৩১শে জুলাই, ১৮২০। বেলা প্রায় বারোটা। 

——-

সোমবারের এই প্রথম দ্বিপ্রহরে রানামুদীর গলি প্রায় ঝিমন্ত। ক্লাইভ স্ট্রিটের মোড়টার কাছে ডাক্তার জেমসের নতুন পাকাবাড়ি তৈরি হচ্ছে- সেখানে বেহারী মজুরদের একঘেয়ে গুনগুন ছাড়া আর তেমন কোনও শব্দ নেই- কে বলবে আর এক প্রহর পরেই এ জায়গাটা একেবারে নরক গুলজার হয়ে ওঠে। দিন পাঁচেক পর আজ রোদ উঠেছে, কিন্তু রাস্তার অবস্থা, এখনও সত্যপীরের সিন্নির মত। ভারি পদক্ষেপে, কোনওরকমে ভারসাম্য বজায় রেখে সেই কাদা পাঁক ঠেলে বেহেমথ ট্যাভার্নের সামনে এসে দাঁড়াল এক দীর্ঘকায় স্বর্ণকেশ গৌরাঙ্গ যুবক। ট্যাভার্নের দরজায় দাঁড়িয়ে নাসিম তখন কসাইটোলা বাজারে তপসে আর ঝিনুকের দাম নিয়ে ছোট খিদমতগার জাভেদকে সুচিন্তিত বকাঝকা দিচ্ছিল। এই সাতসকালে পানসকাশে আসতে দেখে শশব্যস্ত হয়ে দরজা খুলে ধরল। আধো অন্ধকার, বোঁটকাগন্ধ, হলদে ছোপ লাগা টেবিল এসব কিছু নিয়ে ফাঁকা ঘরটা দপ করে জ্বলে উঠল অ্যালেক্সের নীলাভ চোখের সামনে। একটু ধাতস্থ হয়ে দরজা থেকে সবচেয়ে দূরের একটা টেবিল বেছে নিল সে, তারপর কালিপড়া চোখ তুলে কারও দিকে না তাকিয়েই বলল-“একটা ব্র‍্যান্ডি। ন্যাশনাল।” জাভেদ এক দৌড়ে গিয়ে সোরার পিপে থেকে প্রিস্টলি সোডার জালঘেরা বোতল বের করে ফেলল।  

****

“সাহেব, গুড প্রন, ভেরি চিপ। একটু পাঠিয়ে দিই?” কাঠে করাত ঘষার মত গলায় নাসিমের প্রশ্নটা শুনে অ্যালেক্সের চিন্তাজাল ছিঁড়ে গেল। কতক্ষণ এখানে এসেছে সে, কে জানে? বাইরে আবার পিটপিট করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। দু চারটে ল্যাণ্ডো বা হ্যাকনির শব্দও শোনা যাচ্ছে। নাকের সামনে ভনভন করে চলা মাছিদুটোকে হাত নাড়িয়ে তাড়ানোর চেষ্টা করতেই, কে জানে কী বুঝে নাসিম চলে গেল। পাঁইটটার অর্ধেকও তখন খালি হয় নি, গেলাসে ঢেলে রাখা মালটা এক চুমুকে মেরে দিতেই বুকের ভেতরটা জ্বলে গেল অ্যালেক্সের- এটাতে সোডা মেশানো ছিল না। জাভেদের মায়ের উদ্দেশে কিছু পেশামূলক বিশেষণ প্রয়োগ করে শক্ত হয়ে বসল সে৷ শ্রাবণের কুকুরপচা ভ্যাপসা গরম আর কাঁচা ব্র‍্যান্ডির যুগপৎ সহাবস্থানে তখন তার মিলিটারি ইস্যু ঢোলা সাদা জামাটা ভিজে প্রায় স্বচ্ছ হয়ে এসেছে। আজাজেল বোধহয় এখনও হ্যাংম্যান পয়েন্ট পেরোয় নি। আজকে সকালে যখন আজাজেলের ডেকের রেলিং-এ ভর দিয়ে দাঁড়ানো মাইকেল তার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ছিল, কলকাতার আকাশের মত তার ধূসর চোখ দেখে অ্যালেক্স বুঝে গেছে পোর্টসমাউথ দূরে থাক, মাইকেল মোজাম্বিকও পৌঁছাবে না। দমদম ব্যারাক থেকে জাহাজঘাটায় আসার পথটুকুতে সে চারবার জ্ঞান হারিয়েছে। শেষের বার, পার হোটেলের সামনের পথটায় যখন সে সংজ্ঞা হারিয়ে অ্যালেক্সের কোলে ঢলে পড়ল, তখন তার মনে হচ্ছিল দাবনার উপর কেউ যেন একটা সদ্য গোলা ছোঁড়া ব্লোমফিল্ড চেপে ধরেছে। মাইকেলও কি বুঝতে পারে নি? না হলে, এসময় যখন সব প্যাসেঞ্জার জাহাজ বন্ধ থাকে, তখন এই দুঃস্থ ইতালিয়ান জাহাজ আজাজেলে চড়ে বসল কেন সে? অ্যালেক্সের সামনে মরে যেতে চায় না বলেই বোধহয়। জুতোর মধ্যে পায়ের নখগুলো চেপে বসল সাসেক্সের মেষপালকপুত্র অ্যালেক্সান্ডার উইন্ডহ্যামের- আরও এক গেলাস সোডা ছাড়াই গলায় চালান করে বমির গন্ধওলা দেওয়ালে পিঠটা এলিয়ে দিল সে। 

****

“ক্ষণেক শয্যায়/ ক্ষণেক ধরায়/ ক্ষণেক সখীর কোলে।/ ক্ষণে মোহ যায়/ সখীরা জাগায়/ বঁধু এই এল বলে।”- চটুল নেটিভ সুরালাপটি শুনে অ্যালেক্স চোখ মেলে তাকাল। টেবিলের উল্টোদিকে একটি বদখৎ কালো মোটা বেঁটে গুঁফো মুশকো লোক তার মুখের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে একখানা রংচটা ছোট্ট ট্রাঙ্কে তাল ঠুকতে ঠুকতে গান গাইছে এবং মুচকি মুচকি হাসছে। পরনে বেগুনী রঙের একটা ঢোলা গাউনের মত পোশাক, সামনে একটা প্রায় শেষ হওয়া আরকের বোতল রাখা। সে মধুভাণ্ড থেকে নির্গত তীব্র সংরাগ ফরাসী আঙুরলতাকে একেবারে পেড়ে ফেলেছে। 

  – “মোজাম্বিক অনেকদূর সায়েব, মাইকেল ফোর্ট জর্জ পেরোবে না।” তামাক খাওয়া কালচে দাঁত বের করে এক থাপ্পড়ে যেন খোঁয়ারি ছিটকে দিল অ্যালেক্সের। 

  – “তুমি কে হে ব্লাডি নেটিভ? মাইকেলকে কী করে চিনলে? বাজে কথা বললে এখানেই কেটে দু আধখানা করে দেব।”

  – তোমার মুরোদ আমার জানা আছে হে চ্যাংমাছ। বেশি ফড়ফড় কোরও না। পিন্ডারিরা কীরকম গুছিয়ে পেঁদিয়েছিল তোমাকে মনে আছে তো? আর দমদমার ঘরের ভেতরকার ব্যাপার যা যা জানি, তা ফাঁস হলে কালকেই তোমাকে ব্যারাকপুরের গঙ্গার ধারে দেওয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়াতে হবে। তার চে যা বলছি শোনো, একখানা ওই ন্যাশনাল না কী, ওই বলো। দুই স্যাঙাতে মিলে খাই। তোমাকে দেখেই বুজেছি, হুঁ হুঁ, কুলোপানা চক্কর।

 অ্যাহ নেড়ের ব্যাটা জাভেদ, সায়েবের ব্র‍্যান্ডির সাথে একবাটি ঝিনুকের ঝাল দিয়ে যা দিকিনি।”

শেষ কথাটা কাঠের পাটাতনের ওধারে সার সার বোতলের আলোছায়ায় খেলা করা শুঁটকো খিদমতগারটিকে বলে উঠল বাঙালি গুবরেপোকা। 

****

সন্ধে দুই প্রহর অতিক্রান্ত৷ অ্যালেক্স আর নেটিভটি বেহেমথের সামনে একখানা পাথরের চ্যাঙড়ে বসে আছে। সাহেবের জামার বোতাম খোলা, কষে শুকনো বমির দাগ, মাথাটা একেবারে একমাসের ঘাড়পলকা বাচ্চার মত ঝুঁকে পড়েছে। নেটিভটি আপনমনে বকে চলেছে -“মদনদারও মাইকেলের মত সান্নিপাতিক হয়েছিল রে লালমুখো, ভোর রাতে যখন আমার গায়ের ওপর বমি করতে করতে মরে গেল, তখন, বললে বিশ্বাস করবি না, চোখের মণিগুলোও সাদা হয়ে গেছে। পোড়ানোর সময় সে কী টোকো গন্ধ মাইরি। পুড়িয়ে দিলাম শালাকে, অ্যাঁঃ। ওরে মদনদা ঘি মেখে পুড়বে বলেই তো আজ সকালে রোদ উঠেছিল রে। পুড়িয়ে গঙ্গায় ডুব মেরে এসে দেখি তুই। দ্যাখ দ্যাখ, এখনও গায়ে ঘিয়ের গন্ধ লেগে আছে।” অ্যালেক্সের নাকে ডান হাতখানা চেপে ধরে সে। টাল সামলাতে না পেরে ব্রিটিশ সৈনিক কাদায় পড়ে যায়। বেঁটে বাঙালিটি তাকে অবলীলায় তুলে ধরে দাঁড় করিয়ে দেয়। বলে-“চ শালা, চ। অনেক হয়েছে।”

  – “কোথায়?”

  – “তোর যমের দখিন দুয়ার দমদমায় নয় রে আকাট। রসা পাগলার পুকুরধারে চ।”

  – “সেটা কোথায় বাবু?” সম্মোহিতর মত ঝিমনো গলা শোনা যায় অ্যালেক্সের। 

  – “দূর হ গুখেগো। তাও চেনে না৷ ওরে তোর বাপের বাপ টলিসায়েবের নালা পেরিয়ে রে। যেখানে তোরা দোখনো বাদশা টিপুর নাতিপুতিকে রেখেছিস। মদনদার চালাখানা তো ওই পুকুরধারেই৷ তুই এখন থেকে ওখানেই থাকবি। ঘর ফাঁকা রাখা যাবে না, বুঝলি কীনা।”

  – “এখন অদ্দূর কী করে যাব? হাঁটার জোর নেই৷ রাস্তায় ল্যান্ডোও নেই একটাও।”

 পিত্তবমি হবার মত বিকৃত শব্দ করে অনেকক্ষণ বেশ নাটকীয়ভাবে হাসে বাঙালি যুবকটি৷ তারপর বলে-“নে, হাত ধর।” 

****

অচিরেই বেহেমথের সামনেকার হলুদ লণ্ঠনের তেলিচিটে আলোয় দেখা যায় একটি প্রায় গোলাপি ছয়ফুট লম্বা লোক ও একজন কালো কুচকুচে কোলাব্যাঙের মত মানুষ উড়ছে। গোলাপি মাথা ঝুঁকিয়ে জিজ্ঞেস করে-

“তোমার নাম কী, বাবু?”

“আমার? হ্যা হ্যাহ, আমার নাম দিকপতি সমাদ্দার। সংক্ষেপে ডি এস।”

ফোর্ট উইলিয়মের ছাদ থেকে বেগম জনসনের ভূত বসে বসে পা দোলাচ্ছিল। ভারি মুখখানা তুলে সে দেখল দুটি অসম আকৃতির ছায়ামূর্তি খিলখিল করে হাসতে হাসতে আদিগঙ্গার দিকে উড়ে গেল।

নিবাস ভট্টপল্লী। পেশা ডাক্তারি। নেশা নানাবিধ। শখ ভ্রমণ। দুর্বলতা ফুটবল। ঘাঁটতে ভালোবাসেন ইতিহাস।

5 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *