খেতাবের ঝুলি ভরে গেছে। ঝুলিতে কান চলচ্চিত্র উৎসবের সর্বোচ্চ পুরস্কার তো ছিলই, নতুন যোগ হয়েছে অস্কার। তাও একটা নয় চার চারটে। শ্রেষ্ঠ স্বকীয় চিত্রনাট্য, শ্রেষ্ঠ বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র, শ্রেষ্ঠ পরিচালক এবং শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র — এই চারটে বিভাগে অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড-প্রাপক এই সিনেমা। ইংরেজি ছাড়া অন্য ভাষায় নির্মিত সিনেমার শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র বিভাগে অস্কারপ্রাপ্তিও এই প্রথম। স্বভাবতই অ্যাদ্দিনে সিনেমা সম্পর্কে সামান্য খোঁজখবর রাখা মানুষজনও এখন জানেন এই সিনেমাটার কথা। প্যারাসাইট (গিসেংচুং)। দেখা না হয়ে থাকলে এই সিনেমাটা সংক্রান্ত আলোচনা থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখাই বাঞ্ছনীয়। 

না, প্যারাসাইটের গল্প গড়গড় করে বলে দেওয়ার অভিপ্রায়ে এই লেখা নয়। তবে চিত্রনাট্যকার-পরিচালক বং জুন-হো’র হাত ধরে কিম পরিবারের সেমি-বেসমেন্ট অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে পড়ে সওয়া দু’ঘন্টার কিছু কম সময়ের এক অভূতপূর্ব সিনেম্যাটিক যাত্রা শুরুর আগে মন যত নির্ভার থাকবে ততই ভাল। কারণ, সিনেমার চরিত্রগুলোর সাথে আপনাকে অনেকটা উচ্চতা অতিক্রম করতে হবে, অনেক… অনেক সিঁড়ি বেয়ে নামতেও হবে। এই সিনেমা জলের মতই প্রবহমান, পরিবর্তনশীল ও অমোঘ। কোনও একটি বিশেষ ধারায় একে আবদ্ধ করতে পারবেন না। দর্শকের মনগড়া পাত্র ছাপিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে চলে যাবে। পরিচালকের ভাষায় এটি “একটি ক্লাউনবিহীন কমেডি, একটি ভিলেনবিহীন ট্র্যাজেডি।”

কম বয়সে সিওলের একটি ধনী পরিবারে গৃহশিক্ষকতা করার সময়েই বং জুন-হোর মাথায় প্যারাসাইটের আইডিয়ার বীজ বপন হয়। ২০১৩য় স্নোপিয়ার্সার তৈরী করার সময় হয় সেই আইডিয়ার অঙ্কুরোদ্গম। পরবর্তীকালে হান জিন-ওন এবং বং নিজে ধাপেধাপে লিখে ফেলেন চিত্রনাট্য। শুধু চিত্রনাট্যর জন্যই আলাদাভাবে কুর্নিশ প্রাপ্য এই সিনেমার। সেভাবে ভাবতে গেলে কোন বিষয়ের জন্য নয়? চলচ্চিত্র মাধ্যমে অবিশ্বাস্যরকমের দখল না থাকলে এরকম সুসংহত ও সাবলীল সিনেমা বানানো সম্ভব নয় যা পঞ্চাঙ্ক গঠনরীতির অনুসারী হয়েও অনায়াসে প্রবাহিত হয় বিভিন্ন জঁর-এর মধ্য দিয়ে। ডার্ক কমেডি, সোশ্যাল স্যাটায়ার, সাসপেন্স থ্রিলার, হরর কোনও একটি তকমা এঁটে দেওয়া মুশকিল এই সিনেমার গায়ে। জলের মতই সর্বগ্রাসী এবং অনায়ত্ত। বং তাঁর নিজস্ব প্রণালীমত ম্যারিনেশনের কাজে লাগিয়েছেন হিউমারকে। 

সাউথ কোরিয়ায় বহু নিম্নবিত্ত পরিবারের মতই কিম পরিবারের জীবন অতিবাহিত হয় সেমি-বেসমেন্ট অ্যাপার্টমেন্টে। না বেসমেন্ট, না একতলা। মাটির নীচ থেকে শুরু হয়ে মাটির ওপরে শুধু মাথাটুকু জাগিয়ে রাখা বাসস্থান। জানলা দিয়ে দেখা যায় পার্শ্ববর্তী রাস্তা। সেই কাচের জানলা দিয়ে আশা-আকাঙ্ক্ষার মতই ঢোকে সূর্যালোক। জানলা খোলা রাখলে ঢোকে ফিউমিগ্যান্টসও। কোন বাঁধাধরা চাকরি নেই পরিবারের চার সদস্যর। বাবা কি-তায়েক (সং কাং-হো) একাধিক অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেছেন এক সময়ে। মা চুং-সুক (জ্যাং হায়ে-জিন) এককালে হ্যামার থ্রোয়ে রুপো জিতেছেন। ছেলে কি-উ (চোই উ-শিক) বুদ্ধিমান ও ইংরিজিতে দক্ষ কিন্তু বারবার প্রবেশিকা পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে কলেজে পড়া হয়নি। মেয়ে কি-জুং (পার্ক সো-ড্যাম) শিল্পকলায় পারদর্শী কিন্তু শিক্ষার খরচ যোগাতে অসমর্থ পরিবার। অবস্থার গেরোয় আর্থ-সামাজিক সিঁড়ির নিচের দিকের ধাপে আটকে পড়া এক পরিবার, যেখান থেকে উত্তরণের আশা ক্ষীণ। হঠাৎই এক বন্ধুর সূত্রে উচ্চবিত্ত পার্ক পরিবারের মেয়ে ডা-হায়ের (জুং জি-সো) গৃহশিক্ষক হওয়ার সুযোগ এলো কি-উর কাছে। তারপর কিম পরিবারের সদস্যরা একে একে পার্ক পরিবার নিয়োজিত কর্মীদের প্রতিস্থাপিত করতে থাকেন। কীভাবে তা সম্ভব হয় আর এরপর কোন পথে জল গড়ায় তা প্রত্যক্ষ করতে ঢুকে পড়তে হবে বং জুন-হোর পৃথিবীতে। 

প্রতিটি চরিত্র সুগঠিত এবং বিশেষত্বে উজ্জ্বল। সাউথ কোরিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেতা সং কাং-হো প্যারাসাইটেও স্বতস্ফূর্তভাবে মেলে ধরেছেন তাঁর চরিত্রর বিভিন্ন শেড। কোরিয়ান র‍্যাণ্ডম নাচের মতই ঘটনার গতিপ্রকৃতি বিভিন্ন বাঁক নিলেও ঘটনা পরম্পরা একটা রিদমে বাঁধা থাকে। পরিচালকের মতে সেই রিদমটা স্থির করে সং-এর অভিনয়। বারবার অবাক করে দিতে পারেন সং তাঁর বহুমাত্রিক অভিনয়ের গুণে। চরিত্রগুলির সফল রূপায়ন সিনেমার রিদমের সাথে তাল মিলিয়েই যেমন বৈচিত্র্য এনেছে তেমনই নিবিড় করেছে দর্শকের সাথে যোগাযোগ। অভিনয়ের সূক্ষ্মতা তারিফযোগ্য। আবার সিনেমার চাহিদামত কখনও এসেছে উচ্চগ্রামের অভিনয়, এমনকী ক্যারিকেচার। দক্ষ সম্পাদনা কোথাও ছন্দপতন হতে দেয় না। পুরো সিনেমা জুড়েই ব্যবহার করা হয়েছে নানান মেটাফরের। কখনও চরিত্ররা নিজেরা সেগুলো চিনে নিয়েছেন, উল্লেখ করেছেন সরাসরি, কখনওবা অন্তর্নিহিত থেকে গেছে। প্যারাসাইট সিনেমায় প্রোডাকশন ডিজাইনিং আর ভিস্যুয়াল এফেক্টস টিমের সাহায্যে অত্যন্ত নিপুণভাবে গড়ে তোলা হয়েছে কিমদের সেমি-বেসমেন্ট অ্যাপার্টমেন্ট ও পাড়া আর পাহাড়চুড়োয় পার্কদের বিলাসবহুল বাড়ি। প্রোডাকশন ডিজাইনার লি হা-জুনের অসাধারণ কৃতিত্ব এখানে। বং জুন-হোর আগের কয়েকটি সিনেমার মত খালি চোখে ধরা মুশকিল এই সিনেমার ভিস্যুয়াল এফেক্টস। খুঁটিনাটির প্রতি অত্যন্ত যত্নবান পরিচালকের শিল্পবোধ, মাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণের সাথে পরতে পরতে মিশেছে সমাজসচেতনতা, মানবিকতা ও মনস্তত্ত্বের ঘাঁতঘোঁত।  

ধনী পরিবারে পরিচয় ভাঁড়িয়ে চাকরি করতে যাওয়ার গল্প নিয়ে বিস্তর সিনেমা হয়েছে বিভিন্ন ভাষায়। অসংখ্য ভারতীয় সিনেমাও আছে এই থিম নিয়ে। বাংলাতে ছদ্মবেশী বা দেয়া নেয়ার কথাই ভেবে দেখুন উদাহরণ হিসেবে। একটি তামিল সিনেমার সাথে তুলনাও করছেন কেউ কেউ। সে তুলনা হাস্যকর। পরবর্তী ঘটনা পরম্পরা বাদ দিলেও মূলগত জায়গাতেই ফারাকটা জমিন-আসমানের। আর্থ-সামাজিক শ্রেণীবিভাজন, শ্রেণীগুলির আন্তঃক্রিয়া এবং পরজৈবিক নির্ভরশীলতা কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু প্যারাসাইটের। পরজীবীরা বাসা বাঁধে অন্য জীবের শরীরে, শুষে নেয় পুষ্টি। কিন্তু দুই শ্রেণীর মানুষের মধ্যে এক শ্রেণীকে পরজীবী আখ্যা দিতে গেলে প্রয়োজন অমানবীকরণের। সমাজের ডিহিউম্যানাইজ করার প্রবৃত্তিও যেন চোখে এবং নাকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় এই সিনেমা। 

 আর্থসামাজিক স্তরবিন্যাস ছিল স্নোপিয়ার্সারেও। সেখানে সেই স্তরবিন্যাস হয়েছিল এক অনুভূমিক কাঠামোয়। প্যারাসাইটে সেই স্তরবিন্যাস উল্লম্ব। জল স্বাভাবিক নিয়মেই তাই ওপর থেকে নিচের দিকে নামে। এই সিনেমায় আলোর ব্যবহার, বিশেষত সূর্যালোকের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। আকাঙ্ক্ষা আর ক্ষমতার দ্যোতনায় ধুয়ে যায় ক্যামেরার লেন্স। আর একটি সাম্প্রতিক সিনেমার কথা মনে পড়ে যায় এ প্রসঙ্গে। টড ফিলিপস পরিচালিত, হোয়াকিন ফিনিক্স অভিনীত জোকার — ডিসি কমিকসের অবিসংবাদিত ভিলেনের অরিজিন স্টোরি। প্রান্তিক মানুষজনের প্রতি সমমর্মিতার অভাব তুলে ধরা হয়েছিল জোকারেও, ছিল শ্রেণীবিভাজন ও শ্রেণীসংগ্রামের কথাও। তবে প্যারাসাইটে কখনই কোন মানুষকে খুব নেতিবাচক করে গড়ে তোলা হয়নি। একইসাথে কেউই নৈতিকতার পরাকাষ্ঠাও নন। ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার গঠনতন্ত্র দাঁড়িয়েছে কাঠগড়ায়, যে সমাজব্যবস্থা এক অনতিক্রম্য সীমারেখা টেনে দিতে চায় মানুষের মধ্যে। মানুষ থাকুক বা না থাকুক সেই সিঁড়ির ধাপগুলো থেকে যায়। কেউ অত্যাশ্চর্যভাবে ভেসে উঠতে চাইলেও অচিরেই অধঃক্ষিপ্ত হতে হয়। 

সারা বিশ্বজুড়েই মানুষ কোথাও একটা চিনতে পারছেন ক্যাপিটালিস্ট সমাজের এই উপস্থাপনাকে। গিগ ইকোনমি, হায়ার অ্যান্ড ফায়ার সিস্টেমের রমরমার সাথে মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কোরিলেশন নিয়েও বোধহয় প্রশ্ন উঠে যাচ্ছে। অনেক উচ্চতায় যেখানে সূর্যালোক অকাতর, নিচুতলার গন্ধ জাপটে ধরে না সেখানে পৌঁছনো এবং থিতু হওয়ার এক সর্বগ্রাসী আকাঙ্ক্ষা এবং সব হারানোর আশঙ্কা মূল্যবোধের শরীরে বাসা বাঁধে। পুঁজিপতিরা নিচুতলার মানুষের শ্রমটুকু শুষে নেন অর্থের বিনিময়ে, সেখানে শ্রমটুকুই প্রয়োজনীয়, মানুষগুলি নন। তাই তাঁদের ঝেড়ে ফেলতেও সময় লাগে না। মিসেস পার্ককে (চো ইয়েও-জিয়ং) তাই খুব সরল এবং দৈনন্দিন জীবনে অপটু হিসেবে বর্ণনা করা হলেও তিনি কর্মী ছাঁটাই করতে পারেন দক্ষতার সাথে। প্যারাসাইটে দেখানো হয়েছে এমন এক সমাজ যেখানে বহু মানুষ কর্মহীন, যেখানে একটি নিরাপত্তারক্ষীর চাকরির জন্যও পাঁচশো গ্র্যাজুয়েট আবেদনপত্র জমা দেন। সিনেমার বাইরে এসে দেখুন তো চেনা চেনা লাগে কিনা? যে দেশে বেকারত্বের হার আকাশছোঁয়া, প্রতিনিয়ত কাজ হারাচ্ছেন অসংগঠিত ক্ষেত্রের অসংখ্য মানুষ, হাতে গোনা কয়েকটি পোস্টের জন্য অসংখ্য আবেদনপত্র জমা পড়ে, ডিগ্রি জাল হয় সহজেই, যোগ্য মানুষ কাজ পান না, দেনার দায়ে হাপিশ হয়ে যেতে হয়, এর সঙ্গে যোগ করুন প্রতিবেশী রাষ্ট্রর আক্রমণের ভয়, চেনেন নাকি এমন কোন দেশ, এমন কোন সমাজ? প্যারাসাইট দেখার পর নিজের দিকে এবং চারপাশে একবার তাকিয়ে দেখা দরকার। হয়তো বা দিবাস্বপ্নর প্রয়োজনীয়তাও তখন বোঝা যাবে। 

জন্ম এবং বেড়ে ওঠা ভাটপাড়ায়, স্নাতক স্তরের পড়াশোনা কলকাতা সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। বর্তমানে বোস ইন্সটিটিউটে পদার্থবিদ্যা নিয়ে গবেষণারত। সিনেমা, গান এবং ফুটবল নিয়ে সময় কাটাতে ভালোবাসেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *