লকডাউন, লকডাউন আর লকডাউন। কবে যে এই চক্রব্যূহ থেকে মুক্তি হবে আমাদের তা অজানা। কিন্তু তাই বলে ঘরবন্দি বাচ্চাগুলোর রসনাতৃপ্তির ব্যাপারটা তো উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ওদের জন্য সাদামাটা কিছু উপকরণ দিয়ে বানিয়ে দেওয়া যেতেই পারে এসব জলখাবার। আশা করি এই বাজারেও এমত সাধারণ সামগ্রী সকলের হাতের কাছেই মজুত। আর শুধু ছোটরা কেন? বড়োরাও ডিনারে খেতে পারেন এই খাবারগুলো। তবে ছোটরা যেন একটু বেশিই ভাগ পায় এই সময়। কারণ বড়োরা এই লকডাউনের মধ্যে জলখাবার বা বিকেলের নাস্তা স্কিপ করলেও ছোটরা যেন সেটা না করে। বড়োরা চা-বিস্কুট খেয়ে ক্ষান্ত দিলেও ছোটদের করে দেওয়া যাক এসব পুষ্টিকর আর মুখরোচক খাবার। বেচারাদের সেদ্ধভাত, খিচুড়ি-আলুভাজা, ডাল-ভাত-ডিমভাজা থাক দুপুরে। বিকেলে ওদের এমন বানিয়ে দাও না এক-আধদিন! 

(১) নকলি ফ্রিটাটা

একটি বেশ ভালো অথচ মুখরোচক স্ন্যাক্স আলু, ডিম আর পেঁয়াজ দিয়ে। মাঝারি দুটি আলু গ্রেট করে জলে ভিজিয়ে রাখতে হবে দুঘণ্টা। তারপর ছেঁকে তুলে জল চেপে নাও। ঝিরিঝিরি কাটা দুটি মাঝারি পেঁয়াজ। দুটি কাঁচালঙ্কা। তিনটি ডিম। দু’টেবিল চামচ ময়দা। ইচ্ছে হলে ধনেপাতা কুচি, গ্রেট করা গাজর দেওয়া যায়। আরও মহার্ঘ্য করতে চাইলে একটি চিজ কিউব গ্রেট করে দেওয়া যায়।  

Potato fritata
আলু দিয়ে ফ্রিটাটা! ঝটপট সহজে ছোটদের মন জয়! – cookieandkate.com

মিক্সিং বোলে নুন, গোলমরিচ আর বাকি সব উপকরণ নিয়ে ডিম ফেটিয়ে দু’টেবিল চামচ ময়দা দাও। ভালো ভাবে সব একত্রে মিশিয়ে ননস্টিক প্যানে তেল মাখিয়ে খুব গরম করে পুরো মিশ্রণটা একবারে ঢেলে দাও। এবার ছড়িয়ে সমান করে দাও প্যানের মধ্যে। তারপর গ্যাসের আঁচ কমিয়ে ঢাকা দিয়ে দাও। আট মিনিট রাখো এই ভাবে। তারপর ঢাকা খুলে সাবধানে উল্টে দাও একসঙ্গে পুরোটা। ততক্ষণে জমে গিয়েছে একটি পিৎজার মত। আবারও উল্টো পিঠ গ্যাস কমিয়ে ঢাকাচাপা দিয়ে আরো আট মিনিট রাখো। ব্যস্ত হলে চলবে না। ধৈর্যচ্যুতি হলেই ভেঙে খানখান হবে কিন্তু! ব্যস! তৈরি। পিৎজার মত ওয়েজ কেটে নাও এই নকল ফ্রিটাটার। অসাধারণ খেতে! আমি বলি ইনস্ট্যান্ট মোগলাই পরোটা।    

(২) ব্রেড ডিলাইট 

পাঁউরুটির স্লাইসে চিজ স্প্রেড লাগিয়ে রাখো। এবার করোনার বাজারে হাতের কাছে কী সবজি আছে জানা নেই। তবে পেঁয়াজ, গাজর, ক্যাপসিকাম, টোম্যাটো থাকতেই পারে। ফ্রোজেন সুইট কর্ন থাকলে সামান্য নুন দিয়ে গাজরকুচি ও সুইট কর্ন ভাপিয়ে নাও। প্যানে অলিভ অয়েল বা যে কোনও সাদা তেল দিয়ে পেঁয়াজ কুচি দিয়ে, সেদ্ধ সবজি দাও। খানিকটা নাড়াচাড়া করে নামিয়ে রাখো। ঠান্ডা হলে বাকি সব উপকরণ দিয়ে বেশ মিশিয়ে নাও। এবার ঐ মিশ্রণ ব্রেডের ওপর বেশ পুরু করে লাগিয়ে দাও, চিজ গ্রেট করে দাও। প্রি-হিটেড আভেন বা ওটিজি-তে ১৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে মিনিট দশেক রাখো। যদি বাড়িতে থাকে তবে গার্নিশ করো অরেগ্যানো আর চিলি ফ্লেক্স ছড়িয়ে। নয়তো শুধুই গোলমরিচে দিব্য চলবে। সার্ভ করো গরম গরম।  

(৩) স্বাস্থ্যকর সবজি পরোটা 

sabzi paratha
সবজি পরোটার ছবি সৌজন্যে – youtube.com

ফুলকপি, গাজর, বিনস, ক্যাপসিকাম, পেঁয়াজ সব কুচিয়ে এক কাপ করে নাও। আর মাল্টিগ্রেন আটা (চাক্কি আটার সঙ্গে, যবের ছাতু, ছোলার ছাতু, ভুট্টার আটা মিশিয়ে রাখি আমি)। না থাকলে আটা-ময়দা সমপরিমাণে মিশিয়ে মাখলেও হবে। প্রেশার কুকারে হালকা আঁচে ফুলকপি, গাজর, বিনস ভাপিয়ে ঠিক আন্দাজমত জল দিয়ে যাতে পুরোটা জল শুকিয়ে নেওয়া যায়। হাতা দিয়ে ম্যাস করে নাও মসৃণ করে। কড়াইতে সামান্য সাদা তেল গরম করে পিঁয়াজ ভাজতে ভাজতে সবজি সেদ্ধটা দিয়ে নাড়। এবার সেদ্ধ আলু, গ্রেটেড রসুন-আদা, ক্যাপসিকাম কুচি দিয়ে আবার ভাজো কিছুটা। সবশেষে ধনেপাতা আর কাঁচালঙ্কাকুচি দিয়ে সামান্য লেবুর রস দিয়ে পুরটা শুকনো করে ঠান্ডা হতে দাও। 

টাটকা ছানার জল ফেলে না দিয়ে আটাতে নুন দিয়ে সামান্য তেল হাত করে নরম করে মেখে রাখ ঘণ্টা দু’য়েক। তারপর লেচি কেটে পুর ভরে বেলে নিয়ে তাওয়ায় সেঁকার পালা। অল্প তেল বা ঘি ছড়িয়ে সোনালি রঙ ধরা অবধি ভাজা। সোনা হেন মুখে খাবে সব্বাই। এর সঙ্গে আচারি ডাল জমে যাবে কিন্তু।  

(৪) জলখাবারে অগতির শিরনি

বেশ কয়েকটা কলা চটকে নাও। মাথাপিছু প্রত্যেকের জন্য দু’টি করে ছোটো কলা। এবার ফোটানো, ঠান্ডা করা দুধ ঢালো। সঙ্গে আটা। অথবা ছাতু। এ বার আখের গুড়। না থাকলে চিনি। ভালো করে মেশাও। মাখতে থাকো মসৃণ করে। চারটে কলার জন্য আধকাপ আটা,

সত্যানারাণের শিরনি লকডাউনের বাজারে অতি উপভোগ্য! ছবি সৌজন্যে – cookpad.com

আধকাপ ছাতু। এক কাপ দুধ, দু’টেবিল চামচ গুড় লাগবে। সিন্নির কনসিসট্যানসি আমাদের সবার জানা। মাখতে মাখতে বোঝা যাবে। এবার ড্রাই ফ্রুটস, চাকা করে কাটা শসা, নারকোল থাকলে একটু কুরে বা কুচিয়ে। অন্য কোনও ফল থাকলেও কুচিয়ে দাও। এক ফোঁটা ঘিয়ের হাত আর সামান্য কর্পূর, তুলসি পাতা ছড়িয়ে দিলে ঠিক মনে হবে নারায়ণের জন্য নিবেদিত। বাতাসা থাকলে গারনিশ করে দাও। নারায়ণ কি নিজে খান কোনও দিন? অতএব বাড়ির নারায়ণদের জন্যই না হয় নিবেদিত হোক এই অমূল্য অতুলনীয় প্রাতরাশ। ঘরের জীব বাঁচলে তবেই তো নারায়ণের সেবা হবে! আর স্বয়ং নারায়ণ এতেই বেশি খুশি হবেন!

(৫) ছাতুর পরোটা

আটা-ময়দা, হিং, তেল, নুন, জোয়ান দিয়ে নরম করে মেখে রাখতে হবে। এ বার ছাতুর মধ্যে নুন, মিষ্টি, হিং-আদা-কাঁচালংকাবাটা দিয়ে, জল ছড়িয়ে মেখে নিতে হবে পুরের জন্য। লেচি কেটে তার মধ্যে পুর ভরে পরোটা বেলে ভাজতে হবে তেল বা ঘিয়ের ছিটে দিয়ে। আচার দিয়ে বা টক দই দিয়ে ভালোই লাগবে। এর সঙ্গে আলু চচ্চড়িও খাওয়া যায়।

(৬) ভরপেট ব্রেড স্যালাড

করোনার বাজারে ব্রেড পাওয়া যাচ্ছে। তবে এই কাঁচা ব্রেড দিয়ে স্যান্ডুইচ খাওয়া কতটা নিরাপদ তা জানি না বাপু। তাই ব্রেড প্যাকেট সমেত স্যানিটাইজ করে রোদে ফেলে তারপরে কিন্তু ঘরে তুলছি আমি। তারপরে ফ্রিজে। এবার সেই ব্রেড ছোট ছোট টুকরো করে কেটে নিতে হবে। গাজর, বিনস, ক্যাপসিকাম, কড়াইশুঁটি , পেঁয়াজ, কাঁচালংকা সব কেটে রাখতে হবে। কড়াইতে সাদা তেল দিয়ে পেঁয়াজের সঙ্গে সব কুচোনো সবজি ঢাকাচাপা দিয়ে ভেজে নিতে হবে। অন্য একটি ননস্টিক প্যানে সামান্য তেল মাখিয়ে ব্রেডের টুকরোগুলিকে মুচমুচে করে নিতে হবে। এবার সবজির মধ্যে ব্রেড, নুন, গোলমরিচ আর টম্যাটো কেচাপ ছড়িয়ে দিতে হবে। ডিমের অমলেট করে কুচিয়ে মিশিয়ে নিলে দারুণ লাগবে খেতে।

(৭) পাঁপড় ঝালদে

মশলা পাঁপড় ভেজে তুলে নিতে হবে। মাথাপিছু দু’টি করে পাঁপড়। আলু চাঁদের মত করে কাটা, টম্যাটো কুচি, চেরা কাঁচালংকা লাগবে। এবার সরষের তেলে পাঁচ ফোড়ন দিয়ে আলু নেড়ে নিয়ে সামান্য আদাবাটা আর টম্যাটো দিয়ে কষতে হবে। একটু ঝাল ট্যোম্যাটো সস দিলে আরও ভালো হয়। তারপর সামান্য জিরে গুঁড়ো, ধনে গুঁড়ো, লংকা গুড়ো আর এক টুসকি হিং দিয়ে কষতে হবে। নুন, হলুদ দিয়ে জল দিতে হবে। পাঁপড়ে যেহেতু নুন থাকে তাই এই তরকারিতে নুন খুব কম দিতে হয়। আলু সেদ্ধ হলে ভাজা পাঁপড় ভেঙে দিতে হবে। মাখামাখা হলে নামিয়ে রুটির সঙ্গে দারুণ চলে যায় এক আধ দিন। আমার ভাশুর যদিও একে বলতেন ন্যাকড়ার তরকারি! 

(৮) পোট্যাটো পিক-আপস

আলু চার টুকরো করে সামান্য নুন দিয়ে সেদ্ধ করে খোসা ছাড়িয়ে নাও। এবার সেদ্ধ আলুগুলি ঠান্ডা হলে একটি সুদৃশ্য কাচের বোলে রেখে একে একে সব উপকরণ মেশাও। তেঁতুল ও গুড় দিয়ে তৈরি আচার, জিরেভাজার গুঁড়ো, বিটনুন, পাতিলেবুর রস ১ চামচ, ধনেপাতা কুচনো, কুচনো পিঁয়াজ, লংকাকুচি আর লাল লংকা গুঁড়ো মিশিয়ে টুথ পিকে গেঁথে সার্ভ করো বাড়ির খুদে সদস্যটিকে।

Indira Mukhopadhyay Author

রসায়নের ছাত্রী ইন্দিরা আদ্যোপান্ত হোমমেকার। তবে গত এক দশকেরও বেশি সময় যাবৎ সাহিত্যচর্চা করছেন নিয়মিত। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায় এহং প্রথম উপন্যাস সানন্দায় প্রকাশিত হয়। বেশ কিছু বইও প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যেই। সব নামীদামি পত্রিকা এবং ই-ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখেন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, রম্যরচনা ও প্রবন্ধ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *