আজ যখন সমস্ত পৃথিবী বন্ধ দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে দরজার ওপারে ভয়াল দৈত্যের প্রতিধ্বনি শুনছে, তখন আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই আর এক নৃশংস রাক্ষসের কথা, যে একশো বছর আগে পৃথিবীতে এসেছিল এবং মাত্র এক বছর সময়কালে এমন তাণ্ডব করেছিল যে আশি বছর পরেও এই স্বল্পসময়ব্যাপী অতিমারীকে গবেষকরা পরিচয় দিয়েছেন “The greatest pandemic in world’s history”। হ্যাঁ সেই বিভীষিকার নাম স্প্যানিশ ফ্লু বা যুদ্ধজ্বর। ডিসেম্বর ২০১৯-এ শুরু হওয়া কোভিড-১৯-এ আজ এখনও পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা সারা বিশ্বে ৩ লক্ষ ৯৪ হাজার ৬০৫ জন, মৃত ১৭২২৬। অর্থাৎ গত চার মাসে বিশ্বের জনসংখ্যার ০.০০০২ শতাংশ করোনাভাইরাসের প্রকোপে প্রাণ হারিয়েছেন। যুদ্ধজ্বর তার বছর দেড়েকের দৌরাত্ম্যকালে ৫০ কোটি লোককে রোগশয্যায় ফেলেছিল, মারা গিয়েছিল ২.১ কোটির কিছু বেশি লোক, যা কিনা তৎকালীন বিশ্বজনসংখ্যার ১.১৬%। শুধু তাই নয়, এই অতিমারীর করাল গ্রাসে ভারতে শেষ হয়ে গিয়েছিল প্রায় ১ কোটি ৪০ লক্ষ জীবন। সোজা কথায়, সারা দুনিয়ার নিরিখে কোভিড-১৯ এর তুলনায় মাত্র ৫৮০০ গুণ ভয়াবহ স্প্যানিশ ফ্লু।

আসুন, এই মানবসভ্যতার অভিশাপটির ঠিকুজিকুষ্ঠী জেনে নিই।

১৯১৭ সালের ডিসেম্বর মাস। সারা দুনিয়া জুড়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তার করাল নখদাঁত নিয়ে ছুটে চলেছে। মিত্রশক্তি জার্মান অক্ষশক্তির কাছে মার খেতে খেতে সবে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। আমেরিকা রণাঙ্গণে প্রবেশ করার পর যুদ্ধের ভারসাম্য মিত্রশক্তির দিকে ঝুঁকে পড়েছে – তা মেসোপটেমিয়া ক্যাম্পেন আর ইপ্রেসের দ্বিতীয় যুদ্ধ থেকে পরিষ্কার হচ্ছে। এমন সময় কানসাস আর ব্রিটেনের সেনাছাউনিতে সেনাবাহিনীর চিকিৎসকেরা দেখলেন এক ধরনের অজানা জ্বর ও শ্বাসকষ্টে বহু সৈনিক মারা যাচ্ছে। সেই হল স্প্যানিশ ফ্লুয়ের সূত্রপাত।

মিত্রশক্তি তখন জয়ের মুখ দেখতে শুরু করেছে। এমন সময় কালান্তক মহামারীর খবর ছড়িয়ে পড়লে যুদ্ধরত সেনাদের মনোবল ভেঙে যাবে – এই ভয়ে ফ্রান্স, ব্রিটেন ও আমেরিকার রাষ্ট্রপ্রধানরা মারণরোগের খবর সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হতে দিলেন না। এদিকে যুদ্ধে কোনও পক্ষ অবলম্বন না-করা স্পেনেও ছড়িয়ে পড়ল মহামারী। শয্যাশায়ী হলেন সম্রাট ত্রয়োদশ আলফানসোও। নির্দলীয় স্পেনে সংবাদমাধ্যমের ওপর কোনও নিষেধাজ্ঞা ছিল না। তাই স্পেনের মাধ্যমেই দুনিয়া শুনতে পেল কাল-পদধ্বনি। ১৯১৮-১৯ সালে এই ইনফ্লুয়েঞ্জা অতিমারীর নামকরণ হল স্প্যানিশ ফ্লু। আর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তার অজস্র বিষাক্ত ক্ষতের সঙ্গে সঙ্গে ভারতে নিয়ে এল আর এক গ্যাংগ্রিন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের পক্ষে প্রায় সাড়ে নয় লক্ষ ভারতীয় সেনা এবং দু লক্ষ বিশ হাজার ভারতে বসবাসকারী ইংরেজকে মেসোপটেমিয়া, ফ্রান্স, মিশর, পূর্ব আফ্রিকা, পারস্য ও গালিপোলিতে পাঠানো হয়েছিল। তৎকালীন যুদ্ধশিবিরের অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতি, প্রায় অসম্ভব পৃথকীকরণ ব্যবস্থা ও চিকিৎসার অভাবে ফ্লু আক্রান্ত ইংরেজ, আমেরিকান ও ফরাসি সেনাদের থেকে ভারতীয় সেনাদের মধ্যে যুদ্ধজ্বর ছড়িয়ে পড়ে। যার ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাপ্ত আঘাতে মৃত ভারতীয় সেনার সংখ্যা যেখানে ছিল সতেরো হাজার, সেখানে চব্বিশ হাজার সামরিক কর্মী ফ্লু-তে মারা যান। সফল মেসোপটেমিয়া ক্যাম্পেনের পর এ রকমই কিছু অসুস্থ ও অন্যান্য সেনানীদের নিয়ে কিছু জাহাজ ইরাকের বসরা থেকে বোম্বাই ও করাচি বন্দরে পৌঁছয় ১৯১৮ সালের মে-জুন মাসে। করাচি ও বোম্বাইয়ের সেনাবন্দরগুলিতে তখন সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্তিকরণের জন্য প্রচুর জনসমাগম। অসুস্থ সেনাদের থেকে সেই জনতার মধ্যে দাবানলের মতো ফ্লু ছড়িয়ে পড়ে। এবং বন্দর থেকে শহরে ও গ্রামে ছড়িয়ে পড়তে থাকে মারণ মহামারী।

ভারতে যুদ্ধজ্বর তার প্রাদুর্ভাব বিস্তার করে দুটি ধাক্কায়। প্রথম ধাক্কায় জুন জুলাই মাসে এর প্রভাব ছিল মূলত পশ্চিম ভারতে সীমাবদ্ধ। অল্পসংখ্যক শিশু ও বৃদ্ধের মৃত্যুর পর এর প্রকোপ কমে আসে। অনেকেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। কিন্তু মানুষের আপাত আশায় জল ঢেলে সহস্রগুণ বিভীষিকা হয়ে সেপ্টেম্বরে ফিরে আসে সেই মারণজ্বর। এই দ্বিতীয় ধাক্কা প্রায় চারমাস স্থায়ী হয় এবং এই চারমাসে সমগ্র ভারতের জীনবযাত্রা স্তব্ধ করে দেয়। এই দ্বিতীয় ধাক্কায় মূলত আক্রান্ত হতে থাকে কুড়ি থেকে চল্লিশের মধ্যে বয়সি তরুণ প্রজন্ম, বিশেষত মহিলারা। অক্টোবরের মধ্যে অবস্থা এক মারাত্মক হয়ে ওঠে যে প্রশাসন, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও চিকিৎসাব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়ে। সরকারি মৃত্যু নিবন্ধীকরণ খাতা থেকে জানা যায় কেবলমাত্র ৬ অক্টোবর ১৯১৮ তারিখে বোম্বাই শহরেই মৃত্যু হয় ৭৬৮ জনের। পঞ্জাবে গাঁয়ের পর গাঁ উজাড় হয়ে যেতে থাকে। তিনমাসে অবিভক্ত পঞ্জাব প্রদেশে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৯,৬২,৪৩৭ জন। অসহায় পঞ্জাবের স্যানিটরি ইন্সপেক্টর তাঁর বিবরণীতে লেখেন – হাসপাতালগুলি অমন গাদাগাদিভাবে ভর্তি যে দ্রুত মৃতদেহ বের করে সে জায়গায় গুরুতর অসুস্থদের রাখা হবে তার উপায় নেই। রাস্তাঘাটে অসংখ্য পচাগলা মৃতদেহ পড়ে, সৎকার করার লোক নেই। ডাক ও তার ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। চিকিৎসাব্যবস্থার নাভিশ্বাস উঠেছে। অর্ধেকের বেশি জরুরীবিভাগের কর্মী অসুস্থ। প্রশাসন অসহায়। প্রায় প্রত্যেক ঘর থেকে শোকাকুলের আর্তনাদ ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছে না। অবিশ্বাস্য ব্যাপার এই যে, এরকম অভূতপূর্ব মৃত্যুমিছিলের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ ও বিশ্লেষণ প্রায় কোনও কেন্দ্রীয় গেজেটেই নেই। রাজ্যস্তরীয় কর্মচারীদের বিবরণ ঘেঁটেই এসব তথ্য উঠে আসে। আর পাওয়া যায় জলন্ধরের এক অকুতোভয় চিকিৎসক থমাস হ্যারিয়েটের থিসিসে। হ্যারিয়েট নিজের জীবন বাজি রেখে প্রায় দুই শতাধিক স্প্যানিশ ফ্লুয়ের রোগীর চিকিৎসা করেন এবং তার বিবরণ লিপিবদ্ধ করে যান। রোগীদের ক্রবর্ধমান জ্বর, শ্বাসকষ্ট, এবং মুখ ও নাক বেগুনি হয়ে গিয়ে (সম্ভবত সেন্ট্রাল হাইপক্সিয়া বা শরীরে অক্সিজেনের অভাবের কারণে) দু থেকে তিন দিনের মধ্যে মৃত্যুমুখে পতন – এই বর্ণনা হ্যারিয়েটের থিসিসই জানায়। ভারতে সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে যে প্রদেশ তার নাম সেন্ট্রাল প্রভিন্স (আজকের মধ্যপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্রের কিছু অংশ)। সেন্ট্রাল প্রভিন্সে ন লক্ষ পঁচিশ হাজার মানুষ (জনসংখ্য়ার সাত শতাংশ) যুদ্ধজ্বরে উজাড় হয়ে যায়। বোম্বে প্রেসিডেন্সি ও মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে যুদ্ধজ্বর চার মাসে কেড়ে নেয় যথাক্রমে দশ লক্ষ ষাট হাজার ও ছ লক্ষ বিরাশি হাজার প্রাণ। স্প্যানিশ ফ্লুয়ের কালগ্রাস সবথেকে কম পড়েছিল বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে। সেখানকার নিহতের সংখ্যা শুনলেও আজকের পাঠক হিম হয়ে যাবেন – ৩,৮৬,৫৭২ (তিন লক্ষ ছিয়াশি হাজার পাঁচশ বাহাত্তর) জন। ১৯১৭ সালে কলকাতা শহরে প্রতি হাজার জন পিছু মৃত্যুহার ছিল ২৩, ১৯১৮-এর শেষে তা গিয়ে দাঁড়ায় ৩৫-এ। কলকাতা হাইকোর্ট এবং অন্যান্য সব সরকারি কার্যালয় দুমাসের জন্য হয়ে যায় কারণ অর্ধেকের বেশি কর্মচারী হাসপাতালে বা শেষযাত্রায় ছিলেন। প্লেগ কিংবা কলেরা যা কুড়ি বছরে করতে পারেনি, স্প্যানিশ ফ্লু এসে চার মাসে তা করে দেয়। এবং ধূমকেতুর মতই ১৯১৯-এর শুরু থেকে হঠাৎ উধাও হয়ে যায়। শুধু ভারত তথা পৃথিবীর বুকে রেখে যায় দগদগে ক্ষত। পাঠক, আগেই বলেছি যুদ্ধজ্বর দুনিয়া থেকে ২.১ কোটি মানুষকে মুছে দিয়েছিল – প্রথম বিশ্বযুদ্ধও যা পারেনি (২ কোটিতে থেমে গেছিল)। মানুষের তৈরি চারবছরব্যাপী যুদ্ধকে মরণখেলায় চার মাসে হারিয়ে দিয়েছিল ছোট্ট একটা ভাইরাস। আর শুধু ভারতের এক কোটি চল্লিশ লক্ষ লোক নয়, সে ভাইরাস চলে যাবার পরেও কেড়েছিল আরও অন্তত ১২৫ জনের প্রাণ। কীভাবে? এডওয়ার্ড জেমস করবেটের কলমে বিখ্যাত লেপার্ড অফ রুদ্রপ্রয়াগ দেখে নিই একটু – 

১৯১৮ সালের যে ইন্ফ্লুয়েঞ্জা মহামারী ভারতে কয়েক লক্ষ জীবন নিয়েছিল, গাড়ওয়াল অঞ্চলও তার হাত থেকে নিস্তার পায়নি। এই মহামারীর শেষেই গাড়ওয়ালে প্রথম মানুষখেকোর দেখা পাওয়া যায়।“ 

অতিমারীতে সৎকার না হওয়া মৃতদেহ খেয়ে নরমাংসের স্বাদ চিনেছিল ক্ষুদ্রতর শয়তানটি। 

কেন মহাপ্রলয়ের রূপ নিয়েছিল স্প্যানিশ ফ্লু। ১৯১১ সালের ৭.৪ শতাংশ জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারকে ১৯২১-এ এক ধাক্কায় ১.২ শতাংশে নামিয়ে দেওয়া এই কালরোগের বিস্তারের কারণ কী? কারণ অজস্র – প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, যুদ্ধকালীন সংবাদ গোপন, যুদ্ধকালীন অভাবজনিত মানুষের অপুষ্টি, ভাইরাস সম্পর্কে অজ্ঞানতা, স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে মানুষের অসচতেনতা ইত্যাদি। আজ আমরা ভাইরোলজি সম্পর্কে অলেক বেশি জানি, বিজ্ঞান এগিয়েও গেছে, যুদ্ধও হচ্ছে না – অথচ COVID-19 ইতালি, স্পেন, আমেরিকাকে মৃত্যু উপত্যকা বানাচ্ছে। ভারতও যোগ দিয়েছে মৃত্যুমিছিলে। কেন? আমরা স্বাস্থ্যবিধি মানছি তো। বিশ্বস্বাস্থ্যদপ্তর নিতান্ত প্রয়োজন না হলে ঘর থেকে বেরতে বারণ করছেন। আমরা মাস্ক পরে চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছি আর কুড়ি টাকার খাদির মাস্ক নামিয়ে চায়ে চুমুক দিচ্ছি। মজা করেই বলি, ১৯১৮ অতিমারীর সময় লেখা পলাতকা কাব্যগ্রন্থে কবিগুরু লিখেছিলেন – আমার ঘরে ছুটির বন্যা / তোমার লাফে-ঝাঁপে / কাজকর্ম হিসাবকিতাব থরথরিয়ে কাঁপে। দেখেছেন তো, গুরুদেবও আপনাদের ঘরে ছুটি কাটাতে বলছেন। ওরে আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে। আর যদি তা না করেন তাহলে একশ দু বছর আগেকার ঘটনার যে পুনরবৃত্তি হবে না, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। সে ঘটনা কীরকম বীভৎস জানেন? মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর বড় ছেলেহরিলালের স্ত্রী গুলাব পঁচিশ বছর বয়সে ১৯১৮-এর যুদ্ধজ্বরে মারা যান। খবর পেয়ে গান্ধীজি হরিলালকে চিঠি লেখেন – “শুনলাম গুলাব আর নেই। কিন্তু চারপাশ থেকে ক্রমাগত এত মৃত্যুসংবাদ পাচ্ছি, সত্যি বলছি, কোনও মৃত্যুই আর আলাদা করে মনে দাগ কাটে না।“ 

সূত্র:

  1. Death and the Modern Empire – David Arnold
  2. Mortality from the Influenza Pandemic of 1918-19 – S Chandra 
  3. The evolution of pandemic influenza – Siddharth Chandra and Kassens-Noor 
  4. Indian Army and the First World War – Kaushik Roy
  5. The influenza of 1918 – Philips Killingray

নিবাস ভট্টপল্লী। পেশা ডাক্তারি। নেশা নানাবিধ। শখ ভ্রমণ। দুর্বলতা ফুটবল। ঘাঁটতে ভালোবাসেন ইতিহাস।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *