পণ্ডিত রবিশঙ্কর বা রবিশঙ্কর নামটা আমি একটু বড় বয়সে শুনেছি, কারণ বাড়িতে গান বাজনার চর্চার সুবাদে ছোটবেলা থেকে রবু বা রবুদা নামটাই শুনে এসেছি। যে সময় এই নামটা শুনেছি সে সময় আমার অতটা জ্ঞানগম্যি ছিল না যে বুঝব, এই নামের লোকটাকে নিয়ে বাড়িতে কেন এত কথা হয়। যখন বছর দশেক বয়স হল এবং আমার গুরু আলি আকবর খাঁ সাহেবের লেক মার্কেটের কলেজে সরোদ শিখতে আরম্ভ করলাম, তখন থেকে এই রবুদা লোকটা সম্পর্কে যেমন খানিক জ্ঞান হল, খানিক কৌতুহলও হল। কিছুদিনের মধ্যে জানতে এবং বুঝতে পারলাম যে এই রবুদা হচ্ছেন পৃথিবী-বিখ্যাত সেতারবাদক পণ্ডিত রবিশঙ্কর। আসলে আমার মেজমামা শুভেন্দু সুন্দর বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন শখের তবলা বাদক এবং রবিশঙ্করজির বন্ধু। সেই সূত্রে আমার মা ওনাকে রবুদা আর মেজমামা রবু বলে ডাকতেন। রবিশঙ্কর যখন মাইহারে বাবা আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের কাছে থেকে শিখছেন, সেই সময় উনি নানা কাজে কলকাতায় আসতেন। এই কাজের মধ্যে অন্যতম ছিল প্রখ্যাত সেতার নির্মাতা কানাইলালের দোকানে সেতার জোয়ারী করাতে নিয়ে যাওয়া। তখন সময় পেলে তিনি আমাদের দেশপ্রিয় পার্কের বাড়িতে আসতেন মেজমামার সঙ্গে দেখা করতে। আর শুধু দেখাই করতেন না, মাঝেমধ্যে থেকেও যেতেন। সেইসব দিনে একটু আধটু গানবাজনাও হত। মার কাছে শুনেছি রবিশঙ্করকে নাকি তখন একটু অন্যরকম দেখতে ছিল। হালকা দাড়ি রাখতেন আর অদ্ভুত কায়দায় সামনে ফেরতা দিয়ে ধুতি পরতেন। বাজনার হাত ছিল মিষ্টি ও সুরেলা।
প্রথমবার রবিশঙ্করজির বাজনা শুনি সত্তরের দশকের একেবারে গোড়ার দিকে। সেই ওঁকে আমার প্রথম দেখা। কিংশুক বলে এক সংস্থা আমাদের বাড়ির পাশে প্রিয়া সিনেমা হলে ওঁর এক সারারাতব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। ওঁকে তবলায় সঙ্গত করেছিলেন উস্তাদ আল্লারাখা, যিনি সব সময় ওঁর সঙ্গে বাজাতেন। উদ্যোক্তাদের মধ্যে একজন ছিলেন ভূদেবশঙ্কর (রবিশঙ্করের সম্পর্কে ভাই এবং খানিকটা ম্যানেজারের মতন)। এই ভূদেবশঙ্কর আবার আমার মায়ের মাসতুতো ভাই সুনীতমামার বন্ধু ছিলেন। তাই আমরা ওঁকে ভূদেবমামা বলেই চিনতাম। ঐ দিনের অনুষ্ঠানের টিকিট প্রায় শেষ হয়ে গেছিল। সামান্য যে ক’টা পড়ে ছিল সেগুলোর প্রচুর দাম। বাবা আর মেজমামা ভূদেবমামাকে ধরে আমার আর আমার ছোটমামার ছেলের বাজনা শোনার ব্যবস্থা করে দিল। ভূদেবমামা আমাদের দু’জনকে বেশ সামনের দিকের দু’টো সিটে বসিয়ে দিয়েছিলেন। এখনও মনে আছে, ওঁরা দু’জনেই সেদিন সাদা সিল্কের পাঞ্জাবি পরেছিলেন। রবিশঙ্কর পরেছিলেন ধুতি আর আল্লারাখা চুড়িদার। রবিশঙ্করজি মঞ্চে আসার আগে থেকেই মঞ্চের দু’ধারে উগ্র গন্ধের ধূপ জ্বলছিল। তখন বুঝিনি, ভেবেছি মশা তাড়াবার জন্য জ্বালানো হয়েছে। পরে জেনেছিলাম বাজনার পরিবেশ তৈরি করতে উনিই ওই ধূপ জ্বালাতে নির্দেশ দিতেন। যাইহোক, সেই রাতে কোন রাগ দিয়ে শুরু করেছিলেন এখন আর মনে নেই কারণ কিছুক্ষণ শোনার পর দু’জনেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু বিরতির পর যে টোড়ি বাজিয়েছিলেন সেটা মনে আছে।
১৯৭৬ সাল নাগাদ যখন আমি আমার গুরুর নির্দেশে ওঁর মেজছেলে ধ্যানেশদার কাছে ব্যক্তিগতভাবে শিখতে গেলাম তখন দেখলাম আত্মীয়তার সূত্রে ধ্যানেশদারা ওঁকে পিসেমশাই বলে ডাকেন। সেই থেকে আমিও ওঁকে পিসেমশাই বলে ডাকতে শুরু করে দিলাম। ওরপর বহুবার ওঁর বাজনা শোনার সৌভাগ্য হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে টিকিট না কেটে। একেবারে মঞ্চে বসে। মা ও মেজমামার আর এক পরিচিত ছিলেন বিমান ঘোষ যিনি আকাশবাণীর স্টেশন ডিরেক্টর ছিলেন এবং অবসর নেওয়ার পর এইচএমভি-তে যোগ দেন। ওঁর বদান্যতায় আমি যে শুধু বিনা টিকিটে রবিশঙ্করজির বহু অনুষ্ঠান শুনেছি তাইই নয়, বিমানবাবুই প্রথম আমাকে রবিশঙ্করজির কাছে নিয়ে যান। রবিশঙ্কর অত্যন্ত পর্যবেক্ষণশীল মানুষ ছিলেন। প্রথম সাক্ষাতেই উনি যেভাবে আমার দিকে তাকিয়েছিলেন, তা আমি আজও ভুলতে পারি নি। গোড়ার দিকে ওঁর কাছে গেলে একদমই কথা বলতাম না। প্রণাম সেরে চুপ করে খানিক্ষণ বসে থেকে চলে আসতাম। কথা বলার প্রথম সুযোগ পেলাম ১৯৮২ সালে যখন আমার আর এক গুরু আশীষ খাঁ আমাকে নিয়ে গেলেন ওঁর কাছে। সেই সময় উনি উঠতেন এলগিন রোডে রঞ্জন সেনেদের জাহাজ বাড়িতে (এখন যার পাশেই ফোরাম মল)। সেই বছর ৪ঠা ফেব্রুয়ারি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় বাবা আলাউদ্দিন খাঁঁ সাহেবকে নিয়ে দু’দিনব্যাপী আলোচনাসভার আয়োজন করেছিল। রবিশঙ্কর সেখানে এক দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়েছিলেন ‘ভারতীয় সঙ্গীতে আলাউদ্দিন খাঁঁ সাহেবের অবদান’ নিয়ে। আশীষদা সেদিনের অনুষ্ঠানে সরোদ বাজান। তাঁকে তবলায় সঙ্গত করেন স্বপন চৌধুরী। রবিশঙ্করজি যেহেতু ওঁর দাদা উদয়শঙ্করের দলে থাকার সূত্রে ছোট থেকেই প্রায় বিদেশে মানুষ, উনি সব ব্যাপারে খুব স্ট্রাকচারড এবং ডিসিপ্লিনড ছিলেন। পরবর্তীকালে এই ডিসিপ্লিন ওঁর বাজনাতেও প্রতিফলিত হয়েছিল। এই বক্তৃতার দিন উনি আশীষদাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন বক্তৃতাটা কী ভাবে সাজাবেন তা আলোচনা করতে।
ওঁর ছাত্র কিশোর ঘোষ ওরফে বাবুদা আমাকে বিদেশ থেকে একটা সোনালি ব্রেসলেট এনে দিয়েছিলেন যেটা আমি হাতে পরেই থাকতাম। ওই বক্তৃতার দিন আশীষদার সঙ্গে ওঁর কাছে গেছি। প্রণাম করে যেই বসতে যাব, আমাকে বললেন “কী, খুব বিদেশ যাওয়া হচ্ছে বুঝি আজকাল?” হঠাৎ এমন প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। বিনয়ের সঙ্গে জানালাম যে সে অর্থে বিদেশ বলতে আমি শুধু আমার গুরু আলি আকবরের সঙ্গে একবার বাংলাদেশ গিয়েছি, তাও বছর তিনেক আগে। তাপপর আর কিছু বলেননি। এরপর ওঁরা বেশ খানিক্ষণ বক্তৃতার কাঠামো নিয়ে আলোচনা করলেন। আলোচনার শেষে হঠাৎ আমাকে উনি জিজ্ঞাসা করলেন “তোমার কী মনে হয় বক্তৃতাটা ঠিক আছে না আরও কিছু বলতে হবে?” ইতিমধ্যে আমি কিছুটা সাহস পেয়েছি। তাই সাহস করেই ওঁকে কয়েকটা তথ্য দিয়ে বললাম, সেগুলোর ওপর আর একটু জোর দিলে বাবা আলাউদ্দিন খাঁঁ সাহেবের অবদানের আরও কয়েকটা দিক খুলে যাবে। ভেবেছিলাম আমার ধৃষ্টতায় বিরক্ত হয়ে ঘর থেকে বের করে দেবেন। তা তো করলেনই না, উল্টে আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে জানতে চাইলেন “যেগুলোর কথা তুমি আমাকে বললে তা কি তোমার শোনা কথা, না তুমি সেগুলো শিখেছ?” আমি সেসব শিখেছি শুনে আরও খুশি হয়েছিলেন। বলা বাহুল্য, সেদিনের বক্তৃতা অসাধারণ হয়েছিল। বক্তৃতার মাঝে উনি গান গেয়েছিলেন, যার সঙ্গে আশীষদা সরোদ বাজান। সেই রেকর্ডিং আমার কাছে আজও সযত্নে রাখা আছে।

কয়েকবার ওঁর রেওয়াজ শোনার সৌভাগ্য-ও হয়েছিল। অনুষ্ঠানের মতই উনি রেওয়াজও করতেন ধূপ জ্বেলে, দু’পাশে তানপুরা বাদক রেখে এবং সম্ভব হলে কয়েকজন শ্রোতার উপস্থিতিতে। নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায় মারা যাবার পর শান্তিনিকেতনে পূরবী কল্যাণ বাজিয়েছিলেন যে সন্ধ্যায়, তার আগের দিন ভূদেবশঙ্করের শান্তিনিকেতনের বাড়িতে বাজিয়েছিলেন দেবগান্ধার রাগ। সে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা। জাহাজ বাড়িতেও কয়েকবার ওঁর রেওয়াজ শুনেছি। যতবারই শুনেছি, কিছু না কিছু শিখেছি।
আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে আমি কলকাতার দুই বিখ্যাত দৈনিক পত্রিকার সঙ্গীত সমালোচক হিসেবে যুক্ত হই। সেই সময় একবার আমি ওঁর সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলাম। সাক্ষাৎকারের জন্য সাতাশটা প্রশ্ন নিয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু তার অনেকগুলোর উত্তর দিতে উনি রাজি হননি। ফলে সাক্ষাৎকারটা আর নেওয়া হয়নি। আসলে ওর মধ্যে বেশ কয়েকটা বিতর্কিত প্রশ্ন ছিল, তাই হয়তো রাজি হননি।
১৯৮৮ সালের ২৩শে জানুয়ারি সকালে বালিগঞ্জ পার্কে লালা শ্রীধরের বাড়িতে ওঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তার আগেরদিন ডোভার লেনে ওঁর নিজের সৃষ্টি করা রাগ চারুকোষ বাজিয়েছিলেন। ওই রাগটা সম্বন্ধেই আরও বিস্তারিত জানতে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি উনি কোথাও একটা বেরোচ্ছেন। আমার সঙ্গে করিডরে দেখা। আমাকে দেখেই বললেন, “কি, কাগজ পেন আছে?” তারপর নিজে হাতে ইংরেজিতে রাগটার স্বরলিপি লিখে সই করে দিলেন।
রাগ চারুকোষের স্বরলিপি
উনি একটা সময় আমার গুরু আলি আকবরের আমেরিকার কলেজে অধ্যাপনা করতেন। তখন সেখানে তবলা শেখাতেন শঙ্কর ঘোষ এবং গান শেখাতেন তাঁর স্ত্রী সংযুক্তা ঘোষ। সংযুক্তা বৌদি ওঁর কাছে কিছু গানও শিখেছিলেন। তার মধ্যে ওঁর তৈরি রাগ পরমেশ্বরীতে বাঁধা একটা গান উনি সংযুক্তা বৌদির খাতায় লিখে দেন। আমি এইসব সংগ্রহ করি জেনে বৌদি আমাকে খাতাটা দিয়ে দেন।
রবিশঙ্করজির তীক্ষ্ণ বুদ্ধি আর প্রখর স্মৃতিশক্তির কথা সর্বজনবিদিত। কিন্তু কেন জানি না আমাকে দেখলেই বলতেন “রবাব ঠিক করে বাজাচ্ছ তো? ভালো করে বাজাও, এইসব যন্ত্র আজকাল আর কেউ বাজায় না।“ শুনে আমি অনুপ্রাণিত হতাম ঠিকই কিন্তু আমি যে রবাব বাজাই না, সুরশৃঙ্গার বাজাই, সে কথা আর ওঁকে বলে উঠতে পারিনি।

শেষবার দেখা হয়েছিল মারা যাবার পাঁচ ছ’বছর আগে, যে বার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে সাড়ে দশ মাত্রার হামীর কল্যাণ রাগ বাজিয়েছিলেন মেয়ে অনুষ্কাকে সঙ্গে নিয়ে। অনুষ্ঠানের পরের দিন কলকাতার এক পাঁচতারা হোটেলে দেখা করতে গিয়েছিলাম। সঙ্গে ছিলেন আর এক সেতারী সুব্রত রায়চৌধুরী। তখন শরীরটা ভেঙে গেছে। প্রণাম করে কয়েকটা কথা বলেই চলে এসেছিলাম।
রবিশঙ্করজির কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি এবং অনেক কিছু পেয়েওছি। ওঁর লেখা এবং ওঁর সম্বন্ধে লেখা যত বই আমার সংগ্রহে আছে তার সবকটাতেই সই করে দিয়েছেন। তবে ওঁর কাছ থেকে আমার যেটা সবথেকে বড় প্রাপ্তি, যে দিনের জন্য আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকব, তা আমার জীবনে আসে ১৯৯৬ সালে। গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অফ কালচারে ‘চর্চা’ নামক এক বক্তৃতায় মেয়ে অনুষ্কাকে নিয়ে এক বক্তৃতা দিয়েছিলেন। বক্তৃতার মাঝখানে কোনও এক সঙ্গীতজ্ঞের নাম উনি মনে করতে পারছিলেন না। দর্শকের আসন থেকে আমি ওঁকে নামটা মনে করিয়ে দিই। উনি মঞ্চে বসেই আমাকে ধন্যবাদ জানান এবং পরে সেদিন রাতের খাবার টেবিলে একপাশে স্বামী লোকেশ্বরানন্দ আর অন্যপাশে আমাকে নিয়ে খেতে বসেন। যদিও ওঁর পাশে আসলে অনুষ্কারই বসার কথা ছিল। কিন্তু অনুষ্কাকে সরিয়ে আমাকে বসান। তার আগে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেন, “আলুভাইয়ের ছাত্র, who saved me tonight”। সেদিন আমরা অনেক্ষণ সঙ্গীত নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। আমার জীবনকে এভাবে ছুঁয়ে থেকে আমাকে সমৃদ্ধ করার জন্য আমি ওঁর কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকব। শতবর্ষে ওঁকে আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম।
সরোদবাদক পণ্ডিত অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার তথা ভারতের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জগতে পরিচিত নাম। সঙ্গীতচর্চার পাশাপাশি চলে পড়াশোনা ও লেখালেখি। 'আপনাদের সেবায়', 'প্রসঙ্গ ঠুমরি', 'সুরের গুরু' ওঁর কিছু জনপ্রিয় বই। সরোদচর্চার পাশাপাশি নিয়মিত অভিনয় করেন বাংলা ছবিতে।
Excellent
কী শ্রদ্ধা আর আবেগ মেশানো তর্পণ, অনিন্দ্য। খুব ভাল। এই সংগ্রহের প্রদর্শণী হোক এই অপেক্ষা।
দীর্ঘদিন ধরে পন্ডিত রবি শংকর কে কাছ থেকে দেখা এবং সাঙ্গীতিক ভাবনাচিন্তা দিয়ে ওনার কর্ম জীবন পর্যালোচনা করার মত মানুষ দের মধ্যে আপনি অন্যতম । আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ।