শ্যামাঙ্গিনী। উদ্ধত যৌবনবতী। স্বাস্থ্যের দ্যুতি ঠিকরে পড়ছে। বিস্তীর্ণ বুকের খাঁজের ওপর সগর্বে শায়িত পান্না বসানো কুন্দনের হার। টান করে বাঁধা চুলের ওপর মহার্ঘ টায়রা আর পেশোয়াজ। নাকে হিরের নোলক। সোনালি জরি আর ব্রোকেডের কাজ করা গোলাপি-মেরুন-ম্যাজেন্টা রঙ ঘাঘরা চোলির ফাঁক দিয়ে ঝরে পড়ছে যৌবনের তুমুল আবেদন। স্বয়ং কালিদাস যেন যক্ষপ্রিয়ার বর্ণনা লিখেছিলেন তাঁকেই মাথায় রেখে – “শ্রোণীভারাদলসগমনা স্তোকনম্রা স্তনাভ্যাম!” উন্নত নিতম্বের ভারে তাঁর চলার ছন্দ ধীর। স্তনভারে দেহকাণ্ড ঈষৎ নত! অথচ মেঘদূতের সেই নায়িকা আজ ক্যামেরার চোখে চোখ রেখেছেন সোজা! স্বচ্ছ, প্রত্যয়ী, দৃঢ় দৃষ্টিতে নস্যাৎ করছেন হালফিল বলিউডি সৌন্দর্যের সংজ্ঞাকে। তিনি, বর্ষিতা থাতাবর্তি। দক্ষিণী মডেল কন্যা, যাঁর বলিষ্ঠ ফ্যাশন স্টেটমেন্টে তোলপাড় তামাম ফ্যাশন-দুনিয়া। 

তবে তাঁর উত্থানের নেপথ্যে হাত যাঁর, তাঁকে অবশ্য একবাক্যে ফ্যাশন-গুরু বলে মানে প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্য। অনুষ্কা শর্মা-দীপিকা পাডুকোন-আলিয়া ভট্ট থেকে রিজ উইদারস্পুন কে নেই তাঁর ক্লায়েন্টের তালিকায়! সেই সব্যসাচী মুখোপাধ্যায় যখন নারী দিবসে পোস্ট করেন বর্ষিতার ছবি, সঙ্গে ক্যাপশন – উদযাপন হোক আত্মবিশ্বাসের, তখন শোরগোল যে উঠবেই সেটা জানাই ছিল। নিন্দুকের দল রে রে করে উঠে বলতে লাগলেন, নারী দিবসেই বুঝি মনে পড়ল স্বাস্থ্যবতী নারীর আত্মপ্রত্যয়ের কথা? বাকি সময় তো সাইজ জিরোর বাইরে কথা বলেন না তিনি! তবে বিপরীত ছবিটাও ফেলনা নয়! গৌরবর্ণা তন্বী সুন্দরীদের রমরমা বাজারকে চ্যালেঞ্জ করে সব্যসাচীর এই সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট রাতারাতি খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে যায় বর্ষিতাকে। 

এর পরে বারবারই সব্যসাচীর বিভিন্ন কালেকশনের মুখ হিসেবে ফ্যাশন দুনিয়ায় ঝড় তুলেছেন বর্ষিতা। তবে সব্যসাচীর মডেল হওয়ার দরুণ নাম-যশ-খ্যাতির চুড়োয় পৌঁছলেও বর্ষিতা কিন্তু ভুলতে পারেননি তাঁর সংগ্রামের দিনগুলিকে। সৌন্দর্যের বাজারচলতি ধারনার বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে অপমানিত হওয়ার ক্লান্তিকে। আজও সে কথা উচ্চকণ্ঠে বলতে দ্বিধা করেন না এই কৃষ্ণকলি। জানিয়ে দেন, যে ইন্ডাস্ট্রি যুগ যুগান্তর ধরে সাইজ জিরো থেকে সাইজ ২-এর বেশি হলেই তাকে নিচু নজরে দেখেছে, সমালোচনায়-অপমানে মুখর হয়ে উঠেছে, সেখানে তাঁর কাজটা ছিল ধৈর্য আর অধ্যবসায়ের অনিঃশেষ পরীক্ষার। “পাঁচ বছর ধরে দরজায় দরজায় ঘুরেছি আর লোকের উপহাস সহ্য করেছি। কারণ আমার শরীর ভরাট, পুষ্ট। আমার গায়ের রঙ কালো। ভারতের কোনও অ্যাড এজেন্সি আমাকে কাজ দিতে চায়নি স্রেফ আমি চিরাচরিত বলিউডি শরীরী ধারনার ছাঁচে গড়া নই বলে।“ সখেদে মন্তব্য করেন বর্ষিতা। প্রশ্ন তোলেন, “কে ঠিক করল এই ‘প্লাস সাইজ’ নামক পরিভাষা? এর অর্থ তো এটাই বোঝায় যে সাইজ ২-এর বেশি হলেই সেটা অতিরিক্ত! তথাকথিত স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি! তাই ‘প্লাস’ বলে দাগিয়ে দেওয়া? আমাকে প্লাস সাইজ মডেল কেন বলা হবে? যাঁরা রোগা তাঁদের তো শুধুই মডেল বলে আখ্যায়িত করা হয়! আমার বেলায় এই বিশেষণ জোড়ার যৌক্তিকতা কী? ভরাট শরীর আর তন্বী শরীরের এই শ্রেণিবিভাজন কেন? এই ইন্ডাস্ট্রির হাড়ে মজ্জায় ঢুকে গিয়েছে শরীরী বিভাজন। এটাকেই ওরা বছরের পর বছর মান্যতা দিতে চায়। তাই আমার মতো শরীরের, গায়ের রঙের কোনও মেয়ের এই দুনিয়ায় সফল হতে অনেক বেশি যুদ্ধ করতে হয়।”  

৯০-এর দশকে বেড়ে ওঠা বর্ষিতা ইন্টারনেটের দুনিয়ার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না। স্কুলে, কলেজে, পাড়ায় কেবলই শুনেছেন রোগা হওয়ার সহজ উপায় আর ফর্সা হওয়ার ক্রিম মাখবার পরামর্শ। সমাজ জোর করে তাঁকে বিশ্বাস করাতে চেয়েছে বারংবার, যে তিনি কুৎসিত। সৌন্দর্য মানেই তপ্তকাঞ্চনবর্ণা এবং তন্বী। বাধ্য হয়ে সমাজের দাবি মেনে পনেরো কিলো ওজন কমান তিনি। কিন্তু শরীরের ধাঁচ তো তাতে পালটায় না! গায়ের রং-ও নয়। দক্ষিণের ফিল্মজগতেও দীর্ঘদিন পরিচালকদের দোরে দোরে ঘুরে তাঁকে শুনতে হয়েছে, তিনি এই পেশায় অনুপযুক্ত। তাঁর মুখ একটু বেশিই দক্ষিণী ধাঁচের। তাঁর ওজন বেশি। কিন্তু থামেননি বর্ষিতা। হাল ছাড়েননি। 

এমনই করেই একদিন এক গয়নার প্রদর্শনীতে দেখা হয়ে যায় সব্যসাচী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। ফ্যান হিসেবে সেলফি তুলতে চাইলে আপত্তি করেননি সব্যসাচী। তার দু’মাস পরেই আসে সেই জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া অফার। ভাইরাল হয়ে যাওয়া সেই ফোটোশ্যুটের পরেই তাঁর কাছে আসতে থাকে তাঁরই মতো অজস্র, অসংখ্য নারীর বার্তা। বর্ষিতার কথায়, “ওঁরা সবাই আমাকে ধন্যবাদ জানাতে থাকেন। বলতে থাকেন সৌন্দর্য্যের স্টিরিওটাইপ ভেঙে সব্যসাচীর পোশাকে-গয়নায় আমাকে সেজে উঠতে দেখে আত্মবিশ্বাস ফিরে পাচ্ছেন তাঁরা। এর চেয়ে আনন্দ আর কিছুতে পাইনি আমি। আমাকে দেখে কেউ নিজে আয়নার সামনে দাঁড়ানোর সাহস ফিরে পাচ্ছেন, এর চেয়ে বেশি সন্তুষ্টি কিছু আছে?” 

সেই পরিতৃপ্তির আনন্দ গায়ে মেখেই বিরামহীন যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন বর্ষিতা থাতাবর্তি। যুদ্ধ বাঁধাগতের ধ্যানধারণার বিরুদ্ধে। যুদ্ধ প্লাস সাইজ নামক অশ্লীল পরিভাষার বিরুদ্ধে। যুদ্ধ তথাকথিত ‘স্বাভাবিক’-এর সংজ্ঞার বিরুদ্ধে। যুদ্ধ নারীশরীরের শ্রেণিবিভাজনের কুটিল অর্থনীতির বিরুদ্ধে। 

লিখতে শিখেই লুক থ্রু! লিখতে লিখতেই বড় হওয়া। লিখতে লিখতেই বুড়ো। গান ভালবেসে গান আর ত্বকের যত্ন মোটে নিতে পারেন না। আলুভাতে আর ডেভিলড ক্র্যাব বাঁচার রসদ। বাংলা বই, বাংলা গান আর মিঠাপাত্তি পান ছাড়া জীবন আলুনিসম বোধ হয়। ঝর্ণাকলম, ফ্রিজ ম্যাগনেট আর বেডস্যুইচ – এ তিনের লোভ ভয়ঙ্কর!!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *