দুপুরের উড়ানে ভারত মহাসাগরের উপর ভাসতে-ভাসতে চলেছি বালি দ্বীপের উদ্দেশে। সেই বালি, যেখান থেকে কল্যাণীয় রথীকে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “বালি দ্বীপটি ছোটো, সেইজন্যেই এর মধ্যে এমন একটি সুসজ্জিত সম্পূর্ণতা। গাছে-পালায় পাহাড়ে-ঝরনায় মন্দিরে-মূর্তিতে কুটীরে-ধানখেতে হাটে-বাজারে সমস্তটা মিলিয়ে যেন এক। বেখাপ কিছু চোখে ঠেকে না।” এসব ভাবতে ভাবতেই সাগরপারে যখন সবে ঠাহর হচ্ছে ঘরবাড়ি, সবুজ পাহাড়, হঠাৎ করেই সমুদ্রতট বরাবর একছুটে এসে ছুঁয়ে ফেললাম এক অবাক করা রানওয়ে। এনগুরা রাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, বালির দক্ষিণ বিন্দুতে নোঙর করা এক মস্ত জাহাজ যেন, এমনই এর স্থান-মাহাত্ম্য।

অতিথি আপ্যায়নে এদেশ দুহাত বাড়িয়েই রেখেছে। ইমিগ্রেশন কাউন্টারে ফেরার টিকিট দেখিয়ে বিনা বাক্যব্যয়ে এক মাসের ভিসা হয়ে গেল। উপরি পাওনা কাস্টমস্ অফিসারের একগাল হাসি! এয়ারপোর্ট চত্বরেই একটি মানি এক্সচেঞ্জ কাউন্টারে ডলার ভাঙিয়ে ইন্দোনেশিয়ান রুপিয়া পকেটস্থ করে ট্যাক্সিতে চেপে বসলাম।

ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন রাস্তা ধরে এগোচ্ছি দক্ষিণ-পূর্ব সীমার দিকে। গন্তব্য সানুর সমুদ্রসৈকত। রাস্তার দুপাশে গৃহস্থ বাড়িগুলির ছিমছাম, বাহুল্যহীন নির্মাণশৈলী চোখের আরাম দেয়। পাঁচিলঘেরা জমির মধ্যে মূল গৃহটি বসবাসের জন্য, তার পাশে মন্দির। বাড়িগুলির ছাঁদ অনেকটা গ্রাম-বাংলার একচালা বাড়ির মতো। বহু বাড়িরই মূল ফটকের বাইরে রাস্তার ধারে তুলসী-মঞ্চের মতো দেখতে ছোট্ট মন্দির, সামনে প্রসাদী ফুল আর ধূপের নৈবেদ্য। চৌরাস্তার মোড়গুলিতে চোখে পড়ছে গরুড়, বিষ্ণু, গণেশ – নানা হিন্দু দেব-দেবীর মূর্তি। প্রশস্ত ফুটপাথে কাঠগোলাপ, করবী ফুলের গাছ। নান্দনিক নগরদৃশ্য মন ছুঁতে থাকে অজান্তেই, জন্ম নিতে থাকে অবিমিশ্র ভালোলাগার।

সানুরের মূল রাস্তাটির নাম বেশ খটমট, দানাউ তাম্বলিংগান রোড। পর্যটকপ্রধান সানুরে হোটেল, রেস্তোরাঁর ছড়াছড়ি।  ট্যাক্সি ডানদিকে মোড় নিয়ে একটু এগোতেই পৌঁছে গেলাম আমাদের আকাঙ্খিত হোটেলের দোরগোড়ায়। বালির ঐতিহ্যপূর্ণ বাটিক প্রিন্টের জামা পড়া ট্যাক্সি ড্রাইভার হাসিমুখে শুভেচ্ছা জানিয়ে বিদায় নিলেন। এখানকার বিখ্যাত মন্দির বেশাখি-র নামে এই হোটেলটি। শব্দটির উৎপত্তি সম্ভবত সমুদ্রমন্থনের পৌরাণিক কাহিনীর চরিত্র বাসুকি থেকে। হোটেল চত্বর জুড়ে সবুজের সমারোহ। গাঢ় সবুজ লন, গ্রীষ্মপ্রধান দেশের ফুল-ফলের গাছ ইতস্ততভাবে ছড়ানো ছেটানো। একতলা, দোতলা কটেজ গুলির নির্মাণেও বালির স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য। আনাচে কানাচে রাখা স্থানীয় রীতির মজাদার সব পাথরের মূর্তি। মাঝরাতের উড়ানের ক্লান্তি আস্তে আস্তে মুছে যাচ্ছে এমন পরিবেশের সান্নিধ্যে। ঘরে ব্যাগপত্তর রেখে খাবারের সন্ধানে এগোলাম হোটেলের নিজস্ব রেস্তোরাঁর দিকে।

nasi goreng সানুর নাসি-গোরেং
সানুর নাসি গোরেং। ছবি অভিষেক খান।

বাগানের মধ্যে দিয়ে আঁকাবাঁকা পথটি গিয়ে মিশেছে সাদা বালির সৈকতে।  দিগন্তছোঁয়া মহাসাগর তখন বিকেলের রোদ মেখে শান্ত-সমাহিত। সৈকত লাগোয়া রেস্তোরাঁ ‘বাটু-বাটা’। মাথায় ছোট পাগড়ি আর লুঙ্গির মতো সারং পরিহিত এক কর্মী এগিয়ে এলেন। অচেনা মেনুকার্ড চিনে নিতে নিতে অর্ডার দেওয়া গেলো নাসি-গোরেং, ইন্দোনেশিয়ার ফ্রায়েড রাইস। সমুদ্রের ঢেউ গুনতে গুনতে সে সুস্বাদু খাবার উদরস্থ হলো নিমেষেই।

পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ সৈকত লাগোয়া টালি-বাঁধানো প্রশস্ত রাস্তা, পথচারী আর সাইকেল-বিলাসীদের জন্য। পড়ন্ত বিকেলটা উপভোগ করতে পথে রকমারি সাজ-পোশাকে নারী পুরুষ। ঝকঝকে নীল আকাশে উড়ছে রকমারি ঘুড়ি। হিন্দু অধ্যুষিত বালি দ্বীপে ঘুড়িকে মনে করা হয় ঈশ্বরের সাথে যোগাযোগের এক মাধ্যম। রংবেরঙের নানান আকারের ঘুড়ি উড়িয়ে বাচ্চা,বুড়ো সকলে ভক্তিতেই হোক বা আনন্দে, বালির আকাশ রাঙিয়ে রাখে দিনভর। ঘুড়িগুলির নামগুলিও বেশ, ‘বিবিয়ান’ হল মস্ত এক মাছ, ‘পেচুকান’ হল গাছের পাতা আর ‘জংগান’ হল পেল্লায় ল্যাজবিশিষ্ট এক পাখি!

সানুরের ঐতিহাসিক গুরুত্বও কম নয়। এখানকার বানজং মন্দিরে, ৯১৩ খ্রিস্টাব্দে এক শিলালিপি পাওয়া যায় যেখানে সংস্কৃতে খোদিত আছে ‘ওয়ালি দ্বীপ’ এবং রাজা কেশরী বর্মদেবের কথা।  এই ওয়ালি দ্বীপ আসলে বালি দ্বীপের আদি উচ্চারণ। আবার সানুর শব্দটির উচ্চারণও আদতে সাহ নুর, যার অর্থ ‘নতুন জায়গা দেখার কৌতূহল’। নতুন দেশে এমন জায়গা থেকে যাত্রা শুরু না করে উপায় কি!

রাস্তার একপাশে সার দিয়ে সুদৃশ্য হোটেল, রিসর্ট। প্রশাসনের প্রশংসা করতেই হয় হোটেলগুলির স্থাপত্যে উৎকট রীতিনীতির উপরে নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্য। অনেকখানি রাস্তা পেরিয়ে এসেছি ইতিমধ্যেই, আলোও কমে এসেছে অনেকটা। এবার ফিরবো কিনা ভাবছি, হঠাৎ ফস করে কোত্থেকে এক মাঝবয়সি ভদ্রলোক উদয় হলেন।  পরনে বালির বাটিক ছাপের জামা, মাথায় টুপি, হাতে চকচকে ট্যুরিস্ট-ম্যাপ। ভাবছি এ সেই টেনিদার গপ্পের হনলুলুর মাকুদার গোত্রের কেউ নয় তো! মিনিট খানেকের গৌরচন্দ্রিকা পরে বুঝলাম ইনি নেহাতই নিরীহ,ভদ্র এক ট্যুরিস্ট গাইড। খানিকক্ষণ কথাবার্তার পরে বুঝলাম এনার ভ্রমণ-প্যাকেজগুলির দক্ষিনা ঝাঁ-চকচকে অফিসওয়ালা সংস্থাগুলো তুলনায় বেশ কম।  কপাল ঠুকে, আগামী দুদিনের একটা প্রোগ্রাম ঠিক করে ফিরতি পথ ধরলাম।

হোটেল এর সামনের বিচে নুয়ে পড়া সার সার নারকেল গাছ আর মস্ত মস্ত বাদাম গাছ। পরেরদিন সকাল জুড়ে কেবল সমুদ্রস্নান আর বালির বিছানায় অলস অবসরযাপন। দুপুর গড়াতেই গাড়ি নিয়ে এসে হাজির গতকাল সন্ধ্যার সেই ট্যুর গাইড, নিওমান। আমাদের বালি ভ্রমণ শুরু হল উলুওয়াতু মন্দির দিয়ে। এ মন্দিরের অবস্থান দ্বীপভূমির একেবারে দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে। সে পথে যেতে গিয়ে বেনোয়া উপসাগরের ওপরে নির্মিত প্রায় ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ মান্দারা সি-লিংক ব্রিজ পেরোনোর অভিজ্ঞতাটি মনে রাখার মতো।

মন্দির প্রাঙ্গনে যখন ঢুকছি তখন ঘড়িতে প্রায় চারটে।  ১১০০ শতকে নির্মিত এই শৈব মন্দিরটির অবস্থান সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৭০ মিটার উঁচু একটা ক্লিফের উপরে। ক্লিফের কিনারা বরাবর বাঁধানো রাস্তা। রেলিঙের ওপারে অনেক নীচে কমলালেবু রোদ মেখে সফেন ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে খাড়া পাহাড়ের গায়ে, সে এক বাকরুদ্ধ সৌন্দর্য! মন্দির চত্বরে প্রবেশের আগে নারী-পুরুষ সবাইকেই পরে নিতে হলো বেগুনি রঙের সারং। নিওমানের কাছে জানলাম, মন্দিরের পুরোহিতরা পরেন সাদা সারং আর সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য বরাদ্দ অন্য রং। এর সাথে বালির পুরুষরা এক ধরণের হালকা পাগড়ি জাতীয় কাপড় জড়িয়ে নেন মাথায়। একে বলে উদান। মন্দির দর্শনের সময় পড়তে হয় সাদা উদান আর উৎসব-অনুষ্ঠানে যেকোনো রঙের উদান।

বালির মন্দিরগুলিতে মূলত বিষ্ণু, শিব, গরুড় – এই তিন দেবতা পূজিত হন। মূল মন্দিরে বালির নাগরিক ছাড়া আর কেউই প্রবেশাধিকার পান না। পর্যটক বা অন্য বহিরাগতরা কেবল মন্দির প্রাঙ্গনেই ঘোরাফেরা করতে পারেন। উলুওয়াতু মন্দিরের সান্ধ্য আকর্ষণটি হল ‘কেচাক’ নৃত্য।

অনেককাল আগে বালি প্রদেশের কোনো এক গ্রামে এক অজানা মড়ক লাগে। এর থেকে মুক্তির আশায় শুরু হয় ‘সাংঘিয়াং’ নাম এক রীতি, যেখানে দুটি তরুণী অর্ধচৈতন্য অবস্থায় কোনো অশরীরী আত্মার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে জেনে নেয় মুক্তির উপায়। সাংঘিয়াং-এর সময় আশেপাশের লোকেরা মুখ দিয়ে ‘কে-চাক-চাক-চাক’ বলে আওয়াজ করতে থাকে। ক্রমশ এই রীতিটির সাথে ‘রামায়ণ’-এর কাহিনী মিশে গিয়ে জন্ম নেয় এক নতুন নৃত্যরীতি ‘কেচাক’। রাম-সীতা-রাবণ-হনুমানের অরণ্যকান্ড, লঙ্কাকাণ্ডের মিশেলে গড়ে ওঠা কাহিনীতে একদল পুরুষ অভিনয় করে বানর সেনার ভূমিকায়। এরা কেবল মুখ দিয়ে ‘কে-চাক’ ধ্বনি তুলেই সঙ্গত করতে থাকে। অনেকটা বানরের ডাকের মতো এই আওয়াজই এই নাচের একমাত্র আবহ। পাহাড়ের ক্লিফের উপরে মুক্তমঞ্চে কলাকুশলীরা যখন নাচের হিল্লোল তোলেন, প্রকৃতি তখন অবতীর্ণ হয় চিত্রকরের তুলি হাতে। আকাশের ক্যানভাসে আঁকা হয়ে যায় ভারত মহাসাগরের ঢেউ-ভাঙা জলে ডুবতে থাকা সূর্যের এক মায়াবী সন্ধ্যাছবি।

(আগামী কিস্তি বুধবার)

তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী | মন তথ্য-ভারাক্রান্ত হলেই, ‘আপন হতে বাহির হয়ে’ বাইরে দাঁড়ানো | লৌকিক পৃথিবী, অলৌকিক প্রকৃতির সান্নিধ্যে পুনরাবিস্কার – দিনগত পাপক্ষয়, রাজনীতি আর যুদ্ধের বালখিল্যপনাটাই শেষ সত্য নয় | শেষমেশ ঘুরে ফিরে আসে তিনটি শব্দ –‘ভালোবাসা, পৃথিবী, ঈশ্বর’ |

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *