সেই পৌষ আর নেই, এখন তো মাইক্রোওয়েভ বিক্রি হয়! এই অভিযোগটা শুনছি বহুদিন ধরে। ভয়ানক ভিড়, দাঁড়ানোর জায়গা পাওয়া যায় না। হোটেলগুলো গলা কাটে। এত আক্ষেপের পরেও শান্তিনিকেতনের পৌষমেলায় ভিড় উপচে পড়ে প্রতিবছর।

পৌষ কেন, আবহাওয়াটাই তো ঘুরে গেছে দুনিয়া জুড়ে। মেলার শুরুর ব্যাপারটা দেখে নিই। ১৮৯৪ সালে দেবেন্দ্রনাথের আমলে ব্রাহ্ম মন্দির, এখন যা কাচঘর, তার সামনের মাঠে ছোটখাটো ঘরোয়া মেলা শুরু হয়েছিল পৌষ মাসের ৭ তারিখ থেকে। কৃষিকাল উদযাপনই এর মূল উদ্দেশ্য ছিল। পরে চেহারায় দ্রুত বৃদ্ধি পায় এই মেলা, সারা বীরভূম থেকে লোক আসতে শুরু করে। এখন তো মিনি পশ্চিমবঙ্গ বলা যেতে পারে। পৌষমেলা বরাবরই স্থানীয় মানুষদের ব্যবসার জায়গা, বাৎসরিক মিলনভূমি। রবীন্দ্রনাথও সেভাবেই দেখেছেন। ‘ধর্মভাব উদ্দীপনের জন্য’ মেলার প্রস্তাব রেখেছিলেন দেবেন্দ্রনাথ। আজ অবশ্যই তা নয় । কিন্তু শান্তিনিকেতনী সংস্কৃতির স্পর্শ সর্বত্র। ভোরের আলোয় বৈতালিকের সঙ্গীতানুষ্ঠান, ছাতিমতলায় উপাসনা আজও উপস্থিত। ক্রিসমাস ইভে সেজে ওঠে আশ্রম, প্রদীপের আলোয়। মেলা হয় মস্ত জায়গা জুড়ে, ভুবনডাঙার মাঠে। মূল মেলা তিন দিনের। ২৩ তারিখ থেকে শুরু। এবছর ভিড় ও পরিবেশ সমস্যা সামলাতে ভাঙা মেলার মেয়াদ কম হবে এটা ধরে নেওয়া যায়।

মেলার মধ্যাঞ্চলে বাউল-কীর্তনীয়াদের মঞ্চ, গান চলে চব্বিশ ঘন্টা। একটু মন দিয়ে শুনলে খেয়াল করবেন, এই লোকসঙ্গীতে দিব্বি উপচে পড়ে সাম্প্রতিক দুনিয়ার রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের চেহারা। স্রেফ প্রাচীন গানের পুনরাবৃত্তি, এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। মেলার পশ্চিম প্রান্তের বড় অংশ জুড়ে হস্তশিল্পের সমাহার। বিকনার ডোকরা, বাঁকুড়ার টেরাকোটার ঘোড়া, দুমকার ধাতুর গয়না, নানারকম কাঠের জিনিস, সবার প্রিয় প্যাঁচা, মাটির পুতুল, বাঁশের, বেতের জিনিস ছাড়াও কাপড়ের, চামড়ার ব্যাগ, অজস্র সস্তা খেলনা, বাঁশি, ভেঁপুর কোলাহল সর্বত্র। স্বীকার করতেই হবে, প্লাস্টিকের দৌরাত্ম বেশি।

উত্তর প্রান্ত অভিযুক্ত অঞ্চল। সেখানে আধুনিক জীবনের পসরা ভারী নিশ্বাস ফেললেও তা পৌষমেলার পরিবেশ কলুষিত করে এমন মনে হয় না। ‘সে আমলে’ মোটর বাইক পাওয়া যেত না, আজ যায়, তাই সে উপস্থিত। সেকালের গরুর গাড়ির কাঠের চাকা আজ অদৃশ্য। আগের মতই গরম জামা, কম্বল, রান্না ও চাষের রকমারি সরঞ্জাম দেদার বিকোয় রমরমিয়ে। এখানে মাংস নিষিদ্ধ, বরাবরই। কিন্তু সস্তায় গ্রামীণ সুখাদ্য, মিষ্টির অভাব নেই। হ্যাঁ, পাটিসাপ্টা, ভাপা পিঠে আজও পাওয়া যায়। বাদাম, পাঁপড় সর্বত্র। ভাজাভুজি, চাট, ফুচকা থাকবেই, তবে অন্যতম আকর্ষণ ‘মথুরা পাক’ অর্থাৎ দিশি ডোনাট। ‘হরেক মাল দশ টাকা’র প্রাইস রিভাইজ্ড হয়েছে।

মেলার পূর্বপ্রান্তে ভিড় বেশি। ওখানেই পর পর নাগরদোলা, উত্তেজক রাইড, বিকট ম্যাজিক এবং আদি অকৃত্রিম বাইক ও গাড়ি নিয়ে ‘মরণ ফাঁদের খেলা।’ এছাড়া ছড়িয়ে ছিটিয়ে মাটির হাঁড়িকুড়ি, ঝুড়ি, তিরধনুক, বইয়ের দোকান, জামা কাপড়, সস্তা শাড়ি, কাঁথা স্টিচ, পাটের নব্য সামগ্রী, সরকারি বেসরকারি কৃষি কেন্দ্র, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, আঁকা ছবি, আর্টের জিনিস, আচার-মোরব্বা, অভাব নেই কিছুরই। বেশ খানিকটা জায়গা নিয়ে বিশ্বভারতীর শিল্প প্রদর্শনী, বইয়ের দোকানে শান্তিনিকেতনের সনাতন ভাবধারার অনেকটাই খুঁজে পাবেন, নিশ্চিতভাবে বলা যায়। ভিড়ে, চিৎকারে, ঘোষণায়, গানে, আড্ডায় মেলা জমজমাট। শীতের সকাল দুপুর রাতে বিচিত্র চেহারা তার। শেষ দিনে বাজির আয়োজন। আজকের পৌষমেলার অন্তহীন উন্মাদনার কারণ খুঁজতে চাইলে সশরীরে, সবান্ধবে, সপরিবারে ভিড়ে মিশে যাওয়াই শ্রেয়।

তাহলে হারিয়ে গেছে কারা?

নেই ‘কালোর দোকান’, সংস্কৃতি জগতের শিরোমণিদের মিলন তীর্থ। শান্তিদেব ঘোষ, দেবব্রত বিশ্বাস, কণিকা, সুচিত্রা শুধু পৌষমেলা নয়, আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন নক্ষত্রলোকে, বহুদিন আগেই। এঁদের স্থান কতখানি পূরণ হয়েছে তা বলা মুশকিল। আগের আর এখনকার পৌষমেলার অরিজিনালিটি নিয়ে তর্ক চলবেই, এর ফাঁকে পড়ে নেওয়া যাক প্রিয় রানুকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠি  “… এখানে মেলায় অন্ততঃ দশ হাজার লোক তো হয়েইছিল।… এখানকার মাঠে যা চিৎকার হয়েছিল তাতে কত রকমেরই আওয়াজ মিলেছিল, তার কি সংখ্যা ছিল। ছোটো ছেলের কান্না, বড়োদের হাঁকডাক, ডুগডুগির বাদ্য, গোরুর গাড়ির ক্যাঁচকোঁচ, যাত্রার দলের চিৎকার, তুবড়িবাজির সোঁ সোঁ, পটকার ফুটফাট, পুলিশ-চৌকিদারের হৈ হৈ, হাসি, কান্না, গান, চেঁচামেচি, ঝগড়া ইত্যাদি ইত্যাদি।”

শুভময় মিত্র আদতে ক্যামেরার লোক, কিন্তু ছবিও আঁকেন। লিখতে বললে একটু লেখেন। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে অনেকরকম খামখেয়ালিপনায় সময় নষ্ট করে মূল কাজে গাফিলতির অভিযোগে দুষ্ট হন। বাড়িতে ওয়াইন তৈরি করা, মিনিয়েচার রেলগাড়ি নিয়ে খেলা করা, বিজাতীয় খাদ্য নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করা ওঁর বাতিক। একদা পাহাড়ে, সমুদ্রে, যত্রতত্র ঘুরে বেড়াতেন। এখন দৌড় বোলপুর পর্যন্ত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *