হাওয়া অফিসে পারদ আঠেরো ডিগ্রিতে নামতে না নামতেই বাঙালির শীত হনুমানটুপিতে গিয়ে ওঠে। তারপর হিম হিম রাতে মিঠে নরম লেপঘুমে তলিয়ে যাবার দিনে ত্বকে লাবণ্য আনে মৌলি শুধু মৌলি গ্লিসারিন। বাঙালির শীতে সব আছে। গুড় আছে, পিঠে আছে, পার্ক স্ট্রিট আছে, আছে টিকলো নাক গোলাপি গাল কাশ্মীরি শালওয়ালা পর্যন্ত। নেই শুধু বরফ। না না যে বরফ টুং টাং করে খালি গ্লাসে পড়ে সে বরফ নয়, যে বরফে বলিউড শিফন-সুন্দর, যে বরফে গোলগাল তুষারমানবের নাকে কমলা গাজরশোভা, ভূগোলের ফেরে সেই বরফ মানে তুষার আমাদের ভাগ্যে জোটেনি। আমাদের ছোটবেলাকার ফ্রিজে অবশ্য আইস এবং স্নো অর্থাৎ বরফ এবং তুষার দুইই মিলত। কেলভিনেটরের ওপরতলাকার খুপরিতে হাত ঢুকিয়ে কুরে কুরে বের করে আনা যেত সাদা ঝুরঝুরে নরম বরফ আর অ্যালুমিনাম ট্রে ঠুকে ঠুকে বের করা হত চৌকো বরফের টুকরো। এখনকার ফ্রিজ অবশ্য স্মার্ট, তাতে বাড়তি কিছু পাওয়ার আশা নাই। এখন আমরা জানি, নিশুতি রাতে কাঠের ছাদের ফাটল পেয়ে যখন তুষারকণা ঝিরঝিরিয়ে নেমে এসে নিভিয়ে দেয় বনফায়ারের আগুন, কনয়্যাকের বোতল তখন শেষ হয়ে আসে আর আমাদের হয়ে উঠতে চাওয়া ইচ্ছেরা লাল হল্টার নেক ড্রেস পরে একহাঁটু দুধসাদা বরফে গড়াগড়ি খেয়ে গেয়ে ওঠে, “ম্যায় চলিইইইই বনকে হাওয়াআআআ…।“

এসবের শুরু যশ চোপড়ার হাত ধরে সেই ১৯৭৬ সালে। এর আগেও অবশ্য বলিউড রাজ কপুরের সঙ্গম, শম্মি কপুরের জঙলি কিংবা কাশ্মীর কি কলির হাত ধরে টুকটাক ঘুরে এসেছে কাশ্মীর, ইউরোপের পাহাড়ে। কিন্তু ম্যাজিক বলতে আমরা যা বুঝি, তা মিস্টার চোপড়ার হাতযশেই আমরা প্রথম উপলব্ধি করতে পারি। বিগ বি তখনও এত বিগ নন আর রাখী গুলজারের তখনও রাঙাপিসিমা হয়ে ওঠার ঢের দেরি। বরফে ঢাকা কাশ্মীরি উপত্যকায় কোটি কোটি ললনার বুকে ঝড় তুলে চিতাছাপ গরম জ্যাকেট পরা রাখীর কোলে মাথা রেখে অমিতাভ গেয়ে উঠেছিলেন “কভি কভি মেরে দিল মে খয়াল আতা হ্যায়…।” বলিউডে তুষার ম্যাজিকের সেই শুরু। কাশ্মীরের ঢেউ খেলানো উপত্যকায় ঘুরে ঘুরে বরফ-জমাট বেঁধেছে রুপোলি পর্দার প্রেম, শিথিল হয়েছে সামাজিক অনুশাসন, উচ্ছ্বল যৌবনের বেপরোয়া খাদ বেয়ে তিরতিরিয়ে নেমেছে লতা মঙ্গেশকরের রিনরিনে গলার “ইয়ে কাহাঁ আ গয়ে হম, ইঁউহি সাথ সাথ চলতে” আর আমরা আরও একটু জড়িয়ে পড়েছি যশ চোপড়ার বোনা নবপ্রেমজালে। সেটা ১৯৮১ সাল। সিলসিলা ছবির শুটিং হলো কাশ্মীর আর নেদারল্যান্ডসে। তুষার আর টিউলিপের প্রেক্ষাপটে ঝড় তুলল রেখা অমিতাভের আগুন কেমিস্ট্রি। তারপর ভূস্বর্গে রাজনৈতিক ডামাডোল শুরু হতে আশির দশকের শেষ দিক থেকে রোম্যান্টিক হিন্দি ছবির লোকেশন প্রায় পাকাপাকিভাবে পাড়ি দিল সুইজারল্যান্ড। সেই সঙ্গে লক্ষ করা গেল, আমাদের নায়িকাদের আর শীত করছে না। নায়কের জন্য সোয়েটার জ্যাকেট টুপি দস্তানা বরাদ্দ হলেও, দেখা গেল নায়িকার জন্য স্রেফ একখানা শিফনের শাড়িই যথেষ্ট। কিন্তু প্রেমের সামনে, শীত কখনোই ধোপে টেঁকেনি। শ্রীদেবীর শিফনবিলাসের সামনে ভোঁতা হয়ে গেছে যুক্তি তক্কের ধার।

বলা বাহুল্য বাজার অর্থনীতির হাত ধরে বাঙালিরও পদোন্নতি ঘটেছে। অন সাইটে আজকাল তুষার সহজলভ্য। আউলি নয়, আল্পসেই এখন মধ্যবিত্তের তুষারযাপন। বলিউডও আরও ‘এক্সটিক’ লোকেশনের খোঁজে কখনো জর্জিয়া কখনো পেত্রায় পোঁছে যায়। আমাদের কাজল আর শারুক্ষান-রূপী নস্টালজিয়াই শুধু মাঝেমাঝে নবযৌবন পেয়ে বরফ হৃদের ধারে ধারে গেয়ে বেড়ায় ‘রঙ দে তু মোহে গেরুয়াআআআ’।

পল্লবী বন্দ্যোপাধ্যায় আকারে স্থূল, প্রকারে কুল এবং জোকার-এ মশগুল। ভালোবাসেন মার্ভেল, ডিসি, আর যা কিছু ফিশি। পূর্বজন্মে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী ছিলেন। বর্তমানে বাংলার নেশায় বুঁদ। পরজন্মে গল-দের গ্রামে খোলা আকাশের নীচে গোল টেবিলে নৈশভোজের আসরে বসে বুনো শূকরের রোস্ট খেতে চান।

2 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *