আধো অন্ধকারে কয়েক পা এগনোর পরেই ঝরা-পাতার মধ্যে কোনও কিছু নড়াচড়ার একটা খসখস শব্দ কানে এল অরিত্রর। সঙ্গে সঙ্গে সাবধান হয়ে গেল সে। এখানে সাপ-টাপ আছে নাকি? থাকতেই পারে, যা গাছপালা ঘেরা ফাঁকা ফাঁকা সব বাগানওলা বাড়িঘর। তবে এই শীতের রাতে সাপের তো গর্তের মধ্যে ঢুকে গভীর ঘুম দেওয়ার কথা। তাহলে? দাঁড়িয়ে পড়ে অরিত্র আন্দাজ করার চেষ্টা করল আওয়াজটা ঠিক কোত্থেকে আসছে। ভাল করে নজর করতেই চোখে পড়ল, রাস্তার এক পাশ ঘেঁষে কান খাড়া করে দাঁড়িয়ে আছে একটা পুঁচকে কুকুর। নির্ঘাত ইনিই দুষ্মন্ত, পেছন থেকে দেখেই চিনল অরিত্র। উৎসুক হয়ে দুষ্মন্ত দেখছে বাড়ির লোকজন কোথায় খুঁজতে গেল তাকে। কিন্তু তার হাবভাব তো এই মুহূর্তে ঠিক রাজার মত নয়। ঠান্ডায় হোক বা ভয়ে, এখন তো রীতিমত সিঁটিয়েই আছে পমেরেনিয়ানটা। তাই এখনও খেয়াল করেনি তাকে।
– কুর্চি, তোমার কুকুর এখানে, চিৎকার করে বলল অরিত্র।
চকিতে ঘুরে অরিত্রর মুখোমুখি দাঁড়াল দুষ্মন্ত। অন্ধকারেও ঝকঝক করে উঠল তার চোখের দুটো তারা। ওদিক থেকে কুর্চি আর বসন্ত একসঙ্গে ডেকে উঠল ‘দুষ্মন্ত, দুষ্মন্ত’ বলে। দুষ্মন্ত ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল কিছুক্ষণ, কিন্তু সে ডাকে সাড়া দেবার কোনও চেষ্টাই দেখা গেল না তার মধ্যে। অরিত্রকে আরও একবার দেখে নিয়ে যেদিক থেকে ডাক আসছে তার উল্টোদিকে মুখ করে দুষ্মন্ত উঠে এল রাস্তার মাঝামাঝি।
কুকুরটা আবার পালাবে নাকি? না, সেটা হতে দেওয়া যায় না, সতর্ক হয়ে গেল অরিত্র। ততক্ষণে ‘দুষ্মন্ত, দুষ্মন্ত’ ডাক এগিয়ে এসেছে অনেক কাছাকাছি, শোনা যাচ্ছে তাদের পায়ের শব্দও। দুষ্মন্ত একটা স্পষ্ট ‘উফ’ বলে দৌড় লাগাতে গেল উল্টোদিকে। কিন্তু এ বল এত সহজে গলে যেতে দেবে অরিত্র? স্বভাবসিদ্ধ ক্ষিপ্রতায় কুকুরটার পেটের দু’দিকে দু’হাত চেপে অরিত্র তাকে বাঁ বগলের নিচে চালান করে ফেলল, ডান হাতে টেনে ধরল তার কলার, যাতে কামড়াতে না পারে।
কিন্তু তার মধ্যেই হয়ে গেল যা হওয়ার। অরিত্রর বাঁ হাতের কব্জির ঠিক ওপরে দাঁত বসিয়ে দিল অভিমানী রাজা দুষ্মন্ত। হাত এতটুকু আলগা না করে ‘আআআ—‘ বলে চেঁচিয়ে উঠল অরিত্র, মাথা বেঁকিয়ে দেখল রক্তের ফোঁটা উঠে আসছে হাতের চামড়ার ওপর দাঁতের দাগ ভেদ করে।
মুহূর্তের মধ্যে কুর্চি, বসন্ত আর দেবদীপ তিনজনেই পৌঁছে গেল তার কাছে। দুষ্মন্তকে নিজের কোলে তুলে নিল কুর্চি, বসন্ত টর্চের আলো ফেলল ক্ষতের ওপর। ‘আমার গোলকিপারের বাঁ হাত!’ বলে স্তম্ভিত হয়ে গেল দেবদীপ।
তারপর আধঘণ্টা কেটে গেছে। ছুটে গিয়ে বাড়ি থেকে ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে এসে দেবদীপের বাড়ির বসার ঘরে অরিত্রর শুশ্রূষা করছে কুর্চি। অরিত্র নিজে বেশ রিল্যাক্সড। কিন্তু ঘরের মধ্যে একটানা পায়চারি করে চলেছে দেবদীপ, এক মুহূর্তও স্থির হয়ে বসেনি। হঠাৎ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠে বলল, “স্টিচ করতে হবে, তার সঙ্গে অ্যান্টি র্যাবিজ় ইঞ্জেকশন! এখানে এসব হবে কিনা কে জানে! হয়ত ছুটতে হবে সেই দুর্গাপুর। রক্ত বন্ধ হয়েছে এই ঢের, তুই আর দেরি করাস না কুর্চি। ছাড় এবার, আমরা রওনা হয়ে যাই।”
“তাড়াহুড়োর কিচ্ছু নেই। বলছি না বারবার, দুষ্মন্তকে ডিস্টেম্পার থেকে র্যাবিজ়, সব রকম অসুখের ভ্যাকসিন দেওয়া আছে।” ঝুঁটি নাড়িয়ে বলল কুর্চি। “আর স্টিচ করবে কি? যা শক্ত হাত তোমার গোলকিপারের, দাঁত বসাতেই পারেনি দুষ্মন্ত। চামড়া একটুখানি কেটে রক্ত বেরিয়েছে, এই যা। আমি দিলাম তো ড্রেস করে। মনে হয়, আর কিছুরই দরকার হবে না। তবুও কাল একটা টিটেনাস ভ্যাকসিন দিয়ে দিতে পারো। আর হাসপাতালে যদি যেতেই চাও, দুর্গাপুর নয়, আর একটু এগিয়ে রাঁচিতে যাও। ওখানেই ওর ঠিক চিকিৎসা হবে।” বলে ওর ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে উঠে দাঁড়াল কুর্চি। বাইরে বারান্দার এক কোণে দুই হাঁটু জড়িয়ে কাঁচুমাচু হয়ে বসে ছিল বসন্ত। বোঝা মুশকিল শীতে না বিড়ম্বনায়। কুর্চিকে বেরোতে দেখে সেও চলল পিছুপিছু। অরিত্র বারান্দায় বেরিয়ে এসে বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ।” কুর্চি উত্তর না দিয়ে ডান হাতটা একবার মাথার ওপর তুলে এগিয়ে গেল।
দেবদীপের গম্ভীর মুখে হাসির আভাসটুকুও নেই। তার সতর্ক মন বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করছে, মাত্র চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মিনিটের চেনাশোনায় অরিত্র আর কুর্চির সম্পর্কের রসায়ন এমন সুগন্ধ ছড়াচ্ছে কেন? সম্পর্কটা কি শুধুই পারস্পরিক কৃতজ্ঞতার? হাতে কামড় খেয়েও কুর্চির কুকুর ধরে দিয়েছে অরিত্র। আন্তরিক যত্নে নিপুণ হাতে সেই ক্ষতের শুশ্রূষা করেছে কুর্চি। দুজনেরই কৃতজ্ঞ বোধ করার কারণ আছে। কিন্তু তাদের চোখের ঔৎসুক্য, শরীরী ভাষার স্নিগ্ধতা যে নিছক কৃতজ্ঞতার সীমানা ছাড়িয়ে অন্য দিগন্তে ডানা মেলতে চাইছে! এ কি তার বোঝার ভুল, পরচর্চার কৌতূহল, নাকি সেই সহজাত দক্ষতা যা সন্দেহজনক গন্ধ চিনতে ভুল করে না? দেবদীপ কিছুতেই নিশ্চিত হতে পারছে না। কুর্চিকে বিদায় দিয়ে বারান্দা থেকে বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই অরিত্রকে বলল, “কুকুরের কামড় থেকে অনেক কিছুই হতে পারে। রিস্ক নেব কেন? ঘন্টাখানেকের তো রাস্তা। চল, ঘুরেই আসি দুর্গাপুরের হাসপাতাল থেকে।”
অরিত্র অবশ্য হাসপাতালে ছোটার প্রস্তাবে মোটেই কান দিল না। বলল, “ভীষণ খিদে পেয়েছে দেবুদা। রাসুদাকে বল আর দেরি না করে খাবার দিয়ে দিতে। মাংস রান্নার কী সুন্দর গন্ধ বেরিয়েছিল, আর এখন দেখ শুধু ওষুধের গন্ধ!”
(পরবর্তী পর্ব আগামী সোমবার)
আগের পর্ব পড়তে হলে – https://banglalive.today/goalkeeper-an-episodic-novel-on-relationships-and-social-norms/
আদতে ছিলেন সাংবাদিক, তারপর কর্পোরেট কর্তা। অবসরের পর শান্তিনিকেতনে বসে লেখাজোকায় মন দিয়েছেন। বেশ কিছু প্রবন্ধ আর গল্প লিখেছেন আজকাল, অনুষ্টুপ আর হরপ্পা-য়। প্রথম উপন্যাস 'গোলকিপার' প্রকাশিত হয়েছে বাংলালাইভে। আপাতত ডুবে রয়েছেন ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে। আজকালের রবিবাসর ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর ধারাবাহিক রচনা - সিনেমাতলার বাঙালি।