সুকোমলের আজ খুব তাড়া। ঠিক সময়ে কেন, ঠিক সময়ের যথেষ্ট আগেই অফিসে পৌঁছাতে হবে। বস্ আসছে। মুম্বই থেকে। ওদের সঙ্গে মিটিং করবে। কোম্পানির পারফরম্যান্স দেখবে, ওদের ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সও। বাতাসে ভাসছে, এবার কেউ কেউ ঘচাং ফু: হতে পারে! সবাই ভাবছে,নআমি নই তো সেই বলির পাঁঠা! যে যার নিজের মতো করে কাগজপত্র, ডেটা, ডেমো তৈরী করে রাখছে। নজর রাখতে হচ্ছে, অবশ্যই গোপনে, বাকীরা কীভাবে এগোচ্ছে তার ওপর! আরেকজনকে খাদের ধারে না পাঠালে নিজে সেফ জোনে থাকতে যাবে না, এটাই সবার ভাবনা!
কিন্তু এত প্রস্তুতির পরেও সুকোমল আগের ট্রেনটা পেল না! একেই বলে নসিব! পরের ট্রেন ষোলো মিনিট পরে। টাইম টেবিল বলছে। আসবে অন্তত পঁচিশ মিনিট বাদে। হতাশায় প্লাটফর্মে একটা জোর লাথি কষায় সুকোমল, আর মুখে বলে ‘শিট’! ঠিক তখনই ওর চোখ পড়ে জুতো জোড়ার দিকে! এ কী হাল! এ তো ধুলোর পাহাড়! এই নিয়ে ও যাচ্ছিল বসের সঙ্গে মিটিং করতে! শুধু জুতোজোড়া দেখেই তো বস্ ওকে চাকরিতে নট করে দিত! ভাগ্যিস ট্রেনটা মিস করেছিল! এই জন্যই ভাগ্য মানে সুকোমল। ইস্তিরি করা জামার বোতাম খুলে গলায় ঝোলানো ঠাকুরের লকেটটা বের করে কপালে ঠেকায় ,তারপর প্লাটফর্মে বসে থাকা বাচ্চা পালিশওয়ালার কাছে এসে দাঁড়ায়।
‘এই ছোঁড়া, কত নিবি পালিশ করতে?’
বাপন।
আ্যঁ!
আমার নাম বাপন। ছোঁড়া না!
ওহো! বাপন! তা কত নেবে বলো বাপ আমার! আই মিন, বাপন!
কুড়ি টাকা!
বলিস কী! কুড়ি! পনেরো নে!
কুড়ি! বাপনের মুখে নির্লিপ্তি।
আচ্ছা কর,কর।
সুকোমল ওর জুতোসুদ্ধ পা বাড়িয়ে দেয়! বাপন ওকে একজোড়া হাওয়াই এগিয়ে দেয়। বলে,এইটা পায়ে দিয়া জুতা দুটা খুইলা দ্যান! সুকোমল শুধোয়, আ্যই ,তুই বাঙাল! ওপার বাংলার মাল?
মানুষ! আবার বাপন সংক্ষিপ্ত উত্তরে ফিরে যায়।
কী বলিস?
বলি,মাল না মানুষ!
ও হ্যাঁ, শিওর শিওর। মাল না মানুষ। ঠিক ঠিক! সুকোমলের কথার মধ্যে থেকে ছিটকে আসা বিদ্রূপ বাপনের গায়ে এসে লাগে। তবে ও কিছু না বলে জুতোর ওপর ক্রিম লাগায়! মোজার ওপর হাওয়াই চটি পরে সুকোমল এদিক ওদিক করতেও পারে না, টাইম পাস করতে ওর বাপনই ভরসা তাই কথা চালিয়ে যেতে চায়। তোদের আধার আছে, ভোটার কার্ড?
আপনেদের?
সুকোমল এতক্ষণে বুঝে গেছে, কোনো প্রশ্ন করলে পাল্টা প্রশ্ন করে উত্তরটা এড়িয়ে যেতে চায় বাপন। সুকোমলেরও রোখ চেপে যায়। ও ছেলেটার ভাষাতেই বলে,বাপ আইছে তোমার এ দ্যাশে? না শুধু পোলাপানগোর পাঠাইছে? কী রে! বল! কাম অন! সুকোমল বুঝতে পারে, ওর ভাষা শুধু নয়, বলার কথাগুলোও গুলিয়ে গেছে। এটা ওর রাগের প্রকাশ! একটা পালিশওয়ালা ছোকরা জিগ্যেস করে, ওর আধার কার্ড আছে কী না! এতে রাগ হবারই কথা! সুকোমল ব্যানার্জি আই এস ও নাইন থাউজ্যান্ড ওয়ান মার্কা দেওয়া কোম্পানিতে চাকরি করে, কোম্পানির পয়সায় এরোপ্লেনে চড়ে আজ মুম্বই, কাল ব্যাঙ্গালোর করে বেড়ায়, কোম্পানিকে মোটা টাকার বিজনেস দেয়, বছর বছর ফর্ম সিক্সটিন ফাইলে পুরে রাখে, রিটার্ন জমা করে—- ধাক্কাধাক্কি করে ঢুকে পড়া এক বেয়াড়া ছোকরা কিনা ওকে জিগ্যেস করে, ওর আধার কার্ড আছে কী না!
বাপন বলে,কী হল,চুপ মেইরে গ্যালেন যে! অই জন্যি আমারে কেউ চুলকায় না, জুতা কালি করি তো! যেকোনো হময়ে মাইনষের মুয়ে কালি দিবার পারি! খানিকটা দম নিয়ে আবার বলে, যাক গে যাক, ছাড়ান দ্যান। জুতা পরেন, কুড়িটা ট্যাহা দ্যান!
পরের ট্রেনের খবর হয়ে যাওয়ায় সুকোমল হাঁপ ছেড়ে বাঁচে!
সুকোমল প্রায় অকারণেই রেগে গিয়েছিল, সেই রাগ গিলেই ওকে ট্রেনে উঠে পড়তে হল।
ট্রেনে যে ভিড়ের কথা ও কল্পনা করেছিল,সে ভিড় নেই, তবে বসার জায়গাও নেই। এদিক-ওদিক তাকিয়ে ও দেখল,একটা সিটে তিনজন বসে। ও এগিয়ে এসে বলল, দাদা, একটু চেপে বসুন তো। তিনজনের মধ্যে কাকে ও দাদা বলে চেপে বসার আবেদন করল,বোঝা গেল না, তবে তিনজনই একটু নড়াচড়া করল। তাতে একটুও জায়গা তৈরী হল না। সুকোমল অধৈর্য হয়ে বলল, কী হল, চাপুন,বসব তো! ব্যাস, লেগে গেল বচসা! তৃতীয় জন বলল কোথায় বসবেন, কোলে?
—কোলে বসব না মাথায়, সে দেখা যাবে, আপনি সরে বসুন। সুকোমল এই বলে ওর অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই শুরু করল।
জানলার ধারে যিনি বসেছিলেন, তিনি অপেক্ষাকৃত প্রিভিলেজড। এই বিতন্ডায় সরাসরি যোগ দেওয়ার চেয়ে জানলার বাইরে চোখ রাখাই তিনি পছন্দ করলেন। তারই মাঝে একবার বললেন, চার নম্বরে বসলে একটু তো আ্যডজাস্ট করতে হবেই! কেবল মধ্যবর্তী জন কিছু বলছেন না, নিজেকে যতটা সম্ভব টানটান করে বসে আছেন। বসার ভঙ্গীই বলে দিচ্ছে, পক্ষ নেবার ব্যাপারে দ্বিধাই ওনাকে নিরপেক্ষ করে রেখেছে। সুকোমল চতুর্থ জন হয়ে কোনোরকমে একটু ঠেকায়, আর অনুভব করে প্রান্তিক হয়ে পড়েছে ও! পাল্টা তর্কের স্পৃহা অনুভব করছে না!
‘যে কোনো মুহূর্তে বস্ ঢুকবেন’ এই আ্যমবিয়েন্স তৈরী হয়ে রয়েছে অফিসে। সুকোমল পিঠ থেকে ব্যাগ নামিয়ে নিজের চেয়ারে এসে বসে, বোতল থেকে ঢকঢক করে জল খায়। জল খাওয়ার আওয়াজটা ওর নিজের কানেই বেঢপ ঠেকে, মনে হয়, অন্তত আজকের জন্য এই অফিসরুমে তৈরী হওয়া সমূহ পবিত্রতা এই আওয়াজে বিঘ্নিত হবে, কিন্তু বিকল্প পথ ভেবে ওঠার আগেই ওর শরীর বাকি জলটুকু টেনে নেয়!
প্রবালের চাকরি চলে গেল! ঠিক ‘চলে গেল’ বলা যায় না, ম্যানেজমেন্ট ওকে রিজাইন করতে বলেছে। পাওনা গন্ডা নাও,পথ দেখো। প্রবাল চিঠিতে লিখবে স্বেচ্ছায় চাকরি ছাড়ার কথা! যদি না ছাড়ে! সুকোমল অবস্থাটা কল্পনা করে! ওর রাগ দু:খ কিছুই হয় না, শুধু ভয় করে! সুকোমলের চাকরি বেঁচে গেছে, ওর আনন্দ হওয়ার কথা! কিন্তু ও ভয় পায়! এ তো মিউজিক্যাল চেয়ার! একটা চেয়ার তুলে নেওয়া হয়েছে। এখন পাক খেতে খেতে, নিজেকে একটা চেয়ারে ঠেকিয়ে দিতে হবে! সে জন্য পাশের জনকে হটাতে হবে, কনুই মারতে হবে,ল্যাং মারতে হবে! খেলার পরিচালকরা একটা চেয়ার কম রেখেছেন। এবারের জন্য। পরের রাউন্ডে আরেকটা কমবে। এইভাবে চেয়ার যত কমবে, উত্তেজনা তত বাড়বে! যে খেলার যা নিয়ম। প্রবাল এই রাউন্ডে ছিটকে গেছে মানে সুকোমল বা ওর মতো বাকিরা সেফ, আপাতত!
কি রে,বাড়ি যাবি তো! আরেক বেঁচে যাওয়া সহকর্মী অলোক পিঠে ঠেলা মারে! সুকোমল এলোমেলো ভাবনা ছেড়ে ব্যাগ কাঁধে ওঠে। প্রবালকে দেখা যায় না। আগে বেরিয়ে গেছে। পরাজিত মানুষরা বরাবরই একা! সুকোমলের জিতে গেছে, ওকে পালাতে হয়নি।
স্টেশনের পালিশওয়ালা ছেলেটার কথা হঠাৎ মনে পড়ে সুকোমলের। নামটা কিছুতেই মনে পড়ে না! বড্ড ট্যারা ট্যারা কথা। পালিয়ে তো যায়ই না, বরং তেড়ে আসে! তবে কি ও নিজেকে পরাজিত মনে করে না! অথচ নানা আয়োজনে বারবার বলা হচ্ছে, ওরা বাড়তি, ফালতু। ওদের জন্য আমাদের সর্বনাশ! দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেই কি ওরকম ট্যারা কথা আসে! সক্কাল সক্কাল সুকোমল কিন্তু ছেলেটার কাছে বেশ ঝাড়ই খেয়েছিল বলা যায়। তখন মটকা গরম হয়ে গেছিল, এখন দিনের শেষে ওকে কেন যেন ভালো লেগে যায়।
বাড়ি ফিরে খেতে বসে মা বলে, আমি জানতাম তোর খারাপ কিছু হবে না। সুকোমলের চোখে জ্বালা ধরে। মা’কে প্রবালের কথা ও বলে নি। বিশেষ কোনো কথাই বলেনি বাড়ি ঢুকে। যেটুকু জানানোর কথা, তা সংক্ষিপ্ততম কথায় সেরেছে। মা বলে চলে, ক’দিনের দুধ জমেছিল, একটু পায়েস করেছি। এখন দিই?
সেলিব্রেশন! টিঁকে যাবার জন্য! প্রবালও নিশ্চয়ই এখন খেতে বসেছে। নাকি আজ ডিনার স্কিপ করল! একটা ফোন করব করব করেও সাহস করে ফোনটা করে উঠতে পারেনি সুকোমল। মা পায়েসের বাটি সামনে এনে দিয়েছে। সুকোমল বাঁ হাতে ফোনটা নেয়। পায়েল হোয়্যাটসআ্যপ করেছে, এতক্ষণ দেখেই নি!
ছোট্ট মেসেজ! ’সবার খবর ঠিকঠাক? কাল দেখা হচ্ছে!’ পায়েল সবার কথা জানতে চায়! সবাইকে নিয়ে বাঁচার কথা ভাবে! পায়েল সুকোমলকে আগামীদিনের ভরসা জোগায়!
সকালের ছেলেটার নামটা হঠাৎ করেই মনে পড়ে যায় সুকোমলের। বাপন। বাপনের কথা পায়েলকে বলবে ও। পায়েল সকলের ‘ঠিকঠাক’ থাকার কথা জানতে চেয়েছে। যারা বাপনকে, সুকোমল, প্রবালদের পায়েলদের নানা ভাবে, নানা স্থান থেকে উৎখাত করতে চায়, তাদের চোখে চোখ রেখে কথা বলার ভরসা দেয় বাপন, স্বপ্ন দেখায় পায়েল!
সুকোমল চামচে করে পায়েস মুখে তোলে, আর ফোনে প্রবালের নামে আঙুল ছোঁয়ায়। একটা নতুন আগামীকাল ওর সামনে হাতছানি দেয়!
পেশায় স্কুলশিক্ষক। বিষয় বাংলা সাহিত্য। বর্তমানে হালিশহরের বাসিন্দা। সাহিত্যের প্রতি একনিষ্ঠ দীর্ঘদিন ধরেই। ইতিমধ্যেই দুটি ছোটগল্প সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। একটির নাম তৃতীয় প্রহর। অপরটি পূর্বাপর।
Real life story, excellent!
সুন্দর। ভাল লাগল।
খুব ভালো লাগল