চার দিকে মায়াবি নীল আলো। পেছনে বাজনা বাজছে। তাঁবুর নীচে এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে উড়ে বেড়াচ্ছে সাদা ঝিকমিকে ব্যালে ড্রেসের মতো শরীর জড়ানো পোশাক পরা ছেলেমেয়েরা। তারা ট্র্যাপিজের খেলা দেখাচ্ছে। তারা কি সত্যিই খেলা দেখাচ্ছিল, না কি ম্যাজিক! শিহরণ বুনছিল না কি রূপকথা!
চোখের পলক পড়ে না, হাত-পা নড়ে না, মুখ বন্ধ হয় না, বিস্ময় বাঁধ মানে না। ও দিকে হার্টের ধুকপুকুনি বাড়তে থাকে, উত্তেজনা গলায় এসে লাফালাফি করতে থাকে– ওই বুঝি শূন্যে এক জনের হাত ছেড়ে গেল, ওই বুঝি এক জনের পা থেকে খসে পড়ে গেল ছোট্ট একটা সাদা পাখি। কিন্তু না, কোথাও ভুলচুক নেই। কোথাও এক সেকেন্ডের বোঝাপড়ার অভাব নেই। কোথাও এন্টারটেনমেন্টের খামতি নেই।
এটাই তো আসল সার্কাস। সত্যিই দড়ির মধ্যে আটকা প্রাণ ও বিনোদন। আমার কাছে সার্কাস মানে ছোটবেলায় তো বটেই এখনও প্রধান আকর্ষণ ট্র্যাপিজের খেলা। এর বেশি বিশদ আমার সার্কাস উত্তেজনায় ঠাঁই পায় না।
তবে সার্কাসের যে উত্তেজনা উঠতি বয়সে মনে টান টান খেল দেখিয়েছিল, তা হল সার্কাস সিরিয়াল। অধুনা শাহরুখ খান তখন সার্কাস সিরিয়ালের হিরো আর আমরা সব্বাই তার একনিষ্ঠ হিরোইন। এ বাড়িতে আমি, পাশের বাড়িতে সোনালি, উল্টো দিকের বাড়িতে তেজিন্দর, আমরা সব্বাই তখন ট্র্যাপিজের দড়িতে ঝুলছি। একমাত্র বাঁচাতে পারে পুরু ঠোঁটের ছটফটে ছেলেটি, যে কিনা ফৌজি সিরিয়ালে অলরেডি আমাদের বুকে হিল্লোল তুলে পড়াশোনার বারোটা, মায়ের বকুনি, মনের উড়ুুউড়ু ভাব, দিবাস্বপ্নের ফ্রিকোয়েন্সি সবই বাড়িয়েছে।
সেই সিরিয়াল দেখে আমরা সার্কাসের কর্মীদের প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল হয়ে পড়েছি। প্রান্তিকদের প্রতি সংবেদনশীল হয়ে উঠেছি। হিরোর জন্যই সই কিন্তু অন্যের কষ্টের আখ্যান জানতে আরও বেশি খোঁজখবর করতে শুরু করেছি এবং সিরিয়ালের শেষের দিকে জীবনবিজ্ঞানের কোষ আঁকা ছেড়ে অনেক বেশি চিন্তিত হয়ে পড়েছি, যে শাহরুখ খান নিজের স্বার্থে সার্কাস বিক্রি করে দিয়ে চলে যাবে নাকি শেষ পর্যন্ত আমাদের হৃদয়ে যাতে তার প্রতি “খুদগর্জ কাঁহিকা” টাইপ অনুভূতি তৈরি না হয় সে জন্য সিরিয়াল ডিরেক্টর শাহরুখকে মহান পর্যায়ে উন্নীত করবেন। শেষটা বোধ হয় মিলমিশ হয়েই যায়, ঠিক মনে নেই। কিন্তু সেই শাহরুখ খানটাকে আমাদের উঠতি বয়সের মেয়েদের ভারী মনে আছে, যে কিনা আসমুদ্র হিমাচল সব মেয়ের মনে যথেষ্ট ও যথাযথ সার্কাস দেখাতে সমর্থ হয়েছিল, যে ট্র্যাপিজের এক্সপার্ট ব্যাটন অন্যের হাতে দিয়ে বোধ করি অন্যের সার্কাস দেখছে!
সঞ্চারী মুখোপাধ্যায় হাসিখুশি, এমনকী যখন সেই মোড-এ থাকেন না, নিজেকে ঠেলে হিঁচড়ে হিহিহোহো’তেই ল্যান্ড করানোর চেষ্টা করেন। জাপটে ভালবাসেন আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সিরিয়াল, গান, রাস্তায় নেড়িবাচ্চার লটরপটর কান। পড়াশোনার সময় ফিল্ড করেছেন, হাতুড়ি দিয়ে পাথর ভেঙেছেন, গ্রামবাসীদের তাড়া খেয়েছেন, এক বার পাহাড় থেকে অনেকটা হড়কে পড়ে মুচ্ছো গেছিলেন, উঠে দেখেন, কবর! এক বার ম্যানেজমেন্ট কোর্সের অঙ্গ হিসেবে চিন গেছিলেন, রাত্তির দুটোয় সাংহাইয়ের রাস্তায় হারিয়ে গিয়েও কাঁদেননি। ফিউজ সারাতে পারেন, পাখার কার্বন বদলাতে পারেন, কাগজের চোঙ পাকিয়ে গাড়িতে পেট্রল ঢালতে পারেন, চিনেবাদাম ছুড়ে দিয়ে মুখে নিপুণ লুফতে পারেন। ব্যাডমিন্টন খেলার ইচ্ছে খুব, কিন্তু জায়গা ও র্যাকেট নেই। অরোরা বোরিয়ালিস যারা দেখেছে, তাদের একাগ্র ভাবে হিংসে করেন। দেশের বাড়িটা উনি বড় হওয়ার পর ছোট হয়ে গেছে বলে, আর আমির খান এক বার কার্টুন এঁকে দিয়েছিলেন— সে কাগজ হারিয়ে গেছে বলে, জেনুইন কষ্ট পান। এক বার ঈগলের রাজকীয় উড়ান আগাগোড়া খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন।
nostalgic