লাটাই এর বাবার চালকল বন্ধ হয়ে যাবার পর ওরা নাকি একবেলা খেত। এমন চলেছে বেশ কিছুদিন লাটাইকে দেখেছি অ্যাত্তো ফুচকা খেয়ে একপেট জল খেতে। এটা আশির দশকের কথা। তখন এক্কান্নবর্তী পরিবারের রেওয়াজ। রোজগারের মানুষ কম। দায়িত্ব একরাশ। বিয়ে পড়াশোনা অসুখ আতিথেয়তা খুচরো শখআহ্লাদ কিন্তু অসাধারণ একাত্মতা একে অপরের সঙ্গে। নানা ঝড়ঝাপটায় অসম্ভব ঐক্য। বারো মাসে তেরো পার্বণ। রোদ্দুর ভরা উঠোন। উন্মুক্ত খোলা মাঠ। গঙ্গার পাড়ে জাহাজ দেখতে যাওয়া। যাবতীয় মান অভিমান ভালোবাসা আক্ষেপ ভরা হাতে লেখা চিঠি। এসব জীবন্ত কিংবদন্তি হয়ে থাকা স্মৃতিকে যে হঠাৎ সোহাগ করছি, তার কার্যকারণ আছে একটা

মানুষের রক্ত মজ্জায় নস্টালজিয়া আর পোষ মানানোর প্রবণতা। বশ্যতা স্বীকার করে নেওয়া যে নেহাতই ঘটনা পরম্পরা বা নিয়তি এটা মেনে নেওয়া ও মানিয়ে নেওয়ায় বেশ দক্ষ তারা। 

সার্কাস তো একটা এক্কান্নবর্তী পরিবারই ভাঙতে ভাঙতে ক্রমশ ছোট হয়ে যাচ্ছে অনেকটাই। অনেক বিধিনিষেধ আইন আপত্তিত বিপন্ন। মানুষের সামাজিক জীবন যেমন। সন্ধ্যে হলেই লোডশেডিং, দুলে দুলে পড়া, হারমোনিয়ামতানপুরা নিয়ে রেওয়াজ, মুড়িমাখা, রকের আড্ডা, গলির প্রেম, চিঠি আদানপ্রদান, গানের কথাসুর, শীতের মাদুর সবই থাকবে নস্টালজিয়ার ফ্রেমে বাঁধানো। ধূলো পড়বে, কাচ ভাঙবে, আড়ম্বর হারাবে, নিখোঁজ হবে অলঙ্কারও। 

শীতের হিমেল হাওয়া বাড়ুক না বাড়ুক সার্কাস তার অস্তিত্বের পরিচয় দেবেই স্বমহিমায়।  সার্কাসের ছেঁড়া টিকিট আসলে যেন কমলালেবুর খোসার মতো। শীতের সমার্থক। লাটাইএর কথা মনে পড়েছিল সার্কাসের বাঘসিংহ নিয়ে ভাবতে গিয়ে। কারণ লাটাইএর বাবা মজুমদারকাকুই বলেছিল, “একবেলা আধবেলা খাইয়ে খাইয়ে বাঘ সিংহগুলোকে ওরকম ভেড়ার মতো করে রেখেছে! পাঁজরের হাড়গুলো দেখলি না? পুরো সারেগামাপাধানিসা বাজানো যাবে।” এরকম ধারণা ওঁর একার নয়, আরও অনেকেরই। আর যারা সুন্দরবন বা বান্ধবগড়ে বাঘ দেখেছে, তাদেরও নিজেদের সাধ্যমতো ভাষায় রাজা আর কারাগারে সর্বস্ব খোয়ানো বন্দির তুলনা টানতে শুনেছি। যদিও বাস্তবে এতে সার্কাসের রিং মাস্টারের বীরত্ব কিছু কমেনি। আক্ষরিক অর্থেই সে জীবন বাজি রেখেছে দিনের পর দিন মৃত্যুর থেকে হ্যান্ডশেক দূরত্বে ছড়ি ঘুরিয়ে। ও হ্যাঁ, একটা চাবুকও থাকত। যেটা আছড়ে পড়ার শব্দটাই মারাত্মক। 

কোনও এক সার্কাসের রিং মাস্টারের একটা সাক্ষাৎকার পড়েছিলাম বহুযুগ আগে। বাঘ সিংহের খেলা দেখাতে গিয়ে তাঁর মানসিক শক্তির প্রসঙ্গে কোনও হেঁয়ালি না করেই বলেছিলেন, “কে বলেছে আমি ভয় পাই না! ভয় আমারও করে। কারণ আমি জানি একজন যদি আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাহলে বাকিরাও তাকে অনুসরণ করবে। আমার কাজ হচ্ছে ওদের চোখের দিকে তাকিয়ে একটাই জিনিস বোঝানো, যতই তুমি হাঁকডাক করো, থাবা মারো, আমি তোমায় ভয় পাচ্ছি না। কারণ আমি ভয় পাচ্ছি বুঝতে পারলেই সব খেলা শেষ!” সবটাই মনস্তাত্ত্বিক খেলা। সেদিন মনে পড়ল একবেলা খেয়েও লাটাই ওয়ান ডে ফুটবল টুর্নামেন্টে একা টিমটাকে টেনেছিল ফাইনাল অবধি। কারণ ও ছিল জাত ফুটবলার। পুরনো যুগের মানুষ ওর দাদুর ভাষায় “বল লাত্থাইয়্যা কে কবে বড়লোক হইসে” টাইপ কিছু কারণে ওর ময়দানের নামী দলে খেলা ফুটবলার হওয়া হয়নি, সেটা আলাদা ব্যাপার।

যাইহোক, আগে সার্কাস মানে ছিল একটা মিনি চিড়িয়াখানা। বাঘ, সিংহ, হাতি, জলহস্তি, উট, ঘোড়া, কুকুর, ম্যাকাও, কাকাতুয়াসহ নানারকম পাখি। সেইসব বাঘসিংহের খেলা দেখানো এখন ইতিহাস বা রূপকথা। অন্যান্য প্রাণীদের সার্কাসে ব্যবহার করাও হয়ত আগামীতে আইন করে বন্ধ করে দেওয়া হবে। তাতে আকর্ষণ কমবে সন্দেহ নেই। যেমন কমেছে বাঘসিংহের অনুপস্থিতিতে। কমেছে জৌলুস। উত্তেজনা। উন্মাদনা। আগে যেমন বাড়ির লোকের সন্তানকে সার্কাস দেখাতে নিয়ে যাওয়াটা একটা আবশ্যিক বিষয় ছিল, এখন তেমন নেই আর। বরং মিউজিয়াম, তারামন্ডল, চিড়িয়াখানা বা নিদেনপক্ষে ছোটদের ইংরেজি ছবি দেখাতে নিয়ে যাওয়াতেই উৎসাহী সবাই। বর্তমান প্রজন্ম কতটুকু সার্কাস সম্পর্কে কৌতূলী, সেটাও যথেষ্ট সন্দেহের। এসব হয়ত তর্কের বিষয়। তবে অবশ্যই উড়োতর্কের কোনও জায়গা নেই। ওই যে বশ্যতার কথা বলছিলাম, সেটা তো আদিম প্রবৃত্তি। ঠিক যেমন বাড়ির খাঁচাবন্দি পাখিকে কথা শেখানো, বাড়ির পোষা কুকুর বিড়ালকে মুখের সামনে খাবার দিয়ে অনুমতির অপেক্ষায় থাকার শিষ্টাচার ও বিনয় শেখানো, তেমনই সামান্য ইশারা বা ইঙ্গিতে আগুনের বৃত্তের মধ্যে দিয়ে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের লাফিয়ে চলে যাওয়া এবং আরও নানা আনুগত্য এসব বিস্ময় চিরকালের প্রিয় মানুষের। 

ক্রমশ আমাদের শিক্ষাচেতনাজীবনবোধ শিখিয়েছে মানবিকতা। সমাজতাত্ত্বিকদের আর পশুপ্রেমীদের উদ্যোগে তৈরি হয়েছে বন্য জীবজন্তুর সুরক্ষা ও সংরক্ষণ আইন। তাই মানুষের মনোরঞ্জন করার দায়ভার মুক্ত হয়েছে বন্যপ্রাণীরা। বিষয়টা ভাগ হয়ে গেছে দুভাগে। বুদ্ধি-বিবেচনাবোধ আর হৃদয়। হৃদয় হয়ত চায় না অত্যাচারিত হোক বন্যপ্রাণী। কারোর অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার হোক। কিন্তু বিবেচনাবোধ বলে, এটা বিনষ্ট করছে একটা ঐতিহ্যকে। 

সার্কাস ক্রমশ নির্ভরশীল হয়ে গেছে মানুষের ব্যক্তিগত শ্রেষ্ঠত্বের উপর। ট্রাপিজের খেলা, বদ্ধ গোল বলয়ের ভেতর বিপজ্জনকভাবে মোটবাইক চালানোর খেলাবন্দুকে নিশানা এবং অবশ্যই জোকারদের কার্যকলাপের উপর। যেখানে হাস্যরসের মধ্যে কতটা বেদনা লুকিয়ে আছে দর্শক কোনওদিন জানতে পারেনি, পারবেও না। তাই পরিবর্তনশীল সময়ে সার্কাসের অস্তিত্ব কিছুটা বিপন্ন। এই ভাবেই হয়ত তৈরি হচ্ছে তাদের একান্নবর্তী পরিবারে ভাঙনের আবহ। 

তবুও সার্কাস বহু মানুষের জীবিকার মাধ্যম। বাড়ি পালানো ছেলে, রেডলাইট এলাকায় প্রায় বিক্রি হতে হতেও না হওয়া মেয়ের আশ্রয়ের ঠাঁই। নতুন পরিচয়ে বাঁচাতে পারার আলো। ট্রাপিজের দড়িতে হাত ধরে ঝুলতে ঝুলতে প্রেমে পড়েছে, তাদের বিয়ে হয়েছে, এমন উদাহরণও বিরল নয়। ঠিক যেভাবে চড়াই পাখি ফ্যানের ব্লেড থেকে বাঁচতে বাঁচতে একদিন ঘর বাঁধা শিখে যায় তেমনই তো!

সার্কাসের গোড়াপত্তনের ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায় ব্রিটিশদের হাত ধরেই ভারতীয় উপমহাদেশে সার্কাসের গোড়াপত্তন হয় ১৮৭৯ সালে রোমান উইলিয়ামসিরিন একটি ইতালীয় সার্কাসদল নিয়ে উপস্থিত হন কেরালায় সেখানে তিনি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন যে, সারাভারতে তার দলের কোনও খেলা নকল করে দেখানোর মতো উপযুক্ত কেউ নেই এ চ্যালেঞ্জ মহারাষ্ট্রের রাজা কুরুওয়ানদানের আত্মসম্মানে আঘাত করে তখন তিনি উইলিয়ামের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন তিনি তার অশ্বপ্রশিক্ষক এবং আরও দুই শিষ্যকে নিয়ে কঠোর পরিশ্রম করে বিভিন্ন খেলায় দক্ষতা অর্জন করেন এবং উইলিয়ামের সার্কাসদলের প্রদর্শিত খেলা একে একে নকল করে দেখান ভেঙে দেন রোমানের অহঙ্কার এরপর এই তিন ভারতীয় মিলে প্রতিষ্ঠা করেন একটি সার্কাসদল শুধু দল গঠনই নয়, প্রতিষ্ঠা করেন সার্কাস স্কুল

অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় একদা দশ বছরের এক বালক ছুটে এসেছিল একটি বিখ্যাত সার্কাস কোম্পানীতে। তখন তাদের শো চলছে সাড়ম্বরে। কাজ খোঁজে ছেলেটি। রাজি হন না কতৃপক্ষ। ছেলেটিও নাছোড়বান্দা। সে সার্কাসের তাঁবুর আশেপাশেই ঘুরতে থাকে। এই ভাবে কেটে যায় দু’দিন। এরপর সার্কাসের মালিক প্রায় বাধ্য হয়েই তাকে একটা কাজ দেয়। ক কাজ? তেমন কিছু না, যেটা বাচ্চা ছেলে পারবে তেমনই। গেটে টিকিট ছেঁড়ার কাজ ক্রমশ সে সার্কাসেই বড় হতে থাকে। জিমন্যাস্টিকসে পারদর্শী বললে ভুল হবে, তাকে দেখে নাকি মনে হতো  গোটা শরীরটাই রাবার দিয়ে তৈরি। সমস্যা একটাই উচ্চতা খুবই কম। সে জোকারদের দলের সদস্য হয়। পরবর্তীকালে ট্রেনার। এইভাবে তিরিশ বছরেরও বেশি সে সার্কাস পরিবারের সদস্য। তাকে বিয়ে করেছে সার্কাসের যে মেয়েটি, সে কাঁধে দুজন মানুষ, দুহাতে ম্যাকাও আর কাকাতুয়া নিয়ে দড়ির উপর দিয়ে হাঁটে তাদের সংসার পরিবার অস্তিত্ব সবটাই সার্কাসের সাতকাহনে সীমাবদ্ধ। তারা বর্তমানে বাঁচে, ভবিষ্যতের আতঙ্কটা হয়ত খুব ব্যক্তিগত আরও অনেক একান্ত অনুভূতির মতোই। 

শীতকাল থাকবে, মরসুমি ফলের খোসার মতো থেকে যাবে নস্টালজিয়া, বশ্যতা, অপ্রাপ্তির খেদ। হয়ত সার্কাস থাকবে না তখন। 

 

      

 

সত্তরের দশকের শেষের দিকে কলকাতায় জন্ম অভিরূপের। স্কুলজীবন থেকেই বাংলা সাহিত্যের প্রতি ঝোঁক। কলেজে বাংলা অনার্স নিয়ে পড়ার পাশাপাশি পুরোপুরি সাহিত্যে মনোনিবেশ। কিছুদিন ফ্রিলান্স সাংবাদিকতাও করেছেন। এরপরেই ঢুকে পড়া টেলিভিশনের জন্য স্ক্রিপ্ট লেখার আঙিনায়। সম্পূর্ণ আলাদা এক পরিবেশ এবং প্রস্তুতির সঙ্গে পরিচয়। একইসাথে চলতে থাকে গল্প-কবিতার পালা। দেশ, এই সময়, আজকের সম্পূর্ণা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে বেশ কিছু লেখা।

2 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *