“শীত নামলে পার্ক স্ট্রিট তখন বিলেত হয়ে যেত…” স্মৃতির পাতা উল্টোতে গিয়ে বলেছিলেন কিংবদন্তী জ্যাজ গিটারিস্ট কার্লটন কিটো। সেই কার্লটন,যিনি ভারতে তথা কলকাতায় খুলে দিয়েছিলেন জ্যাজ-দিগন্ত। দুনিয়াজোড়া নাম সত্ত্বেও এ শহরে ভালোবেসে থেকে গিয়েছিলেন। সত্তরের দশকের উত্তাল কলকাতায় পার্ক স্ট্রিটের মুল্যাঁ রুজ-এ শুরু করেছিলেন লাইভ জ্যাজ বাজনা। ব্যান্ডের নাম জ্যাজ অনসম্বল। তারপর প্রেম। এই শহরের সঙ্গে। ময়দান-মোক্যাম্বো-ট্রাম আর শীতের কেক-বাক্সের গন্ধের সঙ্গে। রিপন স্ট্রিটের এঁদো গলিতে বছর কয়েক আগে পর্যন্তও শোনা যেত তাঁর গিটারের সুর। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও ধরে রেখেছিলেন জ্যাজের পরম্পরা বছরের পর বছর।

৭৩ বছরে মারা যাওয়ার আগে পর্যন্ত পার্ক স্ট্রিটের সামপ্লেস এলস, ট্রিঙ্কাস, মোকাম্বো, চৌরঙ্গী বারে নিয়মিত বাজাতেন কার্লটন। তাঁর বিবপ জ্যাজ শুনত অবাক হয়ে কলকাতা। জ্যাজের জটিল এক ধারা এই বিবপ। নাচতে গেলেই বিপদ এই জ্যাজে। এমনই তাল। বাধ্যত বসে শুনতে হবে আপনাকে। বন্ধু নন্দন বাগচী, লিউ হিল্টের সাথে নিয়মিত এই জ্যাজ বাজাতেন কার্লটন। সেই মুহুর্ত কিছু ধরা আছে অঞ্জনের ছবিতেও। কখনও কখনও শোনা যেত ঊষা উত্থুপের ভারি গলাও। বড়দিনের সেই পার্ক স্ট্রিটকে মনে হত লাস ভেগাস।

কিন্তু ক্রমেই বোদ্ধাদের বদলে বানিয়ারা দখল করল পার্ক স্ট্রিটের মৌরসিপাট্টা। বন্ধ হতে শুরু করল পুরনো রেস্তরাঁ। ব্যক্তিগত পার্টিতে বাজিয়ে রোজগার শুরু করলেন কার্লটনের মত অনেক বাজিয়ে। জমানা বদল গয়া! সাহেবপাড়ার অলি-গলি-চলিতে আগে যে সুরে গিটার বাজত, সে সুর বেপথু হল। অরণ্যচারী বঙ্কিমী নায়কের মতো কংক্রিটের জঙ্গলে কেবলই থতমত খেতে লাগল সে।

তবে হারিয়ে যে যায়নি এখনও, তার প্রমাণ মিলল কলকাতায় তিন দিন ধরে হয়ে চলা জ্যাজ ফেস্টে। ২৯, ৩০ নভেম্বর ও পয়লা ডিসেম্বর শহরে উথলে পড়ল যৌবন। ডালহৌসি ইন্সটিটিউটকে সহসা মনে হল উডস্টক। দুনিয়াজোড়া প্রখ্যাত মিউজিশিয়ানরা এসে বাজালেন আবারও। সঙ্গে কলকাতার নিজস্ব জ্যাজ ব্যান্ড। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গান-পাগলদের মাঝে সামিল হল তারুণ্যও। জ্যাজের মতোই যাদের জীবনের ছন্দও কিছুটা এলোমেলো। কারও মাথায় ট্যাটু, কারও প্যান্টে গ্রাফিতি। ছেঁড়াখোঁড়া। এলোমেলো। জ্যাজের সুরের মতোই।

শীত এসেছে। তাই আজকাল সন্ধ্যা নামে দ্রুত। বাদুড় ঝুলে থাকে গাছে। ঝিমোয়। একা লাগে গাছেদের। মানুষেরও। তাই হাত ধরতে ইচ্ছে করে। ওম পেতে ইচ্ছে করে। ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে প্রেম করতে। ভরে থাকতে। কিন্তু সব কিছু শুকিয়ে আসে কেমন। সাপের চেরা জিভ লকলকায়। পার্ক স্ট্রিটে নিওন জ্বলে ওঠে। চিতাবাঘের চোখ হলুদ ট্যাক্সির। কবরখানায় খসে পড়ে তারা। পেস্ট্রিতে কামড় দেয় স্কার্ট-ব্লাউজ। নলেনগুড়ে পিঁপড়ে ঘুরঘুর। উনুন-ধোঁয়ায় ঝাপসা লাগে শরীর। গরম জামায় ন্যাপথলিন। গ্লিসারিনের গন্ধ। জানলায় জানলায় টুনি। বিয়ে বাড়ি আর জন্মদিন। কত উৎসব! ফ্যান নেভানো থাকে। শোনা যায় পাশের বাড়ির সব ফিসফাস। মনে পড়ে অঞ্জনের জ্যাজ আঙ্গিকে বিলিতি সুরের গান। মনে পড়ে চায়না টাউন, পার্ক স্ট্রিট, লিটল রাসেল স্ট্রিট, বো ব্যারাক, ভবানীপুর, মৌলালি। কলকাতার ভেতর অন্য কলকাতা। আর অন্য মানুষগুলো। যাদের বাঙালি তেমন আপন করেনি কখনওই। কিন্তু তারা রেখে গেছেন তাদের ব্লুজ, জ্যাজ এই বাংলায়। যুগ যুগ ধরে।

ডালহৌসি ইন্সটিটউটে ঢুকে থেকে এ সব এতোল বেতোল ভাবনারা উড়ে বেড়াচ্ছিল সন্ধেয়। ইন্সটিটিউট সেজে উঠেছে বাহারি টুনিতে। পরতে পরতে ঘিরে কুয়াশা। গেট ঠেলে ঢুকে পড়লে ফিকে হয়ে আসবে বাইরে পার্ক সার্কাসের জ্যাম। সামনেই যিশু। আপনার দিকে তাকিয়ে। পাশের গাছে হরিণের শিঙে ঝোলানো রাংতা। হাওয়ায় ক্রিমের গন্ধ। বিলিতি পারফিউমেরও। আরেকটু এগোলে সারি সারি খাবার আর পানীয়ের স্টল। অন্য দিকে মঞ্চ। সামনে খোলা আকাশের নীচে শ্রোতারা। ধীরে ধীরে ভিড় বাড়ছে। শিল্পীরাও ঘুরে বেড়াচ্ছেন ভিড়ে। চেনা কলকাতাটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে যায় এখানে।  ফ্রান্স, জার্মানি, আর্মেনিয়া, নরওয়ে থেকে এসেছে নানা ব্যান্ড। গ্রেট হ্যারি হিলমার, ডক ইন অ্যাবসলিউট, মেডি গারভিলের মতো সব আন্তর্জাতিক নাম। তাদের বাজনা শুনতে এসেছেন নীল দত্ত, অমিত দত্তর মতো মিউজিশিয়ানরা।

লিথুয়ানিয়ার দাইনিউস পুলস্কাস আর সুইজারল্যান্ডের দ্য গ্রেট হ্য়ারি হিলম্যান মঞ্চ মাতাবে আরও একটু পর। তার আগে প্রথম ব্যান্ড বোধিসত্ত্ব ট্রায়ো। কলকাতার দল। জ্যাজ থেকে গভীর অনুপ্রাণিত ভাবে অনুপ্রাণিত আদি বাংলা ব্যান্ড মহিনের ঘোড়াগুলির ধারাতেই কাজ করছে বোধিসত্ত্ব ট্রায়ো। গানের পাশাপাশি পিছনে পর্দায় চলছে ভিশুয়াল। বিমূর্ত নানা ছবি। বিকল্প ব্রহ্মাণ্ডের গল্প বলছেন তারা। খুব অন্ধকার একটা জ্যাজ সুর। নাচা যাবে না এর সাথে। পানপাত্রে চুমুক দিচ্ছেন কেউ কেউ। কেউ কেউ হারিয়ে যাচ্ছেন তালে। মাথা দুলছে। শ্রোতারা রিদমের শেষে বলে উঠছে, চিয়ার্স। বলছে, উফ গুরু! সেই সুরেই আসছে পরের স্ট্রামিং। কিন্তু খাঁটি জ্যাজের থেকে কিছুটা দূরেই যেন বা থাকতে চান বোধিসত্ত্ব ট্রায়ো। তাই দাইনিউস পুলস্কাসের জন্য অপেক্ষা করতে হল কিছুক্ষণ। তারপরেই বেজে উঠল স্যাক্সোফোনের মদির মূর্চ্ছনা। প্রপার জ্যাজ। শ্রোতারা তালে তালে নাচতে শুরু করলেন। জমে উঠল ভিড়। কেমন ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে হঠাৎ! মনে হচ্ছে, এ কলকাতাকে তো আমি চিনিনা! এই রাস্তা কি বেভারলি হিলস? এই মত্ত কনকনে বাতাস কি নিউ অর্লিয়ঁ থেকে ভেসে এল?

আস্তে আস্তে জমাট বাঁধছে অন্ধকার। তরুণ-তরুণীরা আগুনের টানে পতঙ্গের মতো জড়ো হচ্ছে। কে যেন শুধোল, “আরে তুই এখানে? কেমন লাগছে?” হেমন্তের হাওয়ার মতো রিনরিনে হাসির শব্দ ডানা মেলল জবাবে। উত্তর এল- “এখানে তো ছোটবেলা থেকে আসছি রে। বাবা প্রথম এনেছিলেন। এখন প্রায় একটা উত্তরাধিকার বলতে পারিস। কিম্বা আমাদের বন্ধুত্বের মৌচাক! সব বন্ধুরা সম্বচ্ছরে একবার জ্যাজের মধু খেতে এখানে আসি। শীতের মতোই রহস্যময় জ্যাজ মিউজিক। খুবই ভাবতে হয়। গত একশো বছর ধরে এ ধারা কলকাতায়। ক’জন জানে বলতো!”

সত্য়িই বোধহয় তাই। কারণ কিছুদিন পর এই কলকাতাই রাত জেগে দেখবে-শুনবে ডোভার লেন মিউজিক কনফারেন্স। বাউল ফকির উৎসব। কবীর সুমন, অঞ্জন দত্ত, বাংলা রক। ধীরে ধীরে আবার সকলে ভুলে যাবে এই সাব-কালচারের কথা। এমনটাই বলছিলেন উদ্যোক্তারা। তবু তাঁরা নাছোড়। জানালেন, মাঝের কিছু বছর মন্দা গেছিল। ঠিক মত করা যায়নি ফেস্ট। কিন্তু এখন আবার স্বমহিমায়। 

অন্ধকার ঘন হতে থাকে ক্রমশ। জ্যাজের সুরে ঘন হয় ধোঁয়াশা। হাতের পানপাত্রে পেগের বাহারে জড়ায় কথা। শাল জড়িয়ে নেয় সুন্দরীকে। প্রেমিক প্রেমিকাকে। আগুন জ্বলে ফায়ার প্লেসে। আবছায়া অচেনা তরুণ-তরুণীরা আধো অন্ধকারে চিনে নিতে চায় একে অপরকে। আলাপ করে। জানতে চায় নাম-কাজ-ভালোলাগা-ভালোবাসার কথা। হালকা হাসির মিশেলে তার সপ্তকে ওঠে স্যাক্সোফোন। আমার মনে পড়ে কলেজ ফেস্টের কথা। মনে পড়ে, কতদিন হয়ে গেল কলেজ ছেড়েছি। স্মৃতির সুরেও কি জ্যাজ থাকে? কে জানে! মনে হয়, আবার কবে শ্বাস নেব এই অনন্য়তায়। কলকাতার ভেতর আমার এক টুকরো বিলিতি কলকাতায়। আমাদের জীবনের লনে আজন্ম জ্বলে থাক এই জ্যাজ-ফেস্ট। জ্বলে থাক যৌবন। যেমন জ্বলছে শুকনো কাঠ ফায়ার প্লেসের আগুনে। চিৎকার করে উঠছে ভিড়, চিয়ার্স!

পেশা মূলত, লেখা-সাংবাদিকতা। তা ছাড়াও, গান লেখেন-ছবি বানান। শখ, মানুষ দেখা। শেল্ফ থেকে পুরনো বই খুঁজে বের করা। কলকাতার রাস্তা ধরে বিকেলে ঘুরে বেড়ানো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *