার করতে হয়। এবং বারেবারেই বলে গেলেন যে যন্ত্র দুটি চব্বিশ ঘন্টা চালু রাখতে হবে। কোনওমতেই যেন ব্যাটারির চার্জ ফুরিয়ে না যায়। এও বলতে ভুললেন না,- ‘জ্যামার চালু থাকলে মোবাইল ফোন নিষ্ক্রিয় হলেও ভিএইচএফ হবে না। রেডিওটা চালিয়ে কিলো ডেল্টা বলে নিজের গোপন কোড নম্বর বললেই কন্ট্রোল রুম জেনে যাবে কাবুলের কোন জায়গা থেকে আপনি কথা বলছেন।’

এরপর শুরু হল সুদীর্ঘ ভাষণ। জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বরে উচ্চারিত শব্দগুলি শুনতে মন্দ নয়। এক রকম ঘোরের মধ্যে থেকে সবটুকু শোনার পর মনে হল কাবুলে থাকাকালীন কী কী করা যাবে না, তা বিস্তারিত ভাবে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য এত কথার অবতারণা। তবে অবশ্য করণীয় কয়েকটি কাজের কথাও বলা হয়েছিল। আর সবার আগে দৃঢ় ভঙ্গিতে তিনি বলেছিলেন- ‘সব সময় খেয়াল রাখবেন, আফগানিস্তান যুদ্ধ-নিপীড়িত দারিদ্র-জর্জরিত অর্থশূন্য দেশ হতে পারে, তবে আফগান কিন্তু অস্ত্রহীন হতে রাজি নয়।’

এবার একে একে জানানো হল নির্বাসন অথবা নিভৃতবাসের জীবনে কী কী করতে হবে।

 

।।চার।।

নির্বাসন বা নিভৃতবাস কিংবা কোয়ারেন্টাইন জীবনের সূচনালগ্নে এত নিষেধাজ্ঞা শোনার পর মাথা যখন প্রায় ঝিমঝিম করছে তখন মিনমিন স্বরে প্রশ্ন করি, ‘সবই তো বুঝলাম। সাধ্যমতো সবই মেনে চলতে হবে। কিন্তু আমায় কোথায় বসে কী কাজ করতে হবে?’ আফগানিস্তানে রাষ্ট্রপুঞ্জের চিফ সিকিউরিটি অফিসার অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে বললেন, ‘ও বিষয়ে আমি কিছু জানি না। আমার কাজ বিদেশি বিশারদদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আফগানিস্তান সরকারের যে মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্ব নিয়ে আপনি এসেছেন, তারাই এই ব্যাপারে যা বলার বলবে। কাল সকালে সেখানে হাজির হলেই সব বুঝতে পারবেন।’ ভদ্রলোক এরপর ‘গুড লাক’ বলে হাত বাড়িয়ে দিয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। কন্ট্রোল রুমের বাইরে বেরোতেই দেখা দিলেন এক অন্য ড্রাইভার। মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে দিয়ে সাদর সম্ভাষণ করে জানালেন যে এখন থেকে তিনিই আমার নিত্যসঙ্গী। আরও জানালেন কোন আস্তানায় আমার নিভৃতবাস নির্ধারিত হয়েছে সে বিষয়ে তিনি অবগত।

গাড়ি চলতে শুরু করেছে। ততক্ষণে নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেশ আত্মস্থ হয়ে গেছে। আগামীকাল থেকে কী কাজে নিজেকে যুতে দিতে হবে তা নিয়ে মাথায় কতকিছুই যে খেলে যাচ্ছে তা বলার নয়। ঠিক সেই মুহূর্তে মনে পড়ে গেল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই দুই পংক্তি। “তাই তো নিয়েছি কাজ উপদেষ্টার, এ কাজটা সবচেয়ে কম চেষ্টার।”

Amitabha Ray Author

প্রশিক্ষিত প্রযুক্তিবিদ ও পরিচিত পরিকল্পনাবিশারদ। পড়াশোনা ও পেশাগত কারণে দেশে-বিদেশে বিস্তর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। তার ফসল বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় বই। জোয়াই, আহোম রাজের খোঁজে, প্রতিবেশীর প্রাঙ্গণে, কাবুলনামা, বিলিতি বৃত্তান্ত ইত্যাদি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *