ছোটবেলার প্রিয় বইগুলোর মধ্যে একটা রূপকথার সংকলন ছিল। তার মধ্যে একটা খুব পছন্দের গল্পের নাম, ডিম্ববতী। বইটা দিনরাত নাড়ি-চাড়ি, দেখি, যিনি লিখেছেন গল্পটা, তাঁর নাম নবনীতা। ছোট্ট মনে ডি-ম্ব-ব-তী আর ন-ব-নী-তা… নামদুটো মাথার মধ্যে মিশে যায় কেমন, দুজনকেই রূপকথার কন্যে বলে মনে হয়।
নবনীতা দেবসেন, নামটা সেই প্রথম দেখা। তারপর সন্দেশে। মেয়ে নন্দনাকে নিয়ে তাঁর ছড়া। স্মৃতি থেকে তার খানিকটা লিখছি, অল্পস্বল্প ভুল হতেও পারে –
টুম্পা টুম্পি টুম্পুস
-যাচ্ছি উড়ে হুশ হুশ
কোথায় যাবি? কিতনা দূর?
– পেরোচ্ছি সাত সমুদ্দুর।
সাত সমুদ্র? বাপ রে বাপ
কাজ কী গিয়ে? বল তো সাফ!
– পড়তে যাচ্ছি পাঠশালায়
ইয়াঙ্কিদের আটচালায়।
করতে যাবি পাঠসাঠ?
নাম কী স্কুলের?” “ হার্ভার্ড। ”
যে লেখার শেষে ছিল-
” সেই দেশে তো থাকব না
কোথায় পাব এমনি মা?
আসব ফিরে ঠিক হেথায়
প্রাণ জুড়নো কলকেতায়”
যে-ছন্দ একবার কানে ঢুকলে, আর বেরোতে চায় না।
আর বড় হয়ে চেনা নবনীতা দেবসেন কেমন?
অমন সরস আর স্নিগ্ধ কলম, আমার তো মনে হয় বাঙালি শুধু দুজনের কাছে পেয়েছে। লীলা মজুমদার আর নবনীতা দেবসেন। ট্রাকবাহনে ম্যাকমোহনের নবনীতা, অপারেশন ম্যাটারহর্নের নবনীতা, কুম্ভমেলার ভিড়ে মিশে যাওয়া নবনীতা। নিজেকে নিয়ে এমন নির্মল কৌতুক করতে পারার মত মন আর কার? সেই যিনি বেড়াতে গিয়ে “বাবা” পাতিয়েছেন কাউকে, আর ফিরে এসে আহ্লাদ করে মা-কে বলছেন সে কথা। মা বলছেন, লজ্জা করে না, আমায় এসব বলতে? নবনীতা ততোধিক বিস্ময়ে বলছেন, ” আমার একজন বাবা হয়েছে, এ খবর তো মা-কেই আগে দেব, নাকি?”
কিংবা সেই গল্পটা? যেখানে চ্যাংদোলা হয়ে যেতে যেতে উনি অসুস্থ কন্যা অন্তরাকে বলছেন ” পিকো একটা মজা করবি? আমার সঙ্গে বল -রাম নাম সত্য হ্যায়। ” বাড়ি ঢোকার সময়ে সে দৃশ্য দেখে হাড় হিম হয়ে যাচ্ছে গৃহকর্তা অমর্ত্য সেনের। তারপর, সবটা বুঝতে পেরে, নবনীতার ভাষায়, ” তাঁর ধড়ে প্রাণ ও প্রাণে রাগ এল।”
এবং, এই ঘটনাগুলোর কথা এই যে এখন লিখছি, লিখতে লিখতেই বুঝতে পারছি, উঁহু – হচ্ছে না। ওঁর মতো করে বলা হচ্ছে না। গল্পগুলো একই, শুধু মজলিশী বাচনভঙ্গিটি অনুপস্থিত। যেন, হাতা-খুন্তি-চাল-ডাল, নুন-মিষ্টি সবই আছে, শুধু, ওই ম্যাজিক রান্না করতে পারতেন যিনি, তিনি চলে গেছেন অন্তরালে।
আর কবি নবনীতা?
গদ্যকার নবনীতার সঙ্গে বিস্তর দূরত্ব তাঁর। তিনি অনন্য, নির্জন এবং স্বতন্ত্র।
“কাছে থাকো। ভয় করছে। মনে হচ্ছে
এ মুহূর্ত বুঝি সত্য নয়। ছুঁয়ে থাকো।
শ্মশানে যেমন থাকে দেহ ছুঁয়ে একান্ত
স্বজন। এই হাত, এই নাও হাত” (পাণিগ্রহণ)
“জলের অনেক নীচে খেলা করি, শর্তহীন, একা
সেইখানে পৌঁছবে না খাজনালোভী সমাজ পেয়াদা
জলের অনেক নীচে সৌজন্যের দুঃখ সুখ নেই।” (জলের অনেক নীচে)
পাঠক হিসেবে, আমি এই নবনীতার সঙ্গে হয়তো সবচেয়ে বেশি অন্তরঙ্গ হয়ে উঠেছি। প্রেমী ও অভিমানী; সমস্ত দুঃখ গরল পান করে অমৃত ফিরিয়ে দেওয়া এক মন, ঔদাস্যের এক আশ্চর্য দৃষ্টি
“আমি তোমাদের সব প্রীতিহীনতার পাপ
নিজেই স্বীকার করে নিয়ে, নিজের মণ্ডলে সরে যাবো।
……
সেই দ্বীপে কোনোদিন তোমাদের জাহাজ যাবে না।” (দ্বীপান্তরী )
এই পঙক্তিগুলো জীবনে অনেক অনেকবার কাঁধে এসে হাত রেখেছে আমার।
আর ব্যক্তি নবনীতা?
তাঁকে নিয়ে লেখার জন্য যোগ্যতর মানুষেরা আছেন। আমি আমার পতঙ্গদৃষ্টি থেকে শুধু দেখেছি, কী অলৌকিক পজিটিভিটি, কী সর্বব্যপ্ত ভালোবাসা একজনের মধ্যে থাকতে পারে! কোথাও কোনও অভিযোগ নেই, শুধু স্নেহ আছে, আদর আছে, প্রশ্রয় আছে। প্রথম যোগাযোগ হয়েছিল সম্ভবত ২০১২ বা ২০১৩ তে, আমার একটি কবিতার বই ভালো লেগেছিল বলে নিজে ফোন করে জানিয়েছিলেন। আমার মধ্যে ফিরে এসেছিল সেই বিস্ময় – সেই আমার ছোটবেলার ডিম্ববতীর নবনীতা? বড় হয়ে যাঁর প্রেমেই পড়ে গেছি প্রায়, সেই কবি নবনীতা? তিনি এত যত্ন করে ছোটদের লেখা পড়েন আর অপরিচিত অনুজাকে ফোন করে জানান? তার পর পরই বেশ কিছুদিনের জন্য দক্ষিণ কোরিয়া চলে যাই গবেষণার কাজে। নবনীতাদি মাঝে মাঝে হোয়াটস্যাপে মেসেজ করে গল্প করতেন, কোরিয়ার কথা জানতে চাইতেন। বলতেন “জাপান তো গেছি। কোরিয়াটা বাকি রয়ে গেছে জানো।” ফিরে এসে যখন দেখা করতে গিয়েছি ভালোবাসা বাড়িতে, দেখেছি ভালোবাসার কী অনির্বাণ আলো একজন মানুষের চোখেমুখে অমন খেলা করতে পারে। আর সে ভালোবাসার পাত্রপাত্রী অগণন। বাড়ির কাজের মেয়েদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন – “এ হল আমার মেয়ে, আর ওই ও হল আমার বৌমা।” । বাড়ির কুকুরটির নাম ভূতুমদাস ভুতোরিয়া… এদিকে ভুতোরিয়া পদবীর কেউ একজন নাকি বাড়ি এসে নাম জিজ্ঞেস করছিলেন কুকুরের কী নাম… উত্তর দিতে গিয়ে নবনীতাদি বিড়ম্বনায়… সেই গল্প বলতে বলতে হেসে গড়িয়ে পড়ছেন চেয়ারে। পরমুহূর্তেই আদর করে আমায় একটা বই দিচ্ছেন, ভেতরের পাতায় লিখে দিচ্ছেন “চেরিবসন্তের বাতাসকে”…
মহিলা সাহিত্যিকদের নিয়ে তৈরি করেছিলেন সংগঠন -“সই”। সেখানেও রয়েছে কত অমূল্য কাজ। আমাকে বার দুই বলেছিলেন, “সইয়ের সদস্য হতে পারো তো”। এদিকে, যেহেতু সাহিত্যকে লিঙ্গচিহ্ন দিয়ে মাপি না, শুধুমাত্র নারী-সাহিত্যিক কেন্দ্রিক কোনও সংগঠনে যোগ দিতে একটু অনীহা ছিল আমার। সেটা সরাসরি নবনীতাদিকে বলতেও পারছিলাম না, শুধু নিজের অনাগ্রহটা আভাসে জানাচ্ছিলাম। অন্তর্যামীর মত সমস্তটা বুঝে নিয়ে, এবং একটুও ক্ষুণ্ণ না হয়ে উনি হেসে বলেছিলেন ” ঠিকই। সময় তো অনেক বদলে গেছে। যখন প্রথম সইয়ের কথা ভাবি, তখন মেয়েদের জন্য একটা আলাদা প্ল্যাটফর্ম খুব জরুরি ছিল। এখন মেয়েরা ছেলেদের সঙ্গে সমানতালে লিখছে, বন্ধু হচ্ছে… এখন হয়তো তোমাদের কাছে ব্যাপারটার প্রয়োজনীয়তা কম। মনে আছে, একবার ফাদার দ্যতিয়েন এসেছিলেন কলকাতায়, লোভে পড়ে দেখা করতে গিয়েছিলাম আমি আর আমার বর সায়ন। একথা সেকথার পর ফাদার বলছিলেন, “এই মুহূর্তে তো বাঙালি সাহিত্যিকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলেন নবনীতা। সুনীলও ছিলেন, কিন্তু অকালে চলে গেলেন। কলকাতায় এলে এখন নবনীতার সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছে করে। আর কার কাছেই বা যাব।”
ফাদার দ্যতিয়েন তো নেই আর। কিন্তু আমরা… আমরাই বা কার কাছে যাব আর? মেধায় মননে ভালোবাসায় স্নেহে আর কাকে পাব এমন, নবনীতাদি ছাড়া ?
কবিতার বই “তুমি মনস্থির করো ” তে কোনও উৎসর্গপত্র বা প্রবেশক রাখেননি সূচনায়। রেখেছিলেন একেবারে শেষে। কবিতায় দস্তখত। সেই শেষ পাতায় এসে গেলাম কি আমরাও তবে? এরপর শুধু মলাট উলটে বই বন্ধ করে রাখার অপেক্ষা?
নিশ্চিতভাবেই জানি, তা নয়। শেষ পাতাটি থেকে আবার পুনর্পাঠের দিন এসে গেল বলে। পাতা উলটে উলটে আবার শুরুর কাছে ফেরা। কারণ নবনীতা দেবসেন অনিঃশেষ, জীবনকে ফিরে দেখার স্পৃহা তাঁরও অফুরন্ত –
“একবার মুক্তি পেলে
জীবনের হাইওয়েতে আমি নির্বিঘ্নে
হুইল ধরে বসবো, আমি দেখে নেব তখন
আমার গন্তব্যটা আর দিগ্বিদিকে পালাবে কী করে!” (হাইওয়ে ট্রাফিক)
পদার্থবিদ্যার অধ্যাপনা আর গবেষণায় নিযুক্ত। লেখালেখির হাতেখড়ি ছোটবেলায়, সন্দেশ পত্রিকায়। প্রকাশিত কবিতার বই পাঁচটি, জার্নালধর্মী ভ্রমণকথার বই একটি। ভারতের সাহিত্য অকাদেমি যুব পুরস্কারে সম্মানিত। এছাড়াও পেয়েছেন কৃত্তিবাস পুরস্কার, বাংলা আকাদেমি পুরস্কার, এবেলা অজেয় সম্মান।