এই সময়টা এমন ছিল না। যদিও অবিশ্বাস্য ব্যাপারগুলো বিশেষ বদলায়নি। বেশ চলত সারা দিন, তার পর অকারণে মেজাজ খারাপ করে চারপাশ চুপ মেরে যেত, আকাশ কালো হয়ে আসত, প্রায় নিঃশব্দে নামত জলের ঝালর। হাওয়া নেই মোটেই, তবুও অনেক দূরে কোথাও বাতাসের টানা নিঃশ্বাস পড়ত যেন। তার পরেই আর ভাল লাগে না– এ সব বলে রোদ ঝাঁঝিয়ে উঠে, সাদা তুলোয় ধুয়ে মুছে আকাশের নীল শরীরটা বেরিয়ে পড়ত। ঝাঁঝালো রোদে ডিশ অ্যান্টেনার ওপর বসা, গা না-শুকোনো কাকেরা অবাক হয়ে এ দিক ও দিক তাকাত। স্কুলে, স্যর অন্যমনস্ক, আজ এই অবধি, বলে পিরিয়ড শেষ হবার অনেক আগেই বই বন্ধ করে ফেলতেন। কিছু দিন আগেও বাড়ি ফিরে মাঠে ফুটবল খেলা শেষ হবার পরেও রোদ থাকত, এখন ছায়া এসে পড়ে, হাফ টাইম-এ। আগে খেয়াল করিনি, এ বারে দেখলাম আরও কয়েকটা নতুন ব্যাপার হচ্ছে। পাশের পার্কের এক কোণে একটু জল জমত, সেখানে দেখি এক গোছা ঘাস দিদার মাথার চুলের মতো সাদা হয়ে গেছে। মা, আজকাল সবসময় গম্ভীর হয়ে থাকে, বলল কাশ কাশ। বাবা বলল, এক বার কোলাঘাটে নিয়ে যাব, প্রচুর হয় ওখানে। কেন, জিজ্ঞেস করায় বলল, কাছেই থার্মাল পাওয়ার স্টেশন, ছাইটা ফেলে, তাই। থার্মাল তো জানি। ঠিক বুঝতে পারলাম না, আগুন লাগলে পুড়ে সাদা হয়ে যায়? আমাদের পাড়ার পার্কে কে আবার আগুন দিল? 

এক মুখ চিন্তা নিয়ে এটাও বলতে শুনলাম, পুজো আসছে, বোনাস দিতে হবে, কী করে দেব জানি না, পেমেন্টগুলো এখনও আটকে আছে। বাবা বোধ হয় মাস ফুরোলে মাইনে পায় না, কিন্তু অনেককে দিতে হয়। রাতে ঘুমের মধ্যে একটা শব্দ শুনতে পেলাম বাইরে। মা ফিসফিস করে বাবাকে বলল, ওই বাঁশ এল।  সকালে দেখি খুঁটি পুঁতে বাঁশ বাঁধা শুরু হয়ে গেছে, প্যান্ডেল তৈরি হবে। তবে গত বারের চেয়ে একটু যেন ছোট। যদিও তখন অনেক ছোট ছিলাম, তা-ও বুঝতে পারতাম, বাবা মা কে খুবই ভালোবাসত। বলত, চলো এক দিন গড়িয়াহাটে যাই, কেনাকাটা আছে তো। মা খুশি খুশি মুখে বলত, এক বার নিউমার্কেট গেলে হত না? ওর মোজা লাগবে। আমার জন্য জামা প্যান্ট কিনতেই হত না, পেতাম প্রচুর। আর কাটপিস পেলে আগেভাগে গিরীন টেলার্স-এ গিয়ে মাপ দিয়ে আসতে হত।ওখানে একটা অদ্ভুত খড়ির মত জিনিস থাকত, যা দিয়ে কাপড়ের ওপর দাগ দেওয়া যেত। খুব লোভ ছিল ওটার প্রতি। এ বছর দেখলাম বন্ধ। অবশ্য এখন সবই রেডিমেড।  

ফ্যান চালাতে ভুলে গিয়েও দেখলাম ঘামছি না, তা-ও চালালাম, একটু পরে শীত শীত করতে লাগল, কমিয়ে দিলাম। কদিন ধরেই দেখছিলাম কারুর মন ভাল নেই, মাঝে মাঝে রাগারাগি হচ্ছে। আমি এসে পড়লেই চুপ করে অন্য কিছুতে মন দিচ্ছে। অনেক রাতে প্যান্ডেলে বাঁশের গায়ে পেরেক ঠোকার শব্দের মধ্যেই কানে আসছিল একটা দুটো কথা। বুকিং, ফ্লাইট, হোটেল, জয়পুর। তা হলে কি বেড়াতে যাওয়া হবে? জয়পুর থেকে কি জয়সলমীরও যাব আমরা? অনেক দিন কোথাও যাওয়া হয় নি, আগে হত। শেষ বার পুরী যাওয়া হল, তবে পুজোর সময় নয়। সে বারই প্রথম দেখলাম, বেডিং নয়, চাকা লাগানো সুটকেস এসেছে। এ বারে কি আমরা পুজোর সময়েই চলে যাব? তা হলে তো ঠাকুর দেখা হবে না। চুপ করে রইলাম। যাওয়া হবেই এমন কথা বলেনি এখনও। তাই। আর কদিন পরেই মহালয়া। খুব ভোরে, অন্ধকার থাকতে একটা ব্যাপার হয়। সুর করে, মন্ত্রের মত অনেক কথা বলে যান কেউ, বুঝতে পারি না। ঘুমের মধ্যে ঢেউয়ের মতো আসা যাওয়া করে কথাগুলো, কিছু হারিয়ে যায়, কিছু চকচক করে ওঠে ফুঁসে ওঠা ফেনার মতো। মা দুর্গার কোনও ব্যাপার হবে, সেটা বুঝতে পারি। ওই এক দিনই আমাদের ট্রানজিস্টরটা চলে। এখন নাকি খারাপ, এ বারে কী হবে কে জানে।

মা দুর্গা বাপের বাড়িতে  বেড়াতে আসবেন তাঁর ছানাপোনাদের নিয়ে, তাই আমাদের সবারই খুব আনন্দ। এর মধ্যে খামোখা অসুর মেরে ফেলার ব্যাপারটা কেন থাকে কে জানে। টিভিতে সারা ক্ষণ দেখায়, সবাই চেঁচামেচি করছে, মারামারি করছে। মা-বাবার ফোনে উঁকি মেরে দেখেছি, এই নিয়ে ওরাও রাগী রাগী কথা লেখে। স্কুলে একটু মারপিট হলে তো বকাবকি করত, এখন এদের কেউ শাস্তি দেয় না কেন? এক দিন চেপে ধরেছিলাম, বলেছিল, দুর্গাপুজোয় অশুভ শক্তির বিনাশ হয়। একদম বাজে কথা। বাপের বাড়িতে হলিডে করতে এসে, সুন্দর সাজানো প্যান্ডেলে, রক্তারক্তি দেখিয়ে কী লাভ? মা বলেছিল, পাকা পাকা কথা বোলো না, পরে বুঝবে। কবে আসবে এই পরে? কবে থামবে এই বিচ্ছিরি ব্যাপারগুলো? আসলে, আমার ধারণা,মা-বাবারও রাগ হয় এ সব দেখে, কিছু করতে পারে না, তাই পালাতে চাইছে, ঠিক পুজোর সময়েই।

একটু একটু মনে আছে, আগে দুর্গাঠাকুরের মুখে যতখানি রাগ দেখতাম, এখন আর তত নেই।  ছোটবেলায় ঠাকুরকে দেখলে মনে হত সত্যি, একেবারে জ্যান্ত মানুষের মত। এমন এখনও হয়। তবে অন্য রকম করে বিখ্যাত হয়ে যাওয়ায় অনেকেই সেই রকম করছে আজকাল। পুতুল পুতুল। রাগ রাগ ভাব নেই। ঠিক যেমন আমার মায়ের মুখ ছিল, ছোটবেলায়। ঘেমেনেয়ে ঠাকুরের গা চকচক করে না এখন। অসুর থাকে নিজের জায়গায়, তবে তাকে নিয়ে মাথাব্যথা নেই। রাগ তো একেবারেই নেই, ত্রিশূলটা স্রেফ ছুঁয়ে আছে। ঠাকুর তাকিয়ে থাকেন আমাদের মাথার ওপর দিয়ে, প্যান্ডেল পেরিয়ে অনেক দূরে, বোধ হয় কৈলাসের দিকে, মনে মনে ভাবেন সংসারের কথা। গ্যাসটা নিভিয়েছিলাম তো? ঠিক যেমন আমি মনে মনে দেখতে পাচ্ছি সোনার কেল্লাকে। কী সুন্দর আলো পড়ে প্যান্ডেলের ভিতরে, বেশি না, অল্প আলো। গাদা গাদা ফুল ছিঁড়ে এনে মালা গেঁথে পরানো হয় না আর। মাইকে যুদ্ধের হুঙ্কারের মত আওয়াজ নয়, বাজে অন্য রকম মিঠে সুর। ঠাকুর দেখে ভয় করে না একেবারেই। পুজো হয় মহা শান্তিতে, অঞ্জলি দিয়ে ভোগ পেলে ফুর্তি হয়।  

চুপিচুপি একটা মনের কথা বলি। আমার খুব পছন্দের লোক শিব। ঠাকুরের অনেক ওপরে, ঠিকমতো দেখাই যায় না এমন জায়গায়, তাকিয়ে থাকে হাসি-হাসি মুখে। দশমীর বিকেলে ঠাকুরের সঙ্গে চলে গেলেও কিছু দিন পরেই আবার দেখা যায় তাকে, নিশ্চিন্তে শুয়ে থাকে কালী ঠাকুরের পায়ের তলায়। ভাবখানা হল, যতই তুমি মুন্ডু কাটো, ব্যাপারটা আসলে হাস্যকর। চলে যাওয়াটা আমার ভাল লাগে না। যেতে পারি কিন্তু ফিরে আসব, এমন প্রমিস করা লোককে বড্ড ভাল লাগে। 

শুভময় মিত্র আদতে ক্যামেরার লোক, কিন্তু ছবিও আঁকেন। লিখতে বললে একটু লেখেন। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে অনেকরকম খামখেয়ালিপনায় সময় নষ্ট করে মূল কাজে গাফিলতির অভিযোগে দুষ্ট হন। বাড়িতে ওয়াইন তৈরি করা, মিনিয়েচার রেলগাড়ি নিয়ে খেলা করা, বিজাতীয় খাদ্য নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করা ওঁর বাতিক। একদা পাহাড়ে, সমুদ্রে, যত্রতত্র ঘুরে বেড়াতেন। এখন দৌড় বোলপুর পর্যন্ত।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *