আমাদের এই মহান দেশে ভাতের থালা থেকে শ্বাসের বায়ু যতই দুর্লভ হোক না কেন, দেবতার যোগানের কমতি নেই। পাথরে খানিক সিঁদূর লেপে সামনে কয়েক কুচি ফুল, কিম্বা দেয়ালের গায়ে প্রস্রাব রুখতে দেবতার ছবি দেওয়া টালি, এপাড়া বেপাড়ার মোড়ে শনিবার শনিবার খুপরি ঘরে শনিপুজো… রোখে কার সাধ্যি। এমন মানবজমিন রইল পতিত, আবাদ হচ্ছে মন্দির মসজিদ! হামলে পড়ছে ভক্তের দল। শঙ্খঘণ্টাধূপুধুনো আর ভক্তিভাবে মুখরিত চৌদিক। 

সেই ভক্তিরসপাত্রেই নবতম সংযোজন গাছ-ঠাকুর! মধ্যপ্রদেশের সাতপুরা ব্যাঘ্র প্রকল্পে ব্যাঘ্রকূলকে নিয়ে আপাতত বিশেষ মাথাব্যথা নেই কারওই। মানুষ উপচে পড়ছে গাছ-ঠাকুরের দর্শনে। কী গাছ? একটি বড়সড় মহুয়া গাছ। জনান্তিকে বলা হচ্ছে, গাছের নাকি জাদুশক্তি রয়েছে! আপনার কি শরীর খারাপ? মন খারাপ? বিয়ে হচ্ছে না? পরীক্ষায় ফেল? ছেলে অবাধ্য? ফিকর নট! আসুন, গাছকে জড়িয়ে ধরে মাথা ঠুকুন, মনের দুঃখ জানান, পুজো দিন। সব সেরে যাবে। তাই তো গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে তিলধারণের জায়গা নেই মহুয়া-বাবার চারিপাশে! শুধু কি মধ্যপ্রদেশ? খবর ছড়িয়ে পড়েছে ভিন রাজ্যেও। দলে দলে আসছেন ভক্তেরা। কারও হাতে নারকেল। গাছের গোড়ায় ফাটাবেন। কারও হাতে ধূপের গোছা। গাছের গোড়ায় পুঁতবেন। কারও হাতে লেবু, কারও হাতে পিদ্দিম, কারও হাতে মালাচন্দন… উপচারের শেষ নেই। সঙ্গে আসছেন ভাগ্যাহত আত্মীয়ের দল। মহুয়া বাবা, বাবা গো… মুখ নামিয়ে দেখো বাবা। শোনা যাচ্ছে, বাবা নাকি রীতিমতো দেখছেন! কাজেই, তর্ক বহুদূর! 

এই যেমন ষাটোর্ধ্ব পুণারাম কুঁয়াহি। মধ্যপ্রদেশেরই অমরওয়াড়া এলাকা থেকে এসেছেন। গাছের দিকে চেয়ে ভক্তিভরে পেন্নাম করে জানালেন, গায়ের ব্যথায় পঙ্গু হওয়ার উপক্রম হয়েছিল তাঁর। “হাঁটতেই পারছিলাম না। শুধু শুয়ে থাকতাম। তারপর একদিন এই গাছের কথা শুনলাম। এখানে এসে বাবার গায়ে একবার হাত বোলাতেই ব্যথা একেবারে গায়েব।“ পুণারামের দাবি। এমন পুণারামে এলাকা উপচোচ্ছে। কারও দাবি, গাছ-বাবা সারিয়ে দিয়েছেন পুরনো আর্থ্রাইটিস, গাঁটে ব্যথা। এমনকী অন্ধ চক্ষুষ্মান হয়েছে, এমন দাবিও শোনা যাচ্ছে। 

মহুয়া গাছের অবস্থান কিন্তু বেশ প্রত্যন্ত এলাকায়। সাতপুরা ব্যাঘ্র প্রকল্পের বাফার জোনে। সবচেয়ে কাছের গঞ্জ-শহর পিপারিয়াও ১৪ কিলোমিটার দূরে। নবরাত্রির সময়ে নাকি কোনও এক গ্রামবাসীর মুখে প্রথম শোনা গিয়েছিল এই গাছের জাদুশক্তির কথা। ব্যাস। ফিশফাশের কাছে কোথায় লাগে হোয়াটস্যাপ-ফেসবুক! সারা গঞ্জ, জেলা, রাজ্যে খবর ছড়িয়ে পড়তে দিন কয়েকের বেশি সময় লাগেনি। অতঃপর শুরু হল সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার। গাছের ছবি শেয়ার হতে লাগল। স্থানীয় চ্যানেলের সাংবাদিকরা বুম হাতে গাছকে ঘিরে ফেললেন। পিপারিয়া থেকে বাফার জোনের জঙ্গুলে রাস্তায় বসে গেল পুজোর সামগ্রির শ’তিনেক দোকান। ডালা নেবে মা? জুতো রাখবে বাবা? মানতের কাপড় লাগবে গো? এমনকি গাছের ছবিও বিক্রি হচ্ছে ফ্রেমে বাঁধিয়ে। 

এদিকে অকুস্থলটি যেহেতু ব্যাঘ্র প্রকল্পের অন্দরে, বন দফতরকে নাক গলাতেই হয়েছে বাধ্য হয়ে। সাতপুরা প্রকল্পের অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টর লোকেশ নিরাপুরে একরকম নিরূপায় হয়েই বলছেন, “ক্রমে লোকের ভিড় এত বাড়ছে যে সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। সবাই জায়গাটার নাম দিয়েছে সিদ্ধ মহুয়া ধাম। কী করি বলুন তো? বাধ্য হয়েই কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করতে হয়েছে। নিরাপত্তারক্ষীর ব্যবস্থা করতে হয়েছে। এদিকে তাদের সঙ্গে মাঝেমধ্যেই সংঘর্ষ বেধে যাচ্ছে ভক্তদের।“ বনকর্মী রামকৃষ্ণ দুবে জানান, সম্প্রতি আবার কে যেন গুজব রটিয়ে দিয়েছিল, গাছটি কেটে ফেলা হয়েছে। সেই শুনে ভিড় দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে। বাধ্য হয়ে পুলিশ এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেছে। গাছের চারদিকে ব্যারিকেড করে দিয়েছে। ভক্তেরা রেগে পুলিশকে পাথর ছুড়ছেন। পুলিশও কাউকে এগোতে দিচ্ছে না। অবস্থা সঙ্গীন। ঘুম উড়েছে প্রশাসনের। 

মধ্যপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যসচিব তথা বুদ্ধিজীবী এস সি বেহাড় যদিও বলছেন, “এ ঘটনার কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। আমাদের দেশে স্বঘোষিত মহাত্মা আর বাবাদের এত ছড়াছড়ি তো এই কারণেই হয়েছে! কুসংস্কার পেলে লোকে আর কিছু চায় না। এও সেরকমই গুজব আর কুসংস্কারের মিশ্রণ।“ কিন্তু বেহাড়বাবু, আপনি কি জানেন, কত শত সরকারি আধিকারিকই লুকিয়ে লুকিয়ে গিয়ে মহুয়া ঠাকুরের পায়ে ফুল চড়াচ্ছেন আর সৌভাগ্যের মানত মাগছেন? সেই সব শিক্ষিত, উচ্চপদস্থ, ডাকসাইটে ভক্তদের আটকাবে কোন পুলিশ-প্রশাসন? 

লিখতে শিখেই লুক থ্রু! লিখতে লিখতেই বড় হওয়া। লিখতে লিখতেই বুড়ো। গান ভালবেসে গান আর ত্বকের যত্ন মোটে নিতে পারেন না। আলুভাতে আর ডেভিলড ক্র্যাব বাঁচার রসদ। বাংলা বই, বাংলা গান আর মিঠাপাত্তি পান ছাড়া জীবন আলুনিসম বোধ হয়। ঝর্ণাকলম, ফ্রিজ ম্যাগনেট আর বেডস্যুইচ – এ তিনের লোভ ভয়ঙ্কর!!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *