“আজগুবি চাল বেঠিক বেতাল

মাতবি মাতাল রঙ্গেতে

আয় রে তবে ভুলের ভবে

অসম্ভবের ছন্দেতে।”

লিখেছিলেন তাঁর বাবা। খেয়ালরসের এমন গভীর ধারায় যাঁর জন্ম এবং বেড়ে ওঠা, সেই সত্যজিৎ রায় তাঁর নিজস্ব ঘরানার অদ্ভুতুড়ে কল্পনাকে ভাষা দিলেন- ছবিতে এবং গল্পে। খাঁটি ননসেন্সে যেমন দুনিয়ার চেনা সব যুক্তি আর অবয়বকে ছিঁড়ে ফেলেছিলেন সুকুমার রায়, সেই ননসেন্সের জায়গা থেকেই সত্যজিৎ এর পথচলা শুরু হল।

এখানে সত্যজিৎ বলতে ছোটদের গল্পকার এবং ছোটদের ছবি করিয়ে সত্যজিৎ রায়ের কথা বলা হচ্ছে। খুব সংক্ষেপে বললে, ওই সুকুমার রায়ের কথা মতোই ‘অসম্ভবের ছন্দ’-টিই হচ্ছে সত্যজিতের এই নিজস্ব ননসেন্সের প্রাণ ভোমরা। মজা এই যে শুধু ননসেন্সকে আমাদের চোখের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েই ক্ষান্ত হন না সত্যজিৎ, তাকে রীতিমতো একটি যুক্তিগ্ৰাহ্য ভিত্তিও প্রদান করেন। সেই যুক্তি, বোঝাই যায়, ‘এ প্লাস বি হোল স্কোয়্যার’-এর নিখুঁত গণিতের সঙ্গে মিলবে না। তবে তা বলে তাকে ঘোর ‘অবৈজ্ঞানিক’ বলতে গেলেও কীরকম অস্বস্তি হয়। বলা যেতে পারে, ‘ট্রান্স-লজিক্যাল’। অর্থাৎ, অযৌক্তিক ঠিক নয়, যুক্তির দিগন্ত ছাড়ানো কোনও এক অলৌকিক সম্ভাব্যতা। আর এই সম্ভাব্যতার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে সত্যজিতেরই একদম নিজের দুটি বৈশিষ্ট্য- এক, স্পষ্ট বাঙালিয়ানা; দুই, আন্তর্জাতিক মন। ছোটদের জন্য যখন তিনি লিখছেন- কিংবা ছোটদের না বলে, কিশোরদের জন্য বলাই বোধহয় ঠিক, অর্থাৎ টিন-এজার্সদের জন্য, তখনও কিন্তু তিনি ভুলে যাচ্ছেন না যে তাঁর গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র যারা হবে, তাদের আচরণ বা কার্যকলাপেই স্পষ্ট বোঝা যাবে ওই দুটি গুণ- বাঙালি এবং বিশ্বলোকের মিশেল। সেই মিশেলের নাম কখনও হতে পারে প্রদোষ মিত্র বা আরও একটু চেনা নাম, ফেলু মিত্তির। কখনও আবার প্রফেসর ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু।

ধুরন্ধর গোয়েন্দা ফেলু মিত্তিরের কাজকর্মের কাঠামোটাই এমন যে সেখানে যুক্তির জালকে নিটোল রাখতে হবে। গোয়েন্দা গল্পে আজব কল্পনাপ্রবণ হওয়ার সুযোগ নেই। টানটান, একেবারে দম বন্ধ করা ঘটনার জটিল পাকের মধ্যে থেকে সত্য খুঁজে আনেন ফেলুদা । আর মাঝে মাঝে, তারই মধ্যে, যুক্তির বুলেটকে ভাসিয়ে দিয়ে লালমোহনবাবু ওরফে বিখ্যাত রহস্যকাহিনী লেখক জটায়ুর একেকটি মন্তব্যে ওই ননসেন্সের ঝাপট এসে পড়ে। যেমন, ‘সোনার কেল্লা’-তে একেবারে শেষ পর্বে চেজিং সিকোয়েন্সে জটায়ুর সেই অমোঘ অবিস্মরণীয় উক্তি- “উট কি কাঁটা বেছে খায়?”

তবে এগুলি নিছক ব্যতিক্রম। খুব সার্থকভাবে যে চরিত্রটির মধ্যে দিয়ে সত্যজিৎ তাঁর নিজস্ব ননসেন্স, বিজ্ঞান-মনস্কতা, বাঙালিত্ব এবং আন্তর্জাতিক গড়নটিকে মেলাতে পারলেন, তিনি প্রফেসর শঙ্কু। দেখতে একদম গড়পড়তা বাঙালি বৃদ্ধের মতো, মাথাজোড়া টাক এবং চশমা পরা এই বৈজ্ঞানিক গিরিডিতে থাকেন, ভোরবেলা মর্নিং ওয়াকে বেরোন এবং বেড়াল পোষেন। তার প্রতিবেশীরাও আপাদমস্তক বাঙালি, অবিনাশ মজুমদার এবং নকুড়বাবু। এদের কথ্য ভাষা অনায়াসে বাগবাজারের সাবেকী ‘ঘটি’ বুলির সঙ্গে মিলবে। আবার এদের নিয়েই বিশ্বখ্যাত বৈজ্ঞানিক ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কুর দুনিয়াজোড়া পর্যটন। সব কিছুই চেনা, অথচ এত স্বাভাবিকভাবে সত্যজিৎ লহমায় এই চেনা আবরণের গভীরে অচেনা এক পৃথিবীকে তুলে আনেন যে কোনওমতেই তাকে অস্বাভাবিক বলা যায় না।

আর্থর সি ক্লার্ক বা আইজাক আসিমভের ধারায় ধ্রুপদী সায়েন্স-ফিকশন লিখছেন না সত্যজিৎ তার শঙ্কু কাহিনিতে। চুলচেরা বৈজ্ঞানিক তথ্য হাজির করে গল্পকে দাঁড় করানোরও চেষ্টা নেই। শঙ্কু নিজেই নিজের যুক্তিগ্ৰাহ্যতার মাপকাঠি স্থির করে নেন। এবং এই পর্যটনবিলাসী বাঙালি বৃদ্ধের বিজ রয়ে গিয়েছিল সুকুমার রায়েরই একটি লেখায়- হেঁশোরাম হুঁশিয়ারের ডায়েরি। সেখানে তিনি লিখছেন,

২৬শে জুন, ১৯২২ — কারাকোরম, বন্দাকুশ পাহাড়ের দশ মাইল উত্তর। আমরা এখন সবশুদ্ধ দশজন — আমি, আমার ভাগ্নে চন্দ্রখাই, দুজন শিকারী ছক্কড় সিং আর লক্কড় সিং আর ছয়জন কুলি। আমার কুকুরটাও সঙ্গে সঙ্গেই চলেছে।’

সুকুমার রায়ের এই লেখা পাশাপাশি রেখে তুলনা করাই যায় শঙ্কু কাহিনী ‘একশূঙ্গ অভিযান’-এর এই অংশটুকুর সঙ্গে:

১৫ই আগস্ট। চাং থাং — ল্যাপ ৩২.৫৯, লং ৮২ই। বিকেল সাড়ে চারটা। চাং থাং অঞ্চলের ভয়াবহ চেহারাটা ক্রমে আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে আসছে। এই জায়গার উচ্চতা সাড়ে ষোল হাজার ফুট। আমরা এখন একটা অসমতল জায়গায় এসে পড়েছি। ….

হেঁশোরাম হুঁশিয়ারের ক্ষেত্রে খেয়ালরসটাই মুখ্য ছিল। বিশ শতকের শেষ দিকে নিজস্ব কায়দায় শঙ্কুর বিজ্ঞান-নির্ভর কান্ডকারখানা লিখতে বসে সত্যজিৎ সেই জিনিসটি বাদ দিলেন বটে- কিন্তু যা থেকে গেল, সেটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, ন্যারেটিভের ধাঁচ, যেন একটার পর একটা ডায়েরির পাতা পড়ে চলেছি আমরা। দুই, অতীন্দ্রিয় একটি পরিবেশ। কোনও চেনা যুক্তিবুদ্ধির ছকে যেমন প্রফেসর হেঁশোরামের দেখা ল্যাগব্যাগর্নিস বা চিল্লানোসোরাসের জগৎকে ধরা যাবে না, তেমনই শঙ্কুর স্বচক্ষে দেখা আশ্চর্য নন্দনকানন ‘ডুংলুং ডো’-ও তো পৃথিবীর যাবতীয় হিসাব-নিকাশের বাইরে। বিশ্বজোড়া মানুষের কল্পনা সেই স্বর্গোদ্যানে প্রাণ পায়। সেখানকার কোনও প্রাণিকেই রোগ, শোক বা জরা ছুঁতে পারে না। সেখানে ঘুরে বেড়ায় ড্রাগন, ইউনিকর্ন আর ফিনিক্স। এই জগতকে বিশ্বাস করার রাস্তাও শঙ্কুই বাতলে দেন- “অনেক দেশের অনেক লোক অনেক কাল ধরে যদি এমন একটা জিনিস বিশ্বাস করে যেটা আসলে কাল্পনিক, তাহলে সেই বিশ্বাসের জোরেই একদিন সে কল্পনা বাস্তব রূপ নিতে পারে।”

এই ‘বাস্তব’ রূপ নেওয়া কল্পনাই শঙ্কু কাহিনীর মূল চাবিকাঠি। সঙ্গে রয়েছে সত্যজিৎ রায়ের গভীর মানবতাবাদ। বিজ্ঞানে যখনই কোন ক্ষমতালোভীর হাতে পড়ে মানুষের সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তখনই ত্রাণকর্তা হিসাবে দেখা দেন শঙ্কু। আবার আশ্চর্য ভাবে বিজ্ঞানের সিঁড়ি বেয়েই শঙ্কু চলে যান সেই অসম্ভবের ছন্দে। দেখা যায় যে যান্ত্রিক মস্তিষ্ক ‘কম্পু’-ও ধীরে ধীরে বৃদ্ধ হচ্ছে এবং একসময় সে জেনে ফেলছে সেই তথ্য যা এ পর্যন্ত কোনও মানুষ জানতে পারেনি- মৃত্যুর পরের কথা।

কঠোর বৈজ্ঞানিক লজিকের যেখানে শেষ, সেখান থেকেই এই নয়া ত্রিলোকেশ্বরের যাত্রা শুরু। না হলে কী ভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে জাদুকর চি-চিংয়ের অদ্ভুত ইন্দ্রজালকে? সেই ইন্দ্রজাল, যা শঙ্কুকেও হতবাক করে দিয়েছিল? কিংবা সেই আশ্চর্য প্রতিভাধর ‘খোকা’, যাবতীয় বৈজ্ঞানিক গবেষণা যার মুঠোর মধ্যে? কবিতা পড়তে গেলে অবিশ্বাসকে সরিয়ে রাখতে হয়, এমনটাই জানিয়েছিলেন কোলরিজ। শঙ্কুর গল্পের ক্ষেত্রেও তাই। আর কথাটা এই যে সত্যজিতের লেখা পড়তে পড়তে কখন যেন ভেসে যায় যাবতীয় অবিশ্বাস। বই থেকে চোখ তুললেই দেখা যায় সেই বৃদ্ধ বিজ্ঞানীকে। বুঝতে পারি সেই উশ্রি নদীর ধারে গিরিডিতে সব কিছুই আছে, একদিকে বাঙালিত্ব, অন্য দিকে ভুবনজোড়া টান।

প্রফেশর ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *