রোয়িং ক্লাবের জলের ধারের টেবিলে এসে বসতে না বসতেই কুর্চি জানতে চাইল অরিত্রর রাত কেমন কেটেছে।

“খারাপ কোনও খবর পাইনি, সেটাই ভালো খবর।” বলল দেবদীপ। “এখান থেকে সোজা যাব নার্সিং হোম। কাল রাতে অনেকক্ষণ ছিলেন ডাক্তার করআজ আসবেন সাড়ে দশটা নাগাদ। তখন বাকিটা জানতে পারব।”

কুর্চি সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, “আমি যাই তোমার সঙ্গে?”

উত্তর না দিয়ে দেবদীপ খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল কুর্চির দিকে। গম্ভীর গলায় বলল, “অপেক্ষা কর। ঠিক সময় হলে বলতে হবে না। আমিই ডেকে নেব।”

কুর্চির মুখ আবার উদ্বেগে অন্ধকার হয়ে আসছে দেখে, গলা হাল্কা করে দেবদীপ তাড়াতাড়ি বলল, “সুজাতদাকে বললি, কাল মাঠে কী হল?”

— আমার সঙ্গে দেখা হয়নি বাবার। কাল সকালেই হায়দরাবাদ গেছে। জানি না কবে ফিরবে।

দেবদীপ দ্বিতীয় চালটা দিল। “তোর কী মনে হয় বলতো, আনোজি কাল থামতে পারত না? অরি যেভাবে বল ধরে রেখেছিল, তাতে বলে পা ঠেকানো তো সম্ভবই ছিল না আনোজির পক্ষে। থামতে না পারলেও আনোজি লাফিয়ে যেতে পারত অরির ওপর দিয়ে!

ওসব তোমরা অনেক ভালো বোঝো। তবে কাল গ্যালারিতে ইচ্ছে করে মারল বলে একজন চেঁচিয়ে উঠেছিল। গ্রাহামের সাপোর্টাররা হৈহৈ করে তাকে থামিয়ে দিল।

জানি। ব্যাপারটা আমারও কানে এসেছে। কিন্তু তোর নিজের কী মনে হচ্ছে?

আমি বলতে পারব না, আমার চোখ তো বলের ওপরেই ছিল। যে প্লেয়ারটা মারল, তাকে তখন ভালো করে লক্ষ্যই করিনি।

সেও ঠিককিন্তু তোর গাট ফিল কী বলছে? অ্যাক্সিডেন্ট, না ইচ্ছে করে মেরেছে?

ওমা! ইচ্ছে করে মারবে! তাও বিদেশি ফুটবলার? গোলকিপারের সঙ্গে তার কিসের শত্রুতা?

– এসব উত্তর খুঁজতে আইএফএ এনকোয়ারি কমিটি তৈরি করেছে, রেফারির কাছে রিপোর্ট চেয়েছে।

  হ্যাঁ, কাগজে পড়লাম।

– সে আইএফএ যতখানি পারে, ততখানি করবে। কিন্তু আমাদের যে তার চেয়ে অনেক বেশি জানতে হবে।

  কী জানতে হবে?

উত্তর না দিয়ে দেবদীপ আবার তাকিয়ে রইল কুর্চির দিকে। কুর্চি চোখ ফিরিয়ে তাকিয়ে আছে জলের দিকে। যে কথাটা দেবদীপ বলতে চায়, যা বলার জন্যে কুর্চিকে সে আজ ডেকেছে রোয়িং ক্লাবে, সেটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে বিষিয়ে উঠবে কুর্চির মন। মেয়েটা যথাসাধ্য চেষ্টা করছে ওর পুরনো দুঃখ ভুলে আনন্দে বাঁচার। দেবদীপ যা বলতে যাচ্ছে, তাতে কি ওর বাঁচাটা সহজ হবে? বাবা ছাড়া ওর নিজের লোক বলতে সত্যিই তো কেউ নেই! কুর্চি সামলাতে পারবে তো এই ধাক্কা? একা থাকে, ডিপ্রেশনে ভয়ঙ্কর কিছু করে বসবে না তো? কিন্তু অরিত্রর পাশে যে এখন কুর্চিকে দরকার! দেবদীপ জানে, তাতে সবরকম বাধা তৈরি করবে ডাক্তার সুজাত গুপ্ত। আর সুজাতদাকে সাধ্যমতো সাহায্য করবে তার বাবা অলোকেশ গুহ বিশ্বাস। শুধু টাকার জন্যে নয়, অদ্ভুত একটা বন্ধনের টানেসেটাকে শুধু আনুগত্য বলাও যায় না। তাই শুধু সহানুভূতি নিয়ে নয়, কুর্চিকে অরিত্রর পাশে থাকতে হবে একটা প্রতিজ্ঞা নিয়ে। অরিত্রকে সারিয়ে তোলার প্রতিজ্ঞা, অরিত্রকে মাঠে ফেরানোর প্রতিজ্ঞা। কুর্চিকে পাশে না-পেলে একা দেবদীপের পক্ষে কাজটা কঠিন শুধু নয়, হয়তো অসম্ভব। তাই চেষ্টায় কোনও ফাঁক রাখতে চায় না দেবদীপ। সেইজন্যেই সে ঠিক করেছে কুর্চিকে এবার অপ্রিয় কথাগুলো জানাবে। 

“পেনাল্টি বক্সের মধ্যে ঢুকে গোলকিপারকে মারাত্মকভাবে জখম করলে একটা প্লেয়ারের খেলোয়াড়-জীবন শেষ হয়ে যেতে পারে”, বলল দেবদীপ। “আনোজির তো কাল নিজেকে সামলানোর মরিয়া চেষ্টা করা উচিত ছিল। সেটা কি কেউ দেখেছি আমরা?”

নাহ। সেরকমও বলা যাবে না! কিন্তু আমি আর ফুটবল কতটা বুঝি?

-মাঠে ছিলি তো, খেলা দেখেছিস। ওই মুহূর্তটা তোর মনের মধ্যে গেঁথে যায়নি? তুই যা বুঝেছিস, তোর যা মনে হয়েছে, সেটাই বল। আনোজি কি অরির মাথায় বুট না চালিয়ে থামতে পারত না?

ধন্দে পড়ে গেল কুর্চি। অরিত্রকে ইচ্ছে করে মেরেছে আনোজি? কেন? খেলা শেষ হতে চলল, এই গোলকিপারের জন্যেই তারা বারবার আটকে যাচ্ছে, সেই রাগে? নাকি, পুরনো কোনও শত্রুতা ছিল ওদের? কিছুই তো জানা নেই কুর্চিরঅরিত্র চোট পেয়ে হাসপাতালে শুয়ে আছে বলেই দুম করে বলে দেওয়া যায়, হ্যাঁ, ইচ্ছে করে মেরেছে? এত লোক তো ছিল মাঠে, সবাই দেখেছে। দেবুদা এসব কথা তাকেই বা জিজ্ঞেস করছে কেন? উত্তর দিতে ইচ্ছেই করছে না কুর্চির।

কুর্চিকে চুপ করে থাকতে দেখে দেবদীপ খানিকটা স্বগতোক্তির মতো বলল, “এও হতে পারে অরিকে মারার জন্যে অনেক টাকার টোপ ছিল আনোজির সামনেএত টাকা, যে বুড়ো নাইজেরিয়ানটা আর লোভ সামলাতে পারেনি!”

আকাশ থেকে পড়ল কুর্চি। বলল, “মানে কী! অরিত্রকে মারার জন্যে টাকা? কলকাতার মাঠে এরকমও হয় নাকি!”

মাঠে নয়, খেলার জগতের বাইরে হয়ত কারও স্বার্থ ছিল।

পরিষ্কার করে বলো না, কী বলতে চাও। অরিত্রকে মারতে কে টাকা দেবে?

এবার মোক্ষম চালে কিস্তি দেবার সময় হয়েছে, ভাবল দেবদীপ। স্থির চোখে কুর্চির দিকে তাকিয়ে বলল, “কেন? প্রশান্ত পারিজা তোর ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলে যারা তাকে ফাঁসিয়েছিল।”

সঙ্গে সঙ্গে ফুঁসে উঠল কুর্চি। “কী যা তা বলছ! জানি না ওসব কথা তোমাকে কে বলেছে আর কী বলেছে। কিন্তু ও নিয়ে কোনও রকম আলোচনার এতটুকু ইচ্ছেও আমার নেই। ছিঃ!”

কুর্চির এরকম প্রতিক্রিয়ার জন্যেই যেন তৈরি ছিল দেবদীপ। ঠান্ডা গলায় বলল, “বছর দু’য়েক তো হতে চলল। আমি কি কোনও দিন এই নিয়ে কথা বলতে গিয়েছি তোর সঙ্গে? কিন্তু নিজেই একবার ভেবে দেখ না, তোর সঙ্গে বন্ধুত্ব হতে না হতেই প্রশান্ত পারিজা কেলেঙ্কারিতে ফেঁসে যায়। মাথায় বুটের ধাক্কা নিয়ে অরিত্র মিত্র হাসপাতালে শুয়ে থাকে! আমার যদি সন্দেহ হয়, কেউ টাকা ছড়িয়ে এসব করাচ্ছে, তুই সেটা শুনতেই চাইবি না?”

চোখ সরু করে কুর্চি তাকিয়ে আছে দেবদীপের দিকে।  বলল, “কী জানো তুমি প্রশান্ত সম্পর্কে? কে বলল তোমাকে যে ওকে ফাঁসানো হয়েছিল?”

তুই ও নিয়ে ভাবা বন্ধ করে দিয়েছিস বলে কোনও কিছুই খেয়াল করিসনি। বল না আমাকে, যে ছবিটা করতে প্রশান্তকে বম্বেতে ডাকা হয়েছিল, সেই চিত্রাঙ্গদার নাম আর শুনেছিস? তোকে তো সবই বলত প্রশান্ত! বল তো ডিরেক্টর কেতন গৌতম, প্রোডিউসার নির্ভয় মেহরা – যারা ডেকে নিয়ে গিয়েছিল প্রশান্তকে, তাদের নাম আর শুনেছিস কোনও দিন? ইন্টারনেট খুঁজে দেখ না, কোথায় পাওয়া যায় কুসুম স্যানন নামে সেই মেয়েটাকে, যে নাকি চুপ করে থাকার জন্যে পাঁচ লাখ টাকা চেয়েছিল? সবাই একসঙ্গে উধাও? সেটা স্বাভাবিক?”

শুনতে শুনতে মুছে গেছে কুর্চির গোটা মুখ জুড়ে থাকা অবিশ্বাস আর প্রত্যাখ্যান। সরু চোখ বড় হয়ে উঠেছে গভীর বিস্ময়ে। বলল, “এসব নাম, এত কথা তুমি জানলে কোত্থেকে! কে বলেছে?”

মুখ নামিয়ে ডান হাতে নিজের এক মুঠো চুল ধরে দেবদীপ খুব নীচু গলায় বলল,”কেউ বলেনি রে কুর্চি, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এসব আমাকে জানতে হয়েছে। যারা এসব করিয়েছে, তাদের মধ্যে আমার নিজের লোক রাখতে হয়েছে। তারাই ধাপে ধাপে সব খবর দিয়েছে। আর, পুরো ছক, প্রত্যেকটা নাম, আমার মাথার হার্ড ডিস্কে ঢুকিয়ে রেখেছি। কিন্তু এখনও জানি না, এবার এত বড় প্ল্যানের আঁচ পেলাম না কেন? আগের বার সব খবর পেয়েছি বলে নিশ্চিন্তে থাকতে গিয়ে এত বড় গন্ডগোল করে ফেললাম? অরিকে কলকাতার বাইরে নিয়ে যাওয়ার প্ল্যান হচ্ছে, এটাই  জানতাম। মাঠ থেকেই সরিয়ে দেওয়ার প্ল্যানের কথা তো ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি!”

দেবদীপ মুখ তুলল যতক্ষণে, কুর্চি তার মধ্যে ব্যাগ থেকে বার করে সানগ্লাস চাপিয়ে নিয়েছে তার চোখে। বলল,”জানি না তোমার কথা বিশ্বাস করব কিনা। কতটা করব। তুমি বলতে চাও বাবাই সব করাচ্ছে? আমি এখনও সেটা ভাবতে পারছি না। আমার একটু সময় চাই। এখন চললাম আমি।”

  কোথায় যাচ্ছিস? ফিরে যাবি শান্তিনিকেতনে?

– জানি না। জাস্ট কিছু ভাবতে পারছি না এখন। চললাম, বলে উঠতে যাচ্ছিল কুর্চি। দেবদীপ দৃঢ় গলায় বলল, “যাওয়ার আগে আমার আরও দুটো কথা শুনে যা। এক নম্বর, আমি যে এসব কথা জানি, বা জানলেও তোকে জানাতে পারি, সেটা সুজাতদার পক্ষে কল্পনা করাও অসম্ভব। তুইই ভেবে ঠিক করিস সেটা সুজাতদার জানার দরকার আছে কিনা। দু’ নম্বর, আমি অরিত্রর পাশে আছি আর থাকবও। আমি মনে করি, মাঠে ফেরাতে হলে ওর পাশে তোর থাকাটাও খুব দরকার। সব জানার পর এখন তুই কী করবি, সেটাও নিজেই ঠিক করিস।”

আদতে ছিলেন সাংবাদিক, তারপর কর্পোরেট কর্তা। অবসরের পর শান্তিনিকেতনে বসে লেখাজোকায় মন দিয়েছেন। বেশ কিছু প্রবন্ধ আর গল্প লিখেছেন আজকাল, অনুষ্টুপ আর হরপ্পা-য়। প্রথম উপন্যাস 'গোলকিপার' প্রকাশিত হয়েছে বাংলালাইভে। আপাতত ডুবে রয়েছেন ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে। আজকালের রবিবাসর ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর ধারাবাহিক রচনা - সিনেমাতলার বাঙালি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *