ফাঁদ যেমন অনেক রকম হয়, ফাঁকও ঠিক তাই। গলে পালানো বা গলিয়ে দেবার জম্পেশ সব ব্যবস্থা। এই যেমন চালুনি, সাঞ্চা বা ছুঁচ। এসব ইচ্ছে করে রাখা ফাঁক, কাজের সুবিধের জন্যে। যেমন এক ফাঁকে রোদে মেলা কাপড়গুলো তুলে রাখা, বা টুক করে পুকুরে গিয়ে তিন ডুবে স্নান সারা, বা আচারের শিশিগুলোর এ পিঠটা ঘুরিয়ে রোদ্দুরে ওপিঠ করে দেওয়া; এই মোচাক’টা কেটে রাখি, বা সরষেগুলো ঝেড়ে রাখি বা ছোট্ট করে পান সেজে, এক খিলি গালে ঠুসি। এসব ফাঁকে ছাড় চলবে। কারণ তা কাজেরই আগু বা পিছু। কিন্তু মন উসখুস বা চুলবুল বা উদাস-বিহ্বল মানেই হয়ে গেল। শুরু হবে বাক্যবাণ। সেই কারণে কাজে ফাঁক মানেই, ফাঁকি আর অঘটন। আবার এক কাজের ফাঁকে অন্য কাজ বা টানা কোনও কাজের ফাঁকে ফাঁকে আর একটা টানা কাজ শেষ করে ফেলা, সে বড় বাহাদুরি বটে।

আমার দিদিমা যেমন রান্নার ফাঁকে ফাঁকে বাগান করে আসতেন, লোহার হাতাখুন্তির ডাঁটি দিয়ে গাছের গোড়া উসকে দিয়ে। তাঁর হাতের রান্নার সুখ্যাতি হলেও এই আগান-বাগান ঢোঁড়া নিয়ে বেশ অসন্তোষ ছিল বাকিদের। বাগানটাই যেন ছিল তাঁর শ্যামের বাঁশি। গিন্নিরা এসব খুব বিচার করতেন। হালের গিন্নিরাও তাই– ‘No time dear,  পর পর সব set হয়ে আছে।’ তবে সেকেলে হেঁসেল-গিন্নিরা যে ধমকে বলতেন, ‘ফাঁক খুঁজো না তো বাছা’, সে কিন্তু একেবারেই অন্য ব্যাপার। সার্বজনীন সময় থেকে একটু ‘me time’.. আর তাতেই শোরগোল। তা হতে পারে কাঁঠাল তলায় একটু ফুসফুস, বা পুকুরপাড়ের লেবুগাছ থেকে লেবু আনতে গিয়ে একটু বেশি সময় লাগা, বা এঁটো হাতে গপ্পো ফেঁদে বসা, বরের গলাখাঁকারি শুনে ছুতো করে শোবার ঘরে এসে একটু ছুটকো আদর-আহ্লাদ। কিন্তু গিন্নিরা এমন তদারকি করতেন যে মাছি গলবারও উপায় থাকত না। মেয়ে-বউ-যোগাড়েরা একটু চোখের আড়াল হলেই, ‘কোথায়-কোথায়’ হাঁক আর মন্তব্য। সময়ের ফাঁক বইবার জো নেই। উনুনে আঁচ বয়ে যাবে, বেলা বয়ে যাবে, শরীর বয়ে যাবে।

তবু মাঝে মাঝেই বজ্র আঁটুনিতেও ফস্কা গেরো হয়েই যেত। সেই ফাঁকে মশা কেন, হাতিও গলে যেত। এর সমাধানে কখনও তাই হৈচৈ-শোরগোল, আবার কখনও বা ফিসফিস, চুপচুপ-গুবগুব। এই ফাঁকের ঝক্কি মানেই, একরাশ জবাবদিহি বা কথা বন্ধ। আমার এক আদরের মাসিমা বলেছিলেন, ‘সংসারে show cause হয় না বাপু, যেটা হয় তা হল অভিমান।’ তো ফাঁক মেরামতির বিস্তর সুতো, নানা মাপের ছুঁচ এবং ফোঁড়ও ছিল। আবার মেরামতির অযোগ্য হলে, একেবারে বাতিল, এমন কি ‘ত্যাজ্য।’ আর সেই ‘ত্যাজ্য’কেও আবার অনেক সময় বুকে টেনে নিত এই হেঁসেলই। লুকিয়ে একটু এটাসেটা পাঠানো, ‘ত্যাজ্যে’র কথা ভেবে, পছন্দের খাবারটা নীরবে ত্যাগ করে আঁচলের খুঁটে দু’চোখের ভিজে পাতা মোছা, সারাটা জীবন গুম মেরে কাটানো– এই আর কী! হেঁসেলপনাও যেমন ছিল পাঁচমিশেলি মনের নিবিড় যাপন, ফাঁকগুলোও তেমন নানাবিধ। একটা দিয়ে অন্যটার সমাধান হত না। তাই চেষ্টা থাকত, চরম ফাঁক বইবার আগেই সতর্ক হয়ে যাওয়া। না হলে কেচ্ছা কেলেঙ্কারির থেকেও বড় হয়ে দেখা দিত নিদারুণ দুঃখ আর বিচ্ছেদ। এমনকি মর্মান্তিক অকাল মৃত্যুও।

ফাঁকের সঙ্গে সঙ্গে ফোকরও ছিল এক বড় দায়। আর কত যে বিচিত্র তার ধরন এবং গড়ন। পিঁপড়ে থেকে মানুষ, সকলেরই পছন্দের জায়গা হল ‘চাই কী-নাই কী’র এই হেঁসেলখানি। সেকালে, যাদের সত্যি সত্যি রান্নাঘর থাকত তারা ধনী। এখনকার মতো তখনও বিত্তহীন এবং নিম্নবিত্ত মানুষদের রান্না হতো ঘরের সামনে চাল ঢাকা দাওয়ায়। মধ্যবিত্তদের নামে মাত্র রান্নাঘর থাকলেও তার গাঁথনি খুব পোক্ত হত না। সিমেন্টের মেঝে, চুনকাম করা ইট গাঁথা, সুরকি-বালি আর মাটির দেওয়াল এবং টিনের বা খুব বেশি হলে টালির ছাদ। তাই নানা ফোকরের সুবিধা পেয়ে কে না থাকতো সেখানে! পিঁপড়ের সার ধরে যেতে যেতে অব্যর্থ নিক্ষেপে পাওয়া যেত তাদের আসল বাসাটি। মাটির দেওয়াল ঝাঁঝরা করেই তো তাদের হেঁসেলপনা। তবে, সে দেওয়ালে ন্যাকড়ায় করে একটু কেরোসিন ঘষে দিলেই তারা আবার সার বেঁধেই পালাত। এ ভাবেই তাড়ানো হতো দেওয়ালে বা মাটিতে উই ধরা। তারা আবার পিঁপড়েদের থেকে এক কাঠি ওপরে। শুধু যে বাসা বানিয়ে থাকবে আর খুঁটে খাবে তা তো নয়! সব কিছু কেটে কুটে থসথসে করে দিয়ে তবে ছাড়বে। পিঁপড়ের করা ফোকর ভাঙলে বালি বালি মিহি ধুলো বেরিয়ে আসবে, কিন্তু উই ফোকরে দেওয়ালটাই খুলে আসবে ঝুর ঝুর করে। সেখানে তখন বালি আর মাটি মিশিয়ে পুলটিস ঠাসা হলেও, অন্য দেওয়ালে যে উইয়ের ফোকর নেই এমন আশঙ্কা থেকেই যেত। ভিটেতে ঘুঘু চরা আর দেওয়ালে উইয়ের ফোকর মানেই সব গেল।

আর রান্নাঘরের একোণ ওকোণে ঝুল মানেই মাকড়শার জাল বেড়েছে। কিন্তু হলদেটে সাদা রঙের দেওয়ালে মাকড়দের নিপুণ বসবাসে সবাই বেশ অভ্যস্ত ছিল। মাঝে মাঝে তাতে আবার চামচিকে আটকে গিয়ে ঝুলের মতোই ঝুলত। গিন্নি-ভেদে সে সব পরিষ্কার হত। কারও বছরে একবার, কারও মাসে মাসে, কারও বা দেখামাত্রই। তবে আরশোলা-মুক্ত রান্নাঘর যে হয়, সে কেউ ভাবতেও পারত না। মরচে ডানার গুল্লি গুল্লি কালো চোখের আরশোলারা ছানাপোনা নিয়ে মহাসুখে বেশ দল বেঁধেই থাকত। এমনকি বস্তার জিনিসপত্রের সঙ্গে নানা বাড়িতে ঘোরাঘুরির সুযোগও পেত। আলুর বস্তাগুলোই ছিল তাদের সবচেয়ে বড় ঠেক। রান্নাঘরের তাকে বড় কিছু সরানো মানেই, তার নিচ থেকে পিলপিল করে বেরিয়ে এদিক ওদিক ছুটে আবার কোথাও সেঁধিয়ে ঘাপটি মেরে থাকবে।

কিন্তু আরশোলা বা মাকড়ের বসবাসে কোনও ফোকর হত না। শুধু এক অন্য প্রজাতি, যারা বেশ ঠাঁই জুড়েই থাকত। তবে আরশোলার খোলসে আর খোলস ছাড়া সাদা আরশোলায় সকলেরই খুব ঘেন্না ছিল। সে সব রান্নাঘরের মেঝেতে চোখে পড়লেই ‘ম্যাগো, ম্যাগো’। আরশোলা নিধনের একমাত্র ভরসা ছিল টিকটিকি। কপাকপ খেয়ে ফেলত। টিকটিকির গ্রাসে আরশোলার ফরফরানি দেখে টিকটিকিদের যথার্থ বীর এবং শিকারি বলেই আমার অন্তত মনে হতো। টিকটিকি নিধন তাই গিন্নিদের এজেন্ডায় থাকতো না। কারণ, টিকটিকিরাও ফোকর বা ঝাঁঝরা কোনওটাই করতো না। তবে ডিম পাড়বার জন্যে তো ফোকর খুঁজত বটেই। সে সব মেলা মিলতও। জানলা-দরজার ফাটা কাঠে, কুলুঙ্গিতে, দেওয়ালের গর্তে।

কিন্তু মেঝেতে বা দেওয়ালে একটু ফাটল মানেই ইঁদুরের চাষ। অতি সতর্কতায় কান খাড়া করে বেরিয়ে এলে, দেখা গেল তো ভাল, না হলে মাটি তুলে তুলে ঘুলঘুলি বানিয়ে দেবে। টিকটিকির ডাকে এক মস্ত ভরসা এই যে, যা কিছু সেই মুহূর্তে বলা হচ্ছে তাতে খাদ নেই। সব সত্যি। কিন্তু ইঁদুরের কিচ কিচ মানেই সঙ্গে দোসর হল ছুঁচোর কেত্তন। ছুঁচো তো নর্দমায়, ধেড়ে ইঁদুর গাছে বা বাগানে, কিন্তু নেংটি ইন্দুর হল হেঁসেলের খাস বাসিন্দা। ওপর থেকে কিচ্ছুটি বোঝা যাবে না। কিন্তু চোখে পড়া ছোট্ট গর্তে শিক বা লাঠি ঢোকালেই তা হলহল করে ঢুকে যাবে। আর সেই ফুটকি ফাঁকই হয়ে যাবে এক মস্ত ফোকর। যতই যা সুরকি-বালি-মাটি দিয়ে মেরামত করা যাক না কেন, ইঁদুরে করা ফোকর একেবারে পাকাপাকি আর সমস্ত মেরামতির অতীত। একেবারে পাতাল অবধি কাটা ব্রিটিশ সুড়ঙ্গ। খুব কম বাড়িতেই ইঁদুর মারার কলে ইঁদুর ধরা হত বা ময়দার গুলিতে তুঁতের বিষ মিশিয়ে ছড়িয়ে রাখা হতো। কিছু লোভী এবং অসাবধানী ইঁদুর টোপ গিললেও বেশির ভাগই পাশ কাটিয়ে পালাত। আর এ ব্যাপারে গ্রাম, শহর বা মফস্বল সব ইঁদুরের এক রা। সকলেই গুপ্ত ফোকর খুঁড়তে দারুণ দড় আর তা যেখানে সেখানে।

তো ইঁদুরের ফোকরে বাড়ির মানুষরা তেমন সুবিধে করতে না পারলেও পোষা মেনির কিন্তু চোখ এড়াতো না। ঘটি বাটি উল্টে সে তাড়া করত। ইঁদুর বেড়ালের সেই চোর পুলিশ খেলা জমে উঠত ভারী রাতে, ঘরেদোরে ঘুম জড়িয়ে এলে। আবহসঙ্গীতে তখন কিচ কিচ, টুং টাং আর ‘তবে রে’ বলে খ্যাসখেসে মিয়াঁও। মেনি তো আদুরি কোলের খুকি, তায় ফোকরবিলাসি নয়। কিন্তু মেনির ইঁদুরে যে আর একজন ভাগ বসাত সে হল সাপ। তার তো ঢোকা এবং বেরনো দু’ইই তো ফোকর গলে। লম্বা শরীর নিঃশব্দে টেনে সেও বাসা বাঁধত সুবিধেমতো গর্তে। সে সব গোখরো, না খরিশ, না হেলে, ঢোঁড়া, ঘরচিতি– অত জানিনা। সব সময় যে দেখা মাত্রই তাদের পিটিয়ে মারা হত তা নয়। অনেক বাড়িতেই ছাড় দেওয়া হতো ‘বাস্তু সাপ’ এই ব্যাখ্যায়। বালেশ্বরে আমার ওড়িয়া বন্ধু যশোধরাদিদির সাবেক বাড়িতে এরকম একটি পুরুষ্টু দেখে আমি যাওয়াই বন্ধ করেছি, ভয়ে। সে নাকি আবার সংসারি। তাই বউ এবং ‘ছুয়া পুয়া’ নিয়ে কয়েক প্রজন্ম ধরে আরাম বিছিয়ে থাকে, আর আশে পাশের নানা হেঁসেলে চৌকি দিয়ে বেড়ায়। তবে আমাদের খড়দার রান্নাঘরের আনাচে কানাচে থাকা বেঁজি-গিন্নি এবং কর্তা যখন কোনও সুড়ঙ্গ পথে হেঁসেলে ঢুকে আসত, ঠাকুমা জেঠিমারা বলতেন, “সাপ ঢুকেছে নিশ্চয়ই।” বেজির গর্ত তাই ভাঙা হত না। হেঁসেলের বার-দেওয়ালে তাদের ফোকর-বাস তাই নিশ্চিন্ততা এবং নিরাপত্তা দিত।

সব মেনি যে আদরের তা তো নয়। রান্নাঘরের আশে পাশে ঘুর ঘুর করা হুলোরা তো সাঙ্ঘাতিক। কেঁদো চেহারা নিয়ে এমন দুলকি চালে তার দাওয়া পার হওয়া, যে মনে হতো সে-ই যেন কর্তা! বাজার থেকে আনা সব মাছই তার জন্যেই। বেড়ালের হাত থেকে খাবার বাঁচাতে, লোহার জালের কাঠের বাক্স আর মিটসেফ। কখনও জাওলা শিঙ্গি মাগুর শিলচাপা দিয়ে রাখা। পাতের থেকে একটু দূরে বসে সে কী তাদের গুরু গম্ভীর ম্যাঁও! এই ‘ম্যাঁও’ ধরা যে কী জ্বালা, না-শুনলে বিশ্বাস হবে না। কাঁচা, রাঁধা, বাসি, পচা সবেতেই মুখ দেবে। গোঁফ ডোবানো কি, বেড়ালে শুঁকলেও সে খাবার ফেলা যাবে। আর মওকা মতো চুরি করে খেয়ে যখন সুখে থাবা চাটত গোলাপি জিভখানি বার করে, তখন গা জ্বলা ছাড়া আর উপায় কী! তবে গর্ভিণী বেড়ালকে একটু খাতির করা হত। দূর দূর করে না তাড়িয়ে, থালা কাচানো একমুঠো মাছভাত সে পেত। কুচি কুচি বাচ্চাগুলো নিয়ে সে শুতে পেত নিভু উনুনের পাড়ে। তখন গিন্নিদের কাজ হত হুলো-তাড়ানো, যাতে বাচ্চাগুলো সে খেয়ে না ফেলে। বেড়াল ফোকর বানায় না। তক্কে তক্কে থাকে আর ফাঁক খোঁজে।

কিন্তু বেড়াল জাতীয় আর একজনের হানা ছিল ভয়ঙ্কর। বেঁটে কিন্তু লম্বা। ইয়া বড় ল্যাজ, কুচকুচে কালো লোমে ঢাকা। আর জ্বলন্ত লাল চোখ। তাকে বলা হতো ভাম বা সোরেল বা খটাশ। কী যে বিশ্রি বলবার নয়। আর গায়ে তেমনি গন্ধ। ভাম বেরোয় রাতে। বাগানের ফল-সবজি তো খায়ই, তার সঙ্গে ইঁদুর, পাখি এমনকি খাঁচা হাতড়ে পোষা হাঁসমুরগিও। গেরস্তের হেঁসেলে হানা দিয়ে খেতে সে কিছুই বাকি রাখে না। ছাদ থেকে বেরনো মাটির নল, ঘুলঘুলি, পোড়ো দেওয়ালের ছ্যাঁদা, ছাদের জোড়া তাপ্পিমারা বা ভাঙা টালির ফাঁক, সবেতেই সে টুকুস করে গলে যাবে। এক ছাদ থেকে আর এক ছাদ আনায়াসে লাফিয়ে পার। সরু পাঁচিলেও সাবলীল গতি। আর গাছ থেকে লাফ– সে তো তাদের নিত্য কসরত। না বাধা তার ওই বড়সড় বপু, না আটকাবে তার লম্বা ল্যাজ। এঁটোকাঁটা এমন সাফ করে এবং নিঃশব্দে খাবে যে তার উপস্থিতি বোঝা দায়। তবে গন্ধে বোঝা যাবেই যে রাতে ভাম ঢুকে ছিল। ভামও এই হেঁসেল ঘরের আশপাশেই সপরিবার থাকতো। কিন্তু তাদের বাসা কিছুতেই খুঁজে পাওয়া যেত না। ভামকে মানুষ তো ছাড়, শেয়ালরাও ভয় পেত। একটু দূর থেকে যারা ডাকত তারা নেড়ির দল। এই ভামেরা ফাঁক এবং ফোকর দুইই তৈরি করে নিত সবার অলক্ষ্যে। তারা ছিল লা-জবাব উৎপাত।

এই সব খোঁদল হয়ে যাওয়া ফোকরে সবচেয়ে সুবিধে হতো চোরদের। বিশেষত ইঁদুরের গর্তে। সেখান থেকে তারা সিঁধ কাটত রান্নাঘর এফোঁড় ওফোঁড় করে। সে এক মস্ত পথ। এক মুখে ঢুকে অন্য মুখে বেরনো। চুরির মালপত্র সমেত। আর এই সিঁধ একদিনে কাটত না। কাটত সবার অলক্ষ্যে একটু একটু করে। আর সিঁধের মুখটা এমন করে পাতার জঞ্জালে ঢেকে রাখতো যে বাইরে থেকে বোঝে কার সাধ্য! আমার মামার বাড়িতে ছড়ানো রান্নাঘরে সিঁধ কেটে শুধু বাসন নয়, চালের বস্তা, তেলের টিনও নিয়ে গিয়েছিল চোরে। রান্নাঘরের রক পার করেই প্রবল প্রতাপের ধারক সেই দাদামশায়ের ঘর। পরে দেখা গেল যে সেখানেও চেষ্টা চালিয়েছিল, তবে ছত্রিশ ইঞ্চি দেওয়ালে সুবিধে করতে পারেনি। মামিরা যখন রান্নাঘরে ঢুকে লণ্ডভণ্ড অবস্থা দেখে একেবারে থ এবং কিছুতেই বুঝতে পারছেন না, কোথা থেকে পায়খানার গন্ধ আসছে, তখন দিদিমা এসে বললেন, সিঁধ কেটে সব তো নিয়ে গেছেই, উল্টে জলঢালা বাসি ভাত খেয়ে হাঁড়িতেই ‘কম্ম’ সেরে গেছে। এটা নাকি তাদের সাফল্যের চিহ্ন!

দাদু তো রেগে কাঁই। অপমানিত তো বটেই। দোষ চাপল দিদিমার ঘাড়ে। দিদিমার ওই এখানে ওখানে খুঁচিয়ে গাছ লাগানোতেই নাকি চারিদিক হলহলে হয়ে গেছে। চোরেদের সাফল্যে দিদিমার নির্বিকার হাসি। কারণ ‘বুড়ো’ কেমন জব্দ হয়েছে! তার ফলে হেঁইয়ো বলে সিঁধ বুজিয়ে ওই রান্নাঘরই এমন মজবুত করে দাদু বানালেন, যে দাদুর মৃত্যুর পর ওই বাড়ি ভাগ হলে সেটাই হয়ে গেল বাসযোগ্য শোবার ঘর। কিন্তু মিস্ত্রি আসার আগে অবধি আমাদের, মানে বাচ্চাদের সে কী আমোদ! সুড়ঙ্গের মুখে বসে পাতাল দর্শনের নিদারুণ চেষ্টা, আর একে ওকে উস্কানি, ‘ঢুকেই দ্যাখ না, ভয় কিসের!’ সিঁধের ফোকরও এক বড় বিস্ময়! অত ছোট একটা গর্ত দিয়ে মানুষ গলে গেল! মানুষ তা হলে কী না পারে! ইঁদুর, সাপ এরা তাদের শরীর অনুযায়ী বড় বড় গর্তে থাকে, আর মানুষ তার অতবড় দেহটা নিয়ে সরু ফোকর দিয়ে গলে কেমন অনায়াসে ওলট পালট করে দিয়ে চলে যায়!

ফাঁক আর ফোকর নিয়ে বিস্তর লিখেও ফাঁক থেকে যাবে, ফোকর গলে ফসকে যাবে কত কী! সব চেয়ে বেশি যা গলে গেছে তা হল সময়। আর সেই হাঁকাহাঁকির যৌথতা। এত মজবুত গাঁথনিতেও সিঁধ কেটে কখন যে চোরে সব নিয়ে গেল কে জানে? এখন তাই আট ইঞ্চি দেওয়ালেও সিঁধ পড়ে না। চকচক করে শুধুই সব বাহারি টাইলস।

Mandar Mukhopadhyay

আড্ডা আর একা থাকা,দুটোই খুব ভাল লাগে।
লিখতে লিখতে শেখা আর ভাবতে ভাবতেই খেই হারানো।ভালোবাসি পদ্য গান আর পিছুটান।
ও হ্যাঁ আর মনের মতো সাজ,অবশ্যই খোঁপায় একটা সতেজ ফুল।

27 Responses

  1. কোন ফাঁকে যে কি লিখে ফ্যালো, কোনো ফাঁক খুঁজে পাই না। এক্কেবারে ঠাস বুনন। তবে ফাঁকে ফাঁকে জীবনের ফাঁকিগুলো ধরিয়ে দিতেও তোমার জুড়ি মেলা ভার! ভালো থেকো মন্দার!

    1. লেখা,
      তোমার এই পাঠ ,এই পরতে পরতে বুঝে চলা এও খুব দামি। পাঠক তো মায়ের মতোই, লেখকের অক্ষর যাপনকে ভাবিয়ে তোলে আর ভরে নেয়। এভাবেই আমাকে পড়ো।

  2. Faank fokore porte Porte bhulayii gechi koto raat hoyechhe.Songay songay ee monay holo shutay jaaoaa r ghumonor faanke a e sumodhur lekhaaty poray ghum aaser faanke tandraar moddhe aamer chhoto baler didimaar baaraander raannaa gharay raannaa karaa r beraaler maachh bhaajaa churi koray gonf chaater drishyo taa dekhtay paya seii kobekaar nijer tin bochhore boyose pounchhe gelum bujhtayii parlumnaa.Dheeray dheeray ghumer deshay tolia jetay jetay ak faanke bolay ni shubho raatry

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *