দুপুরের খাওয়া-দাওয়া মিটতে দু’টো বেজে গেল। তারপর আর অপেক্ষা করতে চাইলেন না সুজাত। বললেন, “পৌঁছতে চাই সন্ধের আগেই। নইলে উল্টো দিক থেকে আসা গাড়ির আলোয় খুব অসুবিধে হয় ড্রাইভ করতে।” বাবাকে নিয়ে দেবদীপ কিছুক্ষণ আগেই ফিরে গিয়েছে নিজের বাড়ি। প্রজ্ঞান-মধুরার সঙ্গে সুমিত্রা এগিয়ে গেলেন সুজাতকে বিদায় জানাতে। খানিকটা দূরত্ব রেখে এগিয়ে এল অরিত্রও। সকাল থেকে একবারও অরিত্রর চোখে চোখ রাখেননি সুজাত, অরিত্ররও ইচ্ছে হয়নি তাঁর দিকে তাকাতে। যে মুহূর্ত থেকে জেনেছে আজ দুপুরেই সুজাত ফিরে যাচ্ছেন কলকাতায়, সেই মুহূর্ত থেকে অপেক্ষা করছে, লোকটা কতক্ষণে যাবে!

সকলকে বিদায় জানিয়ে সুজাত এগিয়ে গেলেন গাড়ির দিকে, তাঁর সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে গেল কুর্চি। কুর্চির পিঠ ঘিরে সুজাতর হাত, হাতের মুঠোয় কুর্চির বাহু। গাড়ির কাছে পৌঁছে কুর্চির কপালে একটা চুমু খেলেন সুজাত। তারপর পকেট থেকে রুমাল বার করে নিজের চোখ দুটো মুছলেন। লোকটা কেঁদে ফেলল নাকি? দূর, নাটক করছে, ভাবল অরিত্র।

সুজাতর গাড়ি বেরিয়ে যেতেই কুর্চি ফিরে এসে তার দিম্মাকে বলল, “এবার তোমরাও চলো। অনেক ধকল গেছে আজ তোমার হাঁটুর ওপর দিয়ে। আবার তো সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠতে হবে। ফিরে গিয়ে বিশ্রাম করো কিছুক্ষণ, আমি ততক্ষণে এ বাড়িতে আমার কয়েকটা কাজ শেষ করে নেব।”

মধুরা বললেন, “সেই ভালো। একটা টোটো ডেকে দে, আমরাও বেরিয়ে পড়ি।” কুর্চি লাফিয়ে উঠে বলল, “কী যে বলো দিম্মা! তাই কখনও হয়! তোমাকে বাড়ি থেকে টেনে বার করলাম কতদিন পরে, আর নিজে গিয়ে দোতলায় তুলে দিয়ে আসব না?” মধুরা হাল ছেড়ে বললেন, “তাই যখন তোমার ইচ্ছে কুচোসুন্দরী, তাহলে বার করো তোমার গাড়ি। প্রজ্ঞান এসো। সুমিত্রা, তুমি তো বললে বুধবার বুধবার মন্দিরে যাবে। হাঁটু দুটো আগের মতো মজবুত থাকলে আমিও যেতাম তোমার সঙ্গে। অরিত্র, সাবধানে থেকো। মাকে দেখো। মাঝে মাঝে মাকে নিয়ে এসো আমাদের বাড়ি।”

কুচোসুন্দরী ডাকটা অরিত্রর খুব পছন্দ হয়েছে। ঝটিতি বলল, “সে যেদিন কুচোসুন্দরী চাইবেন, সেদিনই হবে।” ভুরু পাকিয়ে ধমক দিলেন মধুরা, “ওই ডাকটা ওর দিম্মার পেটেন্টেড প্রপার্টি। ওখানে ভাগ বসাতে হলে বিশাল রয়্যালটি দিতে হবে ভাই।”

 সবাই বেরিয়ে যেতেই সুমিত্রা বললেন, “আমার পা দুটোও বিশ্রাম চাইছে। আমি ওপরেই যাই। ছোটু কী করবি এখন?”
– এই গাছটার নাম কি মা?
– মনে হচ্ছে জারুল।
– আমি এখন এই জারুল গাছের নিচে খোশমেজাজে চেয়ারখানি চেপে একটু জিরোব।
– বাঁদর কোথাকার! বল না সিগারেট খাবি।
– উফ, আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে! যাও ওপরে গিয়ে বিশ্রাম করো।

চেয়ারের দু’দিকে দু’টো পা ছড়িয়ে অরিত্র ভাবছিল, মাঝে মাঝে দু-একটা পাখির ডাক ছাড়া কোত্থাও কোনও আওয়াজ নেই। দুপুর যে এমন স্তব্ধ হতে পারে সেটা কি আগে কখনও টের পেয়েছে? ঠিক তখনই স্তব্ধতা ভেঙে গুরগুর করে কুর্চি এসে ঢুকল গাড়ি চালিয়ে। দেখেই বেরিয়ে এল বসন্তদা। বলল, “কী ভালো লাগছে তোমাকে আবার গাড়ি চালাতে দেখে!” কুর্চি হেসে উত্তর দিল, “সে ভালো যতই লাগুক আমার দাদা, সাইকেল তুমি এখনও ফেরত পাচ্ছ না।”

– কেন? ও সাইকেল নিয়ে আর কী হবে তোমার?
– আর কী হবে মানে! এই যে গাড়ি গ্যারেজে তুললাম, সে আবার ওইখানেই থাকবে এখন। তোমার সাইকেল নিয়ে একটু পরেই আমি ও-বাড়ি ফিরে যাব। আর এই পুরনো সাইকেল তো তোমাকে ফেরত দিচ্ছি না। কয়েকটা দিন অপেক্ষা করো, স্টাইপেন্ডের টাকাটা হাতে এলেই তোমার নতুন সাইকেল আসছে।

ঘোর অবিশ্বাসে চোখ পিটপিট করে বসন্ত জিজ্ঞেস করল, “ও বাড়ি ফিরে যাবে! কেন? কিসের জন্য?” গাড়ির চাবিটা বসন্তর হাতে ধরিয়ে কুর্চি বলল, “কৃষ্ণাদি কিচ্ছু বলেনি তোমাকে? কী আশ্চর্য! আরে, আমি তো ও-বাড়িতেই থাকব এখন। শুধু ওই দাদা আর তার মা থাকবে এখানে। আমার ফেরার সময় এখনও হয়নি বসন্তদা। তবে আমি আসব তো। রোজ হয়ত পারব না, কিন্তু মাঝেমঝেই এসে তোমাদের খোঁজ-খবর নিয়ে যাব। ও বাড়ির দেবুদা, সেও আসবে। সঙ্গে করে লোক আনবে। দাদার খাওয়া-দাওয়া, লাফঝাঁপ, ছুটোছুটি সব ওরাই ঠিক করে দেবে। কেমন?” বলে স্তম্ভিত বসন্তকে পিছনে ফেলে কুর্চি এগিয়ে গেল লনের এক কোণে বসে থাকা অরিত্রর দিকে।

অরিত্র মুখিয়ে ছিল কথাটা জিজ্ঞেস করার জন্যে। কুর্চি কাছাকাছি আসতেই বলল, “বসন্তদার আসল প্রশ্নটার তুমি কিন্তু কোনও উত্তর দিলে না! এখন তোমার এখানে ফিরে আসতে অসুবিধে কোথায়?”

আর একটা চেয়ার টেনে কুর্চিও বসল জারুলের ছায়ায়। বলল, “দিম্মার বাড়িটা কি হোটেল? যেদিন ইচ্ছে গিয়ে ঢুকলাম, কাজ ফুরোতেই চলে এলাম? ওঁরা কোথাও বেরোতে পারেন না, একা হয়ে গিয়েছেন, সেটা খানিকটা বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু গিয়ে দেখলাম, কী অসহ্য অবস্থা! দাদু সারা দিন বই, খবরের কাগজ আর টিভি নিয়ে পড়ে থাকেন, যা খেতে দেওয়া হয় কোনও রকমে নাকেমুখে গুঁজে উঠে পড়েন। আর দিম্মা ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে শোবার ঘরেই খাবার খান। কখনও সিডি চালিয়ে গান শোনেন, কখনও টিভিতে সিনেমা দেখেন। কেউ কারও সঙ্গে কথা বলেন না, কথা বললেই ভুল বোঝাবুঝি, রাগারাগি, অশান্তি। একটা ফোন এলে জেগে উঠে কথা বলেন, কিন্তু যতটা কথা বললে ওঁদের তৃপ্তি হয়, শান্তি হয়, ততটা সময় কার কাছেই বা আছে? ওঁদের ছেলেমেয়ের কাছেই নেই। অথচ ওরা মা-বাবাকে খুবই ভালোবাসে, প্রায়ই ফোন করে, লম্বা ছুটি পেলেই ছুটে আসে। সঙ্গে নিয়ে যেতে চায়। দাদু-দিম্মাই বরং বারবার বলেন, “আমাদের কথা এত ভাবতে হবে না। কয়েক বার গিয়েছি তো তোমাদের কাছে। এখন শান্তিনিকেতনে আমরা খুব ভালো আছি।” এই সব। কিন্তু সত্যিটা হল,  আমাকে পেয়ে আঁকড়ে ধরে আছেন দু’জনে। শান্তিনিকেতনে কোথায় কী হচ্ছে, কে কী বলেছে, সব খবর পাচ্ছেন, কত পুরনো গল্প শোনাচ্ছেন। আমার সমস্যা নিজেদের সমস্যার মতো করে ভাবছেন! বারবার বলছেন, এবার তুই ফিরে যা। কিন্তু আমি ভাবছি, ওখানেই থাকব এখন। তোমরা ফিরে গেলে চেষ্টা করতে হবে ওঁদের এ বাড়িতে এনে যত দিন সম্ভব রাখার। তবে যা অভিমানী, রাজি করানো খুব মুশকিল।”

“প্রশ্ন কিন্তু একটা আমারও আছে,” একটু থেমে যোগ করল কুর্চি। “গোলকিপার এখনও বাবাকে সহ্য করতে পারছে না, তাই না?”

“শুধু তোমার কথায় এই বাড়িতে এসে উঠেছি। তা বলে চাইলেই সব ভোলা যায়! কী করে ভুলব? ভুলে যাব, কার জন্যে আমার প্রায় একটা মাস হাসপাতালে কাটল? কার জন্যে?” আর্তনাদের মতো শোনাল অরিত্রর গলা।  কথা শেষ হতে না হতেই ফস করে একটা সিগারেট ধরাল। “আমাকেও একটা সিগারেট দাও তো,” বলে অরিত্রর বাড়ানো প্যাকেট থেকে নিয়ে সিগারেট ধরাল কুর্চিও। উত্তর দেওয়ার জন্যে মুখ খুলল খানিকটা সময় নিয়ে। বলল, “টাকার জোরে, ক্ষমতার নেশায় তার চতুর্দিকের সব কিছু নিজের ইচ্ছে মতো চালাতে চায়, এরকম একটা উন্মাদ, একটা পাগলের জন্যে তোমাকে ভুগতে হয়েছে গোলকিপার। তোমার সঙ্গে সঙ্গে আমাকেও হয়েছে। ঠাম্মাকে হারিয়েছি আমি এই পাগলামির জন্যে। তখন তো জানতামই না। কিন্তু সেই পাগলটাকে কি আজ এক মুহূর্তের জন্যেও দেখতে পেলে? অবশ্য দেখবেই বা কী করে! তুমি তো আজ একবারও তাকাওইনি তার দিকে!”

– ঠিক বলেছ। তাকাইনি। তাকাতে পারিনি। তখন আমার কী ইচ্ছে করছিল জানো? ইচ্ছে করছিল টেবিলটা লোকটার মুখের ওপর উল্টে দিয়ে জিজ্ঞেস করি, কেন আমার এত বড় ক্ষতি করলেন? কী লাভ হল আপনার? কিন্তু এসব কিছুই করিনি। সব রাগ ভেতরে পুষে রেখে শুধু ভেবে গিয়েছি, কুর্চি বলেছে, লড়াইটা আমরা একসঙ্গে লড়ছি। ব্যাস।

কোত্থেকে মেঘের একটা টুকরো এসে বিকেলের পড়ন্ত রোদ্দুর আড়াল করে দাঁড়াল। বাড়ি ফেরার আগে সাতটা ছাতার পাখি কুর্চি আর অরিত্রকে একটুও গ্রাহ্য না করে লনের ঘাসের মধ্যে লাফিয়ে লাফিয়ে পোকামাকড়ের সন্ধান করছিল। আলো মুখচোরা হয়ে যেতেই তারা হুস করে উড়ে গেল একসঙ্গে। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কুর্চি জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু লড়াইয়ের পরিণতিটা কী হবে গোলকিপার? বাবাকে শাস্তি দেওয়া? ভেঙে মুচড়ে দেওয়া? যাতে তোমার সঙ্গে, এমনকি তার আগেও, ভয়ানক অন্যায় করার অপরাধবোধে লোকটা সারা জীবন দগ্ধে দগ্ধে মরে? যাতে আর কোনও দিন তাকাতেই না পারে তোমার মুখের দিকে? নাকি, লোকটাকে পাল্টাতে সাহায্য করা? ঘেন্না করে নয়, ভালোবেসে লোকটার হাত ধরা? যাতে তোমাকে নিয়েই একদিন সে গর্ব করতে পারে? কোনটা হওয়া উচিত আমাদের লড়াইয়ের পরিণতি?”

মেঘ সরে গেছে, পশ্চিমের রোদ্দুর এখন মনের মতো করে রাঙিয়ে নিচ্ছে তার বিদায় লগ্ন। অরিত্র দেখল কথাগুলো বলতে বলতে উত্তেজনায় লাল হয়ে উঠেছে কুর্চির মুখ, চিকচিক করছে চোখের কোণ। আস্তে আস্তে জল ভরে উঠছে তার দিঘির মতো চোখে। কুর্চিকে জড়িয়ে ধরতে খুব ইচ্ছে করল অরিত্রর, উঠে পড়ল চেয়ার থেকে। কিন্তু ঠিক তখনই লনের অন্য মাথায় দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন সুমিত্রা। সূর্যের প্রসন্ন মুখের দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে তিনি বলে উঠলেন, “রক্ষা করো, কল্যাণ করো, মার্জনা করো।”

কুর্চি ফিরে গেল সন্ধে নামার আগেই। রাতের খাওয়ার পালা শেষ করে কৃষ্ণা তার ছেলেমেয়ে নিয়ে চলে গেল ন’টা বাজার খানিক পরে। এ বাড়ির বই-সংগ্রহ দেখে সুমিত্রা উচ্ছ্বসিত। পছন্দমতো একটা বই বেছে নিয়ে তিনিও ঢুকলেন বিছানায়। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়াই অরিত্রর অভ্যেস,  কিন্তু আজ শোবার ঘরে ঢুকেই ছিটকে বেরিয়ে এল। চোখে ঘুমের লেশমাত্র নেই, বিছানায় ঢোকার কথা এখন সে ভাবতেও পারছে না। আলো নিবিয়ে বারান্দায় বসে শুনতে পেল প্রতিবেশী কোনও বাড়িতে এসরাজের নিপুণ চর্চা চলছে। ইমন। অল্প চেষ্টাতেই রাগটা চিনতে পারল অরিত্র। ইমন শেষ হল বেশ খানিকটা সময় নিয়ে, তখন শুধুই ঝিঁঝিঁর ডাক। শুনতে শুনতে অরিত্র ভাবছিল, কুর্চির সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়ার পর থেকে কত রকম বদল এল তাদের দু’জনেরই জীবনে! হঠাৎ একটা মেসেজ ঢুকল দেখে অন্যমনস্কভাবে ফোনটা হাতে তুলে নিল অরিত্র। মেসেজটা পড়ে একটু ঝুম হয়ে বসে রইল সে। “দিস ইজ সুজাত গুপ্ত। আর ইউ ফ্রি টু টক?”

“আই শ্যাল নেভার বি ফ্রি টু টক টু ইউ”, মনে মনে বলতে বলতে ফোন ব্যাক করল অরিত্র। শুকনো গলায় বলল, “হ্যাঁ, বলুন।”

“বাড়ি ফিরে দেবদীপের ফোন পেলাম। অনেক কথা হল তোমাকে নিয়ে। বুঝতে পারছি, আমার সম্পর্কে সত্যি-মিথ্যে অনেক কিছুই তুমি জেনেছ তার কাছ থেকে।” খুব স্বাভাবিক গলায় বললেন সুজাত গুপ্ত। “ভাবলাম আমি নিজেই ছবিটা তোমার কাছে স্পষ্ট করে দিই। আসলে দেবদীপের একটা টেনশন ছিল তোমাদের ক্লাবের স্পনসরশিপের ব্যাপারে। ও বোধহয় ভাবত নিউভি ফার্মা আমিই চালাই। কথাটা একেবারেই ভুল। ওটা মহারাষ্ট্রের এক প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর ছেলের কোম্পানি। ওরা ওষুধের ব্যবসা দিয়ে শুরু করেছে, এর পর ডায়াগনোস্টিক চেন, হাসপাতাল সবই করবে। জানি না কেন এসব কথা দেবদীপকে বলা হয়নি এতদিন! যাই হোক, এসব পাঁচ-সাত বছরের প্ল্যান, তার মধ্যে বিশেষ ফোকাসে আছে ইস্ট ইন্ডিয়া। বম্বেতে ওরা ক্রিকেট ক্লাব স্পনসর করে। চাইছিল এখানকার এমন কোনও স্পোর্টস ক্লাব স্পনসর করতে, যারা পাঁচ-সাত বছরে ন্যাশনাল সিনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। আমি অলোকেশদার কথায় দক্ষিণীকে স্পনসর করতে বলি।”

– কিন্তু এসব কথা আমাকে বলছেন কেন?
– ধৈর্য ধরে না শুনলে সেটা বুঝবে কী করে? ঠান্ডা গলায় বললেন সুজাত। “এই স্পনসরশিপ নিয়ে দেবদীপ টেনশনে পড়ে গিয়েছিল। নিউভি ফার্মা খুব সঙ্গত কারণেই তোমাদের ক্লাবের নামের সঙ্গে ওদের নাম জুড়ে দিতে চেয়েছিল। দেবদীপের মনে হয়েছিল তাতে ক্লাবটাই ওর হাতছাড়া হয়ে যাবে। তাই আমাকেই শত্রু ভেবে নিয়ে যা মনে এসেছে তাই বলে গেছে আমার সম্পর্কে, যার কোনওটাই দেবদীপ কোনওদিন প্রমাণ করতে পারবে না। আমি সে সবের মধ্যে ঢুকছি না। কিন্তু তোমার যদি মনে হয়ে থাকে, আমি তোমার প্রতি কোনও অন্যায় করেছি, তার সত্যি-মিথ্যের মধ্যে না ঢুকেই আমি তোমার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আই অ্যাম সরি।”

এটার জন্যে একেবারেই প্রস্তুত ছিল না অরিত্র। থতমত খেয়ে বলল, “দেখুন, দেবুদা আমাকে কী বলেছে না বলেছে, সেটা এখন থাক। আপনি কুর্চির বাবা, কুর্চি খুবই ভালোবাসে আপনাকে…”

অরিত্রকে কথা শেষই করতে দিলেন না সুজাত। বললেন, “কুর্চি আমাকে ভালোবাসে, তোমাকে ভালোবাসে, ওর কুকুরদের ভালোবাসে, দুনিয়ার সমস্ত পশু, পাখি, গাছপালা স-ব ভালোবাসে। ওটা কুর্চির স্বভাব। সবাইকে, সব কিছুকে বড্ড তাড়াতাড়ি বড্ড বেশি ভালোবেসে ফেলা। আমি কুর্চিকে কথা দিয়েছি, ওর জীবন নিয়ে একদম মাথা ঘামাব না। তবুও বলছি, আমার চিন্তা, তুমি কতটা সিরিয়াস?” বলতে বলতে স্বভাবসুলভ দাপট এসে গেল সুজাতর গলায়।

অথৈ জলে পড়ে গেল অরিত্র। একের পর এক অপ্রত্যাশিত চাল দিয়ে চলেছেন ভদ্রলোক। এ প্রশ্নের কোনও উত্তর হয়? তেড়েফুঁড়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল অরিত্র, ঠিক টখনই সুজাত শুরু করলেন আবার। “দেবদীপ বলছিল আমাকে, গ্র্যাজুয়েশনে বেশ ভালো রেজাল্ট ছিল তোমার, কিন্তু মাস্টার্স করনি! ফুটবল খেল খুবই ভালো, কিন্তু এখনও সিগারেট খাও। তোমার ডেডিকেশন, তোমার সিরিয়াসনেস তো যথেষ্ট চিন্তার ব্যাপার। কুর্চির সঙ্গেও এরকম করবে নাকি?”

শুনতে শুনতে পিনপিন করে একটা রাগ এসে জমা হচ্ছিল অরিত্রর মাথায়। কিন্তু সুজাতর শেষ প্রশ্নটা শুনে রাগের বদলে হাসিই পেয়ে গেল তার। বুঝল, এ হল মেয়েকে নিয়ে অবসেসড এক বাবার দুর্ভাবনা। শব্দ করে হেসেই বলল, “আচ্ছা বলুন, কী চান আপনি? সিগারেট ছেড়ে দিতে হবে, এই তো? একদম দেব। কিন্তু কুর্চিকে সিগারেট ছাড়ানোর দায়িত্বটাও নিতে হবে আপনাকে।”

ফোনের অন্যপ্রান্তে হা হা করে অট্টহাস্যে ফেটে পড়লেন সুজাত। ফোনটা শেষ করে অরিত্র টের পেল, ঝিঁঝিঁর ডাক কখন যেন বন্ধ হয়ে গেছে। আবার শুরু হয়েছে এসরাজ। কান পেতে খানিকক্ষণ শুনে বুঝল, এবার বসন্ত। (শেষ)  

আদতে ছিলেন সাংবাদিক, তারপর কর্পোরেট কর্তা। অবসরের পর শান্তিনিকেতনে বসে লেখাজোকায় মন দিয়েছেন। বেশ কিছু প্রবন্ধ আর গল্প লিখেছেন আজকাল, অনুষ্টুপ আর হরপ্পা-য়। প্রথম উপন্যাস 'গোলকিপার' প্রকাশিত হয়েছে বাংলালাইভে। আপাতত ডুবে রয়েছেন ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে। আজকালের রবিবাসর ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর ধারাবাহিক রচনা - সিনেমাতলার বাঙালি।

4 Responses

  1. পারেও বটে বাংলালাইভ। যে আগে কোনোদিন একটাও আস্ত উপন্যাস লেখেনি, তাকে দিয়েই কিনা ধারাবাহিক! এ তো ছাগল দিয়ে হাল চাষ! কিন্তু এত বড় একটা অঘটন হয়েই গেছে যখন, আর পাঠক-পাঠিকারা কেউ কেউ দয়াপরবশ হয়ে পড়েও গেলেন শেষ পর্যন্ত, তখন একটু খুলে বলবেন দয়া করে, উৎরেছি? না, ধেড়িয়েছি? কিংবা, কোথায় উৎরেছি আর কোথায় ধেড়িয়েছি? তাছাড়া, কোনো প্রশ্ন থাকে যদি! কোনো চরিত্র কি কোথাও অসংলগ্ন ব্যবহার করল? বা, অপ্রত্যাশিত? আসলে, অল্প কিছুদিন আগেও তো লেখকরা পাঠক-পাঠিকার সঙ্গে এত সহজ সংযোগের সুযোগ পেতেন না! এই ডিজিটাল মাধ্যমে লেখক তো এখন পাঠকের কিবোর্ডের নাগালেই। যদি একটু লেখেন, কৃতার্থ হই। ধ্রুবজ্যোতি নন্দী।

  2. ধ্রুবদা, কি যে বলি তোমায়? মাকালপুরের সিচুয়েশনাল বর্ণনা (আর পুন্নির খুশি) নটউইথস্ট্যান্ডিং, তুমি তো কামাল করে দিয়েছো…

    আসলে চিরাচরিত ম্যাগাজিনের মতো মুঠোফোনের হাতছাড়া বা বেনাগাল হওয়ার ভয় নেই বলে এই ধারাবাহিকটা পরে পড়বো ভেবে সরিয়ে রাখাই হয়েছিল। এই সুযোগে একনাগাড়ে পড়ে ফেললাম।

    শান্তিনিকেতনের পটভূমিকায় এই চরিত্রগুলোই কেবল চেনা মানুষ হয়ে ফুটে ওঠেনি, চরিত্রগুলো দিয়েও চেনা শান্তিনিকেতন ফুটে উঠেছে, সেখানেই তোমার সাফল্য।

    আর একটা কথা, যেভাবে ভাগ করেছ গল্পের পর্বগুলোকে, এটাকে সিনেমার স্ক্রিপ্ট বানিয়ে ফেলতেও খুব একটা অসুবিধা হবে না। খুব ভালো ছবি করা যায়।

    ইচ্ছে হচ্ছে লেগে পড়ি, যদি চাড়টা ধরে রাখতে পারি, আর যদি তুমি আমার ওপর আস্থা রাখো…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *