আগের কালে বিয়েবাড়ির ভাঁড়ার ঘরের এক জন জবরদস্ত ম্যানেজার থাকতেন। সাধারণত, মেসোমশাই, বয়সে অনেক বড় জামাইবাবু, সেজ কাকু, পাড়াতুতো দাদা গোছের সম্পর্করাই এই ঘনঘটার কাজটি নিখুঁত ভাবে পরিচালনা করতেন। কিন্তু এ দিকে আবার মিষ্টি এবং ফিশ ফ্রাই– এই দু’টি জিনিস ছেলেপুলেদের কাছে ছিল অর্জুনের পাখির চোখের ন্যায়। তাদের উদ্দেশ্যটি অত্যন্ত সরল। কখন কোমরে গামছা বাঁধা এবং বিবেকানন্দের মতো হাত দু’খানি বুকের কাছে বাগিয়ে নাছোড় এই বান্দাটি অল্প সময়ের জন্য বাথরুম ইত্যাদির দিকে ধাবিত হবেন, এবং সেই সুযোগে ছেলেপুলের দল কিছু মিষ্টান্ন ও ফিশ ফ্রাই বিতরে জনাঃ অর্থাৎ কিনা পাতি কথায় পেটে চালান করবে, সেই অপেক্ষায় থাকত।
ভাঁড়ার রক্ষকটিও নিদারুণ। তিনি তো আর সূর্যের আলোয় চুল পাকাননি। ফলে তিনি এই সব বিচ্চুদের গতিপ্রকৃতি খুব ভাল করে জানতেন এবং তাদের মহৎ আইডিয়া ও অপেক্ষায় জল ঢেলে ভাঁড়ার ঘরে তালা-চাবি দিয়ে তবে সেখান থেকে নড়তেন। চতুর প্রজাতির ছোকরার দল হলে সে ব্যবস্থাকে মাত দেওয়ার জন্য ভাঁড়ার ঘরের জানলার শিকের পাকা খবর নিয়ে রাখত, শিক ভাঙা যাবে কিনা কিংবা দুটো শিকর মাঝখান দিয়ে হাত ঢোকানো যাবে কি না।
পাহারা দেওয়াই কি ম্যানেজার বাবুটির একমাত্র কাজ ছিল? কখনই নয়। সারাদিন ঠায় পাহারা দিয়ে এবং তদারকি করে সন্ধের ঝোঁক থেকে তাঁর ব্যস্ততা উঠত চরমে। কারণ অফিসের ব্যাচ বসতে শুরু করত। এবং কেবল গরম লুচি ছাড়া সবই তাঁর দ্যাখতায়। মাছের কালিয়া, পাঁঠার মাংস, চাটনি, পাঁপড়, ফেলু মোদকের জলভরা, চিত্তরঞ্জনের রসগোল্লা– সবই তাঁকে অত্যন্ত নিপুণভাবে কাউকে ফাঁকি না দিয়ে, কাউকে অতিরিক্ত না দিয়ে অতিথি ভোজন করাতে হবে। ছানার কালিয়ায় বার বার হাতা ডোবালে ঘেঁটে যেতে পারে, হাড়-সমেত মাংসগুলো ভারের জন্য নিচের দিকে চলে গেছে, তা ঠিক অনুপাতে মিশিয়ে দিতে হবে, এ-ও তাঁর চোখ এড়ালে চলবে না। তাঁর নিয়ন্ত্রণ থাকবে তুঙ্গ– সি-শার্প থেকে ডি-মাইনর– যাতায়াত হবে নিতান্ত আয়াসে। এবং এ গুণ যে তিনি কত পরিশ্রমে ও কত অধ্যাবসায়ে রপ্ত করেছেন, তা কেবল পাড়ার কিংবা ফ্যামিলির বড়রাই জানেন। ছেলেছোকরারা কী বুঝবে তাঁর মহিমা। এটাও যে একটা শিল্প, সে আর ক’জন দর দিল?
আর লাস্ট ব্যাচ খেয়ে উঠে গেলে, বেঁচে যাওয়া ডাল-চাটনি-ছানার কালিয়া আর কয়েক পিস ফিশ ফ্রাই গুনে ছোট কাকিমাকে বুঝিয়ে তিনি এক খানি পান মুখে দিয়ে রুমালে হাত মুছতে মুছতে শচিনকত্তার গান শিস দিতে দিতে রাত দেড়টা নাগাদ বাড়ির দিকে রওনা দেবেন। শতেক অনুরোধে-উপরোধেও তাঁকে একটি ফিশ ফ্রাই বা ফেলু মোদকের এক খানি জলভরা মুখে তোলানো যাবে না। উত্তর আসবে, “সারা দিন কাকিমা খাবারের গন্ধের মধ্যে আছি তো, এখন পারব না খেতে। পরে এক দিন কবজি ডুবিয়ে ভাল করে খেয়ে যাব।”
এই যে নিখুঁত উপস্থাপনা, কোথাও বাড়তি নয়, কোথাও খামতি নয়, কোথাও গুণমানের সঙ্গে সমঝোতা নয়, ফিশ ফ্রাইয়ের নিখুঁত হিসেব, রসগোল্লার রস টিনে ঢেলে পরের দিনের চাটনির ব্যবস্থা করে যাওয়া– এ তো কোনও উচ্চমানের মিউজিক্যাল কনসার্ট পরিচালনার থেকে কম নয়, কম নয় সিনেমার হরেক কলাকুশলীকে সঙ্গে নিয়ে একখান তরতরে সিনেমা হল-রিলিজ করে দেওয়া।
এ হেন বিদগ্ধ কন্ডাক্টর সিঙ্গল স্ক্রিন হলের মতোই বিরল। তার সিলভার জুবিলি, গোল্ডেন জুবিলি আর হয় না। যেমন হয় না ভি. বালসারার সঙ্গীতানুষ্ঠান, তাঁর এক স্টেজ কলাকুশলী নিয়ে। যেমন তিমিরবরণ আমাদের রূপকথার গল্পে থেকে যাবেন। যেমন লতা মঙ্গেশকর গাইবেন আর দর্শকদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে সলিল চৌধুরী তাঁর প্রিয় বাজনদারদের পরিচালনা করে ঝরনা বইয়ে দেবেন হলে। রাত শেষে সবাই চোখে ঘুম আর মনে হিল্লোল নিয়ে বাড়ি ফিরবে। আর আধো ঘুমে সলিল চোধুরীর সিল্যুট চেহারাটি, হাতের নানা ভঙ্গিমা সব ঘুমে অ্যাটাক করে, বিস্তার করবে মোৎজার্টের ৪০তম সিম্ফনি।
না, আমরা কেউ সে সব কালের আঁচ পাইনি। তবে বাস কন্ডাক্টরের বাস থাবড়ানো চঞ্চলতা উপভোগ করেছি। ফুটন্ত ডালে ডোবানো হাতায় বেখেয়ালে হাত দিয়ে বুঝেছি স্টিল ভাল হিট কন্ডাক্টর! বাড়ির অ্য়াডভান্স হাতিয়ে নিয়ে পলায়ন করলেন যে মহিলা, তিনি বিশ্বাস থেকে অবিশ্বাসের দিকে ধাবিত করার উৎকৃষ্ট কন্ডাক্টর। কালকা স্টেশনে বিনা রিজার্ভেশনে ট্রেনে উঠে বুঝেছি প্রায় সব ট্যুর কন্ডাক্টরই অল্পবিস্তর ধাপ্পাবাজ।
এ বারের মলাট কাহিনি আমাদের মতো বেকুব-চালাক, উগ্রচণ্ডা-মৃদুভাষী, ভিতু-সাহসী সব কন্ডাক্টরকে নিয়ে যাঁরা আজীবন টাল সামলাতে সামলাতে জীবন নামক চিড়িয়াটিকে পরিপাটি কন্ডাক্ট করার চেষ্টা করে চলেছি আর হামেশাই কানে বেসুরো ঠেকছে!
সঞ্চারী মুখোপাধ্যায় হাসিখুশি, এমনকী যখন সেই মোড-এ থাকেন না, নিজেকে ঠেলে হিঁচড়ে হিহিহোহো’তেই ল্যান্ড করানোর চেষ্টা করেন। জাপটে ভালবাসেন আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সিরিয়াল, গান, রাস্তায় নেড়িবাচ্চার লটরপটর কান। পড়াশোনার সময় ফিল্ড করেছেন, হাতুড়ি দিয়ে পাথর ভেঙেছেন, গ্রামবাসীদের তাড়া খেয়েছেন, এক বার পাহাড় থেকে অনেকটা হড়কে পড়ে মুচ্ছো গেছিলেন, উঠে দেখেন, কবর! এক বার ম্যানেজমেন্ট কোর্সের অঙ্গ হিসেবে চিন গেছিলেন, রাত্তির দুটোয় সাংহাইয়ের রাস্তায় হারিয়ে গিয়েও কাঁদেননি। ফিউজ সারাতে পারেন, পাখার কার্বন বদলাতে পারেন, কাগজের চোঙ পাকিয়ে গাড়িতে পেট্রল ঢালতে পারেন, চিনেবাদাম ছুড়ে দিয়ে মুখে নিপুণ লুফতে পারেন। ব্যাডমিন্টন খেলার ইচ্ছে খুব, কিন্তু জায়গা ও র্যাকেট নেই। অরোরা বোরিয়ালিস যারা দেখেছে, তাদের একাগ্র ভাবে হিংসে করেন। দেশের বাড়িটা উনি বড় হওয়ার পর ছোট হয়ে গেছে বলে, আর আমির খান এক বার কার্টুন এঁকে দিয়েছিলেন— সে কাগজ হারিয়ে গেছে বলে, জেনুইন কষ্ট পান। এক বার ঈগলের রাজকীয় উড়ান আগাগোড়া খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন।
সুন্দর লাগল। মিলিয়ে নিতে পারলাম অনেকখানি।