গন্ডারদের নিরালায় থাকার জো নেই। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মাহুতরা গন্ডারের ডেরা খুঁজে বের করবেনই। গন্ডার না দেখাতে পারলে পর্যটকের জলদাপাড়া ভ্রমণটাই যে বৃথা! 

জলদাপাড়ায় পর্যটকের মূল আকর্ষণ তো গন্ডার! একশৃঙ্গ প্রাণিটাকে না দেখাতে পারলে পর্যটন আকর্ষণ হারাবে এই বনাঞ্চল। পর্যটক না এলে রাজস্ব কমবে। গন্ডার দেখাতেই তো হাতি সাফারি, জিপ সাফারি। গাড়িতে অনিশ্চয়তা থাকে। রাস্তার ওপর দর্শন দেওয়ার জন্য গন্ডার পোজ দিয়ে তো আর দাঁড়িয়ে থাকে না! ওদের খুঁজেপেতে বের করতে হয়। গাড়িতে সেই কাজটা প্রায় অসম্ভব। জলদাপাড়ায় তাই হাতি সাফারির এত চাহিদা। আসন পাওয়ার জন্য প্রায় হাতাহাতি লেগে যায় আর কী! পর্যটকদের তাড়নাতেই আরও মাহুতরা গন্ডার খুঁজতে ব্যস্ত হন। তাঁদের অভিজ্ঞ চোখ ঠিক বুঝে নেয়, কোন ঢাড্ডি বা পুরুন্ডি ঘাসের ঝোপে দাঁড়িয়ে আছে জলদাপাড়ার সাত রাজার ধন এক গন্ডার! তাছাড়া কুনকিরাও (পোষা হাতি) জানে, তাদের পিঠে যাঁরা বসে আছেন, তাঁরা গন্ডার দর্শনেই এসেছেন। দেখা না হলে তাঁদের মেজাজ খারাপ হবে। মনে হবে, অযথা পয়সা ধ্বংস হল। আক্ষেপে জঙ্গলের নিস্তব্ধতা ভেঙে চিৎকার করবেন।

মাহুতের কাছে সহবতও শেখে এই কুনকিরা। সেই সহবতের অন্যতম হল, সহনশীলতা। এমনকি, জীবন সংশয় হলেও মাথা ঠান্ডা রেখে নিজেকে, মাহুতকে এবং পিঠে অন্য কেউ বসে থাকলে, তাঁকেও রক্ষা করার শিক্ষা পায় কুনকিরা। পিঠে বসে পর্যটকরা হল্লাচিল্লা করলে কুনকিও বিরক্ত হয় বটে। কিন্তু সহবতের শিক্ষায় ওরা বেয়াড়া হতে পারে না। বরং কুনকিরাও চেষ্টা করে যাতে পর্যটকের গন্ডার দর্শন হয়। এই যে আমাদের মতো শহুরে নাগরিকের এত গন্ডার প্রেম, কিন্তু ওদের রোজনামচার খবর কি আমরা রাখি? কত প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে লড়াই করে বাঁচতে হয় ওদের। তার ওপর আছে চোরাশিকারিদের লোলুপ দৃষ্টি। নাকের ওপর যে খড়্গটি ওদের বৈশিষ্ট্য, সেটা একবার ঘ্যাচাং করে কেটে নিতে পারলেই তো লক্ষ লক্ষ টাকা কামাই। তাই কখনও গন্ডারকে গুলি খেয়ে মরতে হয়, আবার কখনও লাশ হয়ে পড়ে থাকতে হয় বিষাক্ত তিরের আঘাতে। সেসবে অবশ্য আমাদের তেমন চিত্তচাঞ্চল্য হয় না। কষ্টবোধ তো পরের কথা। এই যে এখন দেশে-বিদেশে করোনা ভাইরাসে মানুষ টপাটপ মরে যাচ্ছে, আমরা কি খবর রাখি জানুয়ারির শেষ থেকে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে জলদাপাড়ায় পাঁচ-পাঁচটি গন্ডারের ইন্তেকাল হয়েছিল?

জানলেও কখনও কি বোঝার চেষ্টা করেছি, কেন এমন ভাবে বেমক্কা মরে গেল প্রাণিগুলো? পাঁচটার ওপর দিয়ে গিয়েছে রক্ষা। কিন্তু মড়ক লেগে যাওয়ার আশঙ্কাও তখন করা হচ্ছিল। বন দপ্তর খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল। গন্ডারের মড়ক লাগলে জলদাপাড়ার আর কী গুরুত্ব থাকবে! রাইনো এক্সপার্টদের ঘুম ছুটে গিয়েছিল। সাফারি বন্ধ রেখে জলদাপাড়ার পূর্বাঞ্চল কার্যত সিল করে দেওয়া হয়েছিল। করোনা ভাইরাসের তাণ্ডবের দৌলতে আমরা এখন সিল করার কথা খুব জানি। এরিয়া কর্ডন করা হয়। জানি ব্যাপক হারে পরীক্ষা করে বুঝতে হয় ভাইরাসের দৌরাত্ম্য কত গভীর হয়েছে। আর নতুন শিখেছি, এলাকা স্যানিটাইজ করতে হয়। স্যানিটাইজ মানে জীবাণুনাশক তরল দিয়ে এলাকাটা স্নান করাতে হয়। জানেন কি গন্ডারের মড়ক ঠেকাতে বনাঞ্চল কর্ডন করে জলদাপাড়াকে স্যানিটাইজ করা হয়েছিল? মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত না হয়েও ব্যাপক হারে জলদাপাড়ার আবাসিক গন্ডারদের প্রতিষেধক দেওয়া হয়েছিল। কাজটা বলা যত সোজা, বাস্তবে ততটাই কঠিন।

গন্ডার তো আর ভ্যাকসিন নেওয়ার জন্য লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে না! বা কাছে গেলেই বাধ্য ছেলের মতো ভ্যাকসিন নেওয়ার বান্দা গন্ডার কেন, কোনও বন্যপ্রাণিই নয়। অতএব জঙ্গল ঢু্ঁড়ে খুঁজে বের করতে হয় ওদের। হয়তো কোথাও ঘাসের আড়ালে লুকিয়ে আছে কিংবা কাদাজলে শরীর ডুবিয়ে বসে আছে। সেখানে ভ্যাকসিন দিতে গেলে ওদের বিরক্তি তো হবেই। সেজন্য কুনকির পাল, একদল বনকর্মী, ঘুমপাড়ানি গুলি, বন্দুক ইত্যাদি নিয়ে বিশাল আয়োজন। এ দিকে আবার, অচেতন করে ভ্যাকসিন দেওয়ার পরেই সরে যাওয়া যায় না। গন্ডারটার চেতনা ফিরল কিনা, স্বাভাবিক ছন্দে আবার বুনো জীবনে বিচরণ দেখা গেল কিনা, ইত্যাদি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে তবেই সরতে পারেন বনকর্মীরা। ফলে একটি গন্ডারকে ভ্যাকসিন দিতে কত সময় লাগতে পারে, সহজেই অনুমেয়। আর জঙ্গল স্যানিটাইজ তো আর নবান্ন স্যানিটাইজ করার মতো নয় যে চারদিক থেকে জীবাণুনাশক তরল স্প্রে করে দিলেই হল বা করিডর ও দপ্তরগুলি “ইন্টিগ্রেটেড ডিসইনফেক্টেড” করলেই কাজ শেষ। এহেন জলদাপাড়ায় জঙ্গল স্যানিটাইজ করেছেন বনকর্মীরা।

ওঁরা নিঃশব্দেই কাজ করেন। সবসময় ওঁদের? ছবি প্রকাশ পায় না সংবাদমাধ্যমে। যে দক্ষতায় ওঁরা জলদাপাড়ায় দাবানল নিভিয়েছিলেন, সেই একই পারদর্শিতায় বনকর্মীরা গন্ডারের মড়ক রুখে দিয়েছিলেন। ওই পাঁচটির পর আর কোনও একশৃঙ্গির অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। আমরা যারা গন্ডার দেখতে জলদাপাড়া যাই, তারা ক’জন জানি এই নেপথ্য কাহিনি? কিংবা জানলেও কখনও বোঝার আগ্রহ দেখাই কি যে, পাঁচটি গন্ডারের মৃত্যুর কারণ কী ছিল নিউ ইয়র্কের চিড়িয়াখানায় বাঘেরা করোনা আক্রান্ত হচ্ছে বলে আমাদের আগ্রহের শেষ ছিল না। ওই ঘটনার পর আলিপুর চিড়িয়াখানা খাঁচায় খাঁচায় কীভাবে ডিসইনফেকশন করা হয়েছে, টিভিতে তার ছবি দেখেছি, খবরের কাগজে পড়েছি। কী ভাবে চিড়িয়াখানার কর্মীরা মহাকাশচারীর মতো পিপিই মার্কা পোশাক পরে প্রাণিদের পরিচর্যা করেছেন, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ আমরা জানি। কিন্তু আমরা গন্ডারের মড়ক নিয়ে মাথা ঘামাইনি। গন্ডারগুলোর দেহাংশের ফরেনসিক পরীক্ষা এখনও হয়নি। মৃত্যুর সঠিক কারণ তাই বন দপ্তরেরও অজানা।

নিউ ইয়র্কের চিড়িয়াখানার বাঘ যদি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে, তখন ডুয়ার্সের জলদাপাড়ায় গন্ডারদের ক্ষেত্রে তেমন কিছু হয়নি, তা কি আমরা হলফ করে বলতে পারি? সময়টাও কিন্তু উল্লেখ করার মতো। চিনের উহান তখন উজাড় হয়ে যাচ্ছে করোনার দাপটে। জানুয়ারির সেই শেষের দিকে কোন ভাইরাস গন্ডারগুলোর প্রাণ নিল, তা কিন্তু রহস্যই রয়ে গেল। বনকর্মীদের আন্তরিক চেষ্টায় মড়ক ঠেকানো গেল বলে বোধহয় কারণটা ধামাচাপা পড়ে গেল। আর কেউ এটা নিয়ে কেউ উচ্চবাচ্যই করলেন না। সরকার আবার কী ভাববে, এই চিন্তায় বনকর্তারা নীরব রইলেন। সরকারের রোষে পড়ার চেয়ে বন্যপ্রাণ প্রেম ত্যাগ করা অনেক ভালো। গন্ডারের মৃতদেহের নমুনা ফরেনসিক পরীক্ষায় পাঠানো হয়েছিল বটে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। তার গতি কী হল, তা নিয়ে চিন্তা বাড়াবে কে? বনকর্তা, বনকর্মীদের অধিকাংশের আন্তরিকতা নিয়ে আমার অন্তত সন্দেহ নেই। ছোটবেলা থেকে তো বটেই, পেশাগত জীবনের একটা দীর্ঘসময় ওঁদের কাছ থেকে দেখেছি।

ওঁদের ফিল্ড স্টাফরা যে ভাবে জঙ্গলের গভীরে মনুষ্য বিবর্জিত এলাকায় দিনের পর দিন পড়ে থাকেন, তা দেখলে লকডাউনে আমাদের মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তকুল লজ্জাই পাবে। ওঁদের জীবনে লকডাউন ১২ মাস, ৩৬৫ দিন। সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং হোক আর ফিজিক্যাল ডিসট্যান্সিং, এই বনকর্মীরা আমাদের রোল মডেল হতে পারেন। এই ফিল্ড স্টাফদের উইকএন্ড বলেও কিছু নেই। কেউ কেউ সপরিবার জঙ্গলে রেঞ্জ বা বিট অফিস-লাগোয়া কোয়ার্টারে থাকেন বটে। কিন্তু জীবনটা লকডাউনের আওতাতেই থাকে। বন্ধু-স্বজনহীন জীবন। বিনোদন নেই, চাইলে হঠাৎ পছন্দের মেনু খাওয়ার ব্যাপার নেই, ইচ্ছে হল তো বিকেলে ফুচকা খেতে যাওয়ার উপায় নেই। একেবারে একঘেয়ে জীবন। প্রাকৃতিক বিপর্যয়, চোরাশিকার ইত্যাদির পরেও যে জঙ্গলে গিয়ে আমরা এখনও কিছু বন্যপ্রাণ দেখতে পাই, তা এই বনকর্মীদের অক্লান্ত চেষ্টার কারণেই। এঁরা আসলে নেপথ্য নায়ক। এই যে জঙ্গলে গিয়ে বন্যপ্রাণ দর্শন করে আমরা হল্লা করি, কিন্তু কখনও কি এই বনকর্মীদের প্রাণপাত, থ্যাঙ্কলেস অথচ জরুরি কাজটার কথা ভাবি?

আর মাইনে? সে কথা না হয় উহ্য থাক। আগাম মাস মাইনের অঙ্কটা জানলেই অনেকে এই বনকর্মীদের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে চাইবেন না। আমরা বনে যাই বন্যপ্রাণ দেখতে। দেখে উল্লাস করে ফিরে আসি। বন্যপ্রাণীদের ছবি তুলে আনি, কিন্তু বনকর্মীদের মনেও রাখি না। আবার ছবি দেখিয়ে নিকটজনদের কাছে জলদাপাড়ায় গন্ডার দর্শনের রোমাঞ্চকর বিবরণ দিয়ে আত্মশ্লাঘা অনুভব করি বটে। কিন্তু গন্ডারগুলোর বাঁচামরা নিয়ে মাথাও ঘামাই না। নিউ ইয়র্ক বলে বাঘের করোনা আক্রান্তের খবরে আমরা উত্তেজিত হই, কিন্তু ঘরের কাছে পাঁচ পাঁচটা গন্ডারের মড়কের সংবাদ রাখি না। শুনলেও তা নিয়ে মাথা ঘামাই না। অথচ কে জানে, এই দেশে মনুষ্য প্রজাতির দেহে অনুপ্রবেশের আগে করোনা ভাইরাস নিঃশব্দে জলদাপাড়ার গন্ডারকুলে সেঁধিয়েছিল কিনা। জঙ্গলে স্যানিটাইজেশন, গন্ডারদের প্রতিষেধক দেওয়া ইত্যাদির ফলে ওদের মড়ক আটকে গিয়েছে। কিন্তু ভাবুন তো, বনকর্মীদের তৎপরতায় যদি মড়ক ঠেকানো না যেত কিংবা বন দপ্তরের চেষ্টা সত্ত্বেও ওই ভাইরাস যদি গন্ডারের থেকে অন্যান্য বন্যপ্রাণিদের মধ্যে সংক্রামিত হতে থাকত, তাহলে কি উজাড় হয়ে যেত না জীবজগতের একাংশ?

সেই বিভীষিকাময় পরিণতি হয়নি তাই রক্ষা। না হলে কী হত, চোখ বন্ধ করে ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। জলদাপাড়ায় গন্ডার নেই, গোরুমারায় হাতি নেই। এর মানে কিন্তু মানুষের অস্তিত্বও সংকটে। আসলে আমরা হুজুগে পাবলিক এত কথা ভাবতেই চাই না। চাই না বলেই এই মার্চ মাসের শেষে একদিনে ১৩টি শকুনের মৃত্যু আমাদের চেতনায় আলোড়নই তোলে না। হ্যাঁ মশাই, ১৩টি শকুন। শিলিগুড়ির কাছে সাহুডাঙ্গিতে নদীর চরে পাওয়া গিয়েছে এক ডজন প্লাস একটি শকুনের দেহ। পচাগলা গবাদি পশুর দেহাংশ খেয়ে বিষক্রিয়ায় মৃত্যুর সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছেন বনকর্তারা। আজকাল নাকি মানুষ আর গবাদি পশু মরলে দেহ যেখানে সেখানে ফেলে রাখে না। মাটিতে পুঁতে দেয়। ফলে সেই দেহ খেয়ে বিষক্রিয়ায় মৃত্যুর সম্ভাবনা ধোপে টেঁকে না। কিন্তু কেন মরে গেল এতগুলি শকুন? বিশ্বাসযোগ্য জবাব কিন্তু মেলেনি। মৃত গবাদি পশুর দেহ শকুনের স্বাভাবিক খাবার। অথচ মানুষ এখন গোরু, মহিষের দেহ ফেলে রাখে না। তাই অন্য একটি জল্পনা ঘুরছে।

বনকর্তাদের কেউ কেউ বলছেন, না খেতে পেয়ে মরেছে ওরা। মানে অনেক সময় যে শকুন দুর্ভিক্ষের প্রতীক হয়ে ওঠে, সেই প্রাণীটিই নাকি অনাহারে মরে গিয়েছে। দুর্ভিক্ষ যেন নেমেছে ওদের জীবনে। সম্ভাবনাটা পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি আমার কাছে। দীর্ঘদিন বন্যপ্রাণ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপচারিতার সূত্রে যেটুকু জ্ঞান হয়েছে, তাতে মনে প্রশ্ন জেগেছে, অনাহারও যদি কারণ হয়ে থাকে, তাহলেও কি একদিনে একসঙ্গে ১৩টা শকুনের মৃত্যু হতে পারে? ওদের মৃত্যুর পিছনেও কোন ভাইরাস নেই তো? দেশে-বিদেশে করোনা সংক্রমণ যখন ক্রমেই লাগামছাড়া হয়ে উঠছে, এমন একটা সময়েই কিন্তু শকুনের এই গণমৃত্যু। এ নিয়ে সত্যিই গবেষণা প্রয়োজন, দরকার নিবিড় ক্ষেত্রসমীক্ষার। আমরা নিজেদের নিয়ে বড় ব্যস্ত। বিপন্নতা আছে। তাই বলে এই না-মানুষ জগতেও কোনও বিপদের সতর্কবার্তা এল কিনা, তা একবার জানা, বোঝার চেষ্টা হবে না?

লকডাউনে আমাদের গরিবরা প্রায় অনাহারের মুখে। আমাদের মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তরা রাস্তায় উচ্ছিষ্ট ফেলে রাখতে পারছি না বলে পথকুকুররাও নিরন্ন।

বনমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় পথে নেমে ওদের খাওয়ালেন। সংবাদপত্রে ছবি ছাপা হল। নিশ্চয়ই শুভ উদ্যোগ। এই পথকুকুরদের খাবার জোগাড় করে দেওয়ার তো কেউ নেই। অন্য কোনও ভাবে ওদের খাবার সংগ্রহের অভ্যাস তৈরি হয়নি। ওদের মুখে খাবার তুলে দেওয়া নিশ্চয়ই জরুরি এবং মহৎ কাজ। তাই বলে ৫টা গন্ডার বা ১৩টা শকুনের মৃত্যুর কারণ জানার চেষ্টা হবে না? ওরা জংলি জীব বলে উপেক্ষিত হবে ওদের অধিকার? তার চেয়েও বড় কথা, পশু-পাখি থেকে মানুষে সংক্রমণ হতে কতক্ষণ? মানুষের চিকিৎসার জন্য এত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, এই চিকিৎসাকে কেন্দ্র করে এত ঝগড়া, এত রাজনীতি চলছে, অথচ জঙ্গলে পড়ে আছে বলে এই না-মানুষদের নিয়ে কোনও মাথাব্যথা নেই কারও। আমরা ভুলে গিয়েছি বা মনে রাখতে চাই না যে উহানে প্রাণীবাজার থেকেই প্রথম করোনা ভাইরাস ছড়িয়েছিল বাদুড়ের দেহ থেকে। যত উপেক্ষাই করি না কেন, প্রাণিকুলের সঙ্গে মনুষ্য প্রজাতির সম্পক অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।

প্রাণি, পাখিরা সুস্থ না থাকলে একক ভাবে মানুষের বেঁচে থাকা কঠিন। পশুপাখিরা কিন্তু মানুষ ছাড়াও দীর্ঘদিন অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রাখতে পারবে। দেখতে পাচ্ছেন না, লকডাউনের এই একমাসে কেমন নির্বিবাদে আছে ওরা! ওদের বিচরণ আগের চেয়ে অনেকগুণ বেড়েছে। ওদের চলাফেরা এখন অনেক স্বচ্ছন্দ। দক্ষিণবঙ্গে দামোদর, ময়ূরাক্ষী নদীর জীববৈচিত্র্য ফিরে এসেছে। এই কলকাতা শহরেই রবীন্দ্র সরোবর এখন পাখির কলতানে মুখর। উত্তরবঙ্গে চিতাবাঘ, বাইসনরা আরও বেশি সংখ্যায় বাইরে বেরিয়ে পড়ছে। কোচবিহারে নিশিগঞ্জের মতো জায়গায় মানসাই নদীর আশেপাশে ধনেশ পাখি দেখা যাচ্ছে হঠাৎ। তিস্তা নদীর জলে হঠাৎ যেন মাছের সংখ্যায় প্লাবন বইছে। ওরা যেন সভ্যতায় অনেকটা পিছনের সময়ে ফিরে গিয়েছে। লকডাউনকে ধন্যবাদ ওদের এই পরিবেশ ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। এই তো ২৪ এপ্রিল মোটা গোঁফ জোড়ার জন্য নজরকাড়া আমাদের রাজ্যের মুখ্যসচিব রাজীব সিনহা পরিসংখ্যান দিয়ে জানালেন এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের কী ভীষণ উন্নতি হয়েছে।

কলকাতায় এই মার্চেও বায়ুদূষণের সূচক ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি – ১৭৫। সেই সূচক এখন এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে মাত্র ৩০। হাওড়ার সূচক একই সময় ছিল আরও বেশি- ২৩৬। এখন সেটা নেমেছে ৪০-এ। আর পুরোপুরি শিল্পাঞ্চল আসানসোলে সেই সূচক ২৮৭ থেকে নেমে গিয়েছে ৭৭-এ। মহানগর ও শিল্পাঞ্চলের পরিবেশের উন্নতি যদি এতটা হতে পারে, তাহলে উত্তরবঙ্গ বা অন্যান্য বনাঞ্চল ঘেরা এলাকায় বন্যপ্রাণিদের স্বস্তি কতটা, সহজেই অনুমেয়। নব্বইয়ের দশকে একবার বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পে হাতির মড়ক শুরু হয়েছিল অ্যানথ্রাক্স সংক্রমণে। ভাইরাস তো বটেই। আর সেই ভাইরাসের উৎস ছিল গোরু। গৃহপালিত গোরু, মানুষ সহজে যাদের গ্রাসাচ্ছদনের জন্য জঙ্গলে বিচরণ করতে পাঠায়। প্রাকৃতিক পরিবেশে ঘাস, লতাপাতা খেয়ে জীবনধারণের পাশাপাশি এই গবাদি পশুর দল জঙ্গলে রেখে যায় ভাইরাস। সেই আমলেই বন দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী শুধু বক্সা বনে রোজ বিচরণরত গোরুর সংখ্যা ছিল গড়ে এক লক্ষ।

এখন সেটা বেড়ে কত গুণ হয়েছে ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। গোরু জঙ্গলে ছেড়ে দেয় মানুষ। ভাবুন, আমরা বন্যপ্রাণির কত বড় সর্বনাশ করে চলেছি প্রতিনিয়ত। অথচ জলদাপাড়ার কটা গন্ডার মরলে কিংবা একসঙ্গে ১৩টা শকুনের মৃত্যু হলে কী ভীষণ নিরুত্তাপ থাকি আমরা। ভাবিই না বন্যপ্রাণির ধ্বংসের কারণ তৈরি করে নিজেদেরই কবর খুঁড়ছি। লকডাউন আরও বেশি করে সত্যটা আমাদের মনে করিয়ে দিয়ে গেল। মনে করাল বটে, কিন্তু আমরা শুনলাম কি? শুনলেও সচেতন হলাম কি?

কর্মসূত্রে কলকাতায় দীর্ঘদিন বসবাসের পর থিতু শিলিগুড়ি শহরে। নিজেকে ডুয়ার্সের সন্তান বলতে ভালোবাসেন। গ্রামের আদি বাড়ির একপাশে বোড়ো আদিবাসী বসত, অন্যপাশে সাঁওতাল মহল্লা। বক্সার রায়ডাক জঙ্গল গ্রামের কাছেই। শৈশব, কৈশোরে বাড়ির উঠোনে চলে আসতে দেখেছেন হাতি, চিতাবাঘ, হরিণ। জঙ্গলে কুল কুড়োতে কুড়োতে আর নদীতে ঝাঁপিয়ে বড় হওয়া। প্রকৃতি আর উপজাতিরাই প্রতিবেশী। যৌবনে এই পরিবেশে কিছুকাল বাউন্ডুলে জীবনের পর সিদ্ধান্ত, সাংবাদিকতা ছাড়া আর কোন কাজ নয়।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *