কলম্বোর হিল্টন হোটেলের উনিশ তলা থেকে সব কিছু স্বপ্নের মত দেখায় – দূরে, পড়ন্ত রোদে ভেজা আকাশ চুমু খায় নীল সমুদ্রের ঠোঁটে, সুইডেন থেকে আসা জাহাজ বন্দরে এসে ঠেকায় তার শ্রান্ত শরীর, নীচে রাস্তায় আলো জ্বলে উঠছে এখন, পাখি ও মানুষেরা গাড়ি, বাস, টুকটুক ও হাওয়া বেয়ে ফিরে যাচ্ছে বাসায়, কফিশপে বেড়ে উঠছে ভিড়, জুলিয়ানা বন্দরনায়েকের ব্রেক-আপ হয়ে যাবার পরে, সে রোজ অফিসফেরতা এই ক্যাফেতে বসে এক কাপ সিলোন টি খায় ধীরে ধীরে। একটু পরেই জেগে উঠবে “বেলি’জ কলম্বো ” – শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে বড় ক্যাসিনো, টেবিলে টেবিলে পোকার-লোভী মানুষ আড়চোখে দেখে নেবে বাজির দর, সোভিয়েত ভেঙে যাবার পর সি-আই.এস. দেশের সোনালী চুলের যুবতীরা ছড়িয়ে পড়েছে দুনিয়ায় ও এশিয়ায়, ক্যাসিনোর ভেতর তারা পোল ড্যান্স দেখায়, আর পকেটে ডলার গুনে নিয়ে ইয়োরোপীয় টুরিস্ট খুঁজে নেয় ‘এসকর্ট সার্ভিস’; তবু আমি হোটেলের সুইমিং পুল ঘেঁষা টেবিলে বসে সিগারেট ধরিয়ে নিই আনমনে, আর বার-সংলগ্ন লাউঞ্জে তত ক্ষণে গান শুরু করে দেয় রে’ ডি সিলভা-র ব্যান্ড, রে’ ডি সিলভা, বয়স ৫০, লম্বা চুল, মুখে বলিরেখা, সব রকম ইনস্ট্রুমেন্ট বাজাতে পারে, ব্যারিটোনে ক্লাসিক রকের উন্মাদনা ছড়িয়ে দিতে পারে, ইয়োরোপে পনেরো বছর মিউজিশিয়ান হিসেবে কাটিয়ে দেশে ফিরে এখন নতুন মিউজিশিয়ানদের তৈরি করে নিজের হাতে, চেন স্মোকার, “তুমি এত সিগারেট খেয়ে গাও কী করে, যদিও যা গাইছ, তা নিয়ে কিছু বলার নেই…” – বলে উঠি তাকে, রে হাসে – “হ্যাঁ, হাই পিচে গাইতে একটু অসুবিধে হয়, তবে আমার লো পিচে এত ভ্যারিয়েশন, চালিয়ে দিই আর কী! বাট আই হ্যাভ লস্ট মাই ফলসেটো…”; রে চলে যায়, শুরু হয় ডায়ার স্ট্রেটস-এর ‘মানি ফর নাথিং অ্যান্ড চিকস ফর ফ্রি…’; বারের লম্বা স্টুলে বসে থাকা আধবুড়ো ফ্রেঞ্চ লোকটি হেসে বলে ওঠেন- ” ফ্রি মাই ফুট, আই হ্যাভ পেড কোয়াইট আ লট টু দ্যাট বেব…”, আমি চমকে উঠে দেখি অজন্তা-ইলোরার মত এক সিংহলি তরুণী ঈষৎ বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে রয়েছে, চোখে চোখ পড়তেই চোখ নামিয়ে নেয়, হয়তো দক্ষিণ এশীয় হয়ে আর এক কাছাকাছি স্কিন-টোনের মানুষের কাছে ইয়োরোপে বিক্রি হয়ে যাবার গল্প জানতে দিতে চায় না, আমি কথা বলি সোশিওলজিস্ট কুমারা উইক্রাসিংঘের সঙ্গে, উনি বলেন শ্রীলঙ্কান সিভিল ওয়ারের ক্ষতের কথা, আমার মনে পড়ে – রাজীব গান্ধী, এথনিক তামিল বনাম সিংহলি, এখনও কি আন্ডারকারেন্ট আছে? প্রশ্ন শুনে প্রফেসর কুমারা হাসেন, বলেন – “আমি তো সিংহলিজ, আমার বেস্ট ফ্রেন্ড শ্রীলঙ্কান তামিল, আমার শ্যালিকা বিয়ে করেছে এক জন তামিলকে, আন্ডারকারেন্ট থেকেই যায়, তবে তা আর জরুরি নয়, নাও একটা রেড ওয়াইন খাও…”; কলম্বো থেকে ক্যান্ডি যাবার পথ যেন স্বর্গ – উঁচুনিচু পাহাড়ি পথ, নীল পাহাড়, সবুজ জঙ্গল, অথচ পাহাড়ি টিলার কাছেই নারকেল গাছ, মাঝে মাঝেই বিভিন্ন টিলার ওপর থেকে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠেন গৌতম বুদ্ধ, ক্যান্ডির ‘দ্য টুথ রেলিক টেম্পল’-এ যাই, সেখানে সাতটা সোনার বাক্সে নাকি রাখা আছে বুদ্ধের দাঁত, সেই দাঁত জগতের সমস্ত বুদ্ধিস্টদের জন্যে পাঁচ বছরে এক বার বের করে দেখানো হয় শ্রীলঙ্কান প্রেসিডেন্টের উপস্থিতিতে, আমি গৌতম বুদ্ধকে জিজ্ঞেস করি – “আপনার দাঁত কি সত্যিই এই মন্দিরে আছে?” উনি বলেন – “তোমার সব সময় এত উল্টোপাল্টা প্রশ্ন কেন? এ দেশে এসেছ, এনজয় করো বরং” …ক্যান্ডির পুরোনো পর্তুগিজ বাড়িগুলো নিস্তব্ধ দাঁড়িয়ে আছে এখন, রাত জুড়ে কীসের যেন হাতছানি, মাহাওয়েলি নদীর ধারে প্রাচীন রেন-ফরেস্টের শরীর বেয়ে ধোঁয়া ধোঁয়া নেমে আসছে ভোর, দেখি কার চুল উড়ছে হাওয়ায় – জুলিয়ানা বন্দরনায়েকে, তোমার সূর্য-গম-রঙা ত্বকে যে ট্যাটু, তাতে যদি লেখা থাকে – ‘স্টে ব্যাক’, আমি শ্রীলঙ্কান এয়ারলাইনসের কলম্বো-কলকাতা ফ্লাইট ছেড়ে দেব…
কয়েক বছর আগে বেশ রাতে মাদ্রিদের রাস্তায় হাঁটছিলাম। ফেব্রুয়ারি মাস, কনকনে হাওয়া জ্যাকেট-সোয়েটার-মাফলার ফুঁড়ে ঢুকে যাচ্ছে শিরদাঁড়ায়। রাতের মাদ্রিদে রাস্তায় লোক কম, মস্ত গথিক অট্টালিকাগুলো নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, রাস্তায় তাদের ভূতুড়ে ছায়া, ছমছমে লেন-বাইলেন পেরিয়ে যেতে যেতে আমরা তিন জন খুঁজছিলাম কোনও রেস্তঁরা বা পাব, যেখানে বসে নৈশাহার সারা যাবে। একটা প্রায়ান্ধকার গলির কাছে পৌঁছতেই শুনি “গুড ইওরোপিয়ান গার্লস, স্যর, প্লিজ চেক…”; ঘুরে তাকিয়ে দেখি দু-তিনজন বাদামি লোক, হাতে অর্ধ-উলঙ্গ মেয়েদের ছবি, যারা হয়তো চলে এসেছে ভেঙে যাওয়া সোভিয়েত কিংবা ইস্ট ইওরোপের বিষণ্ণ উপত্যকা পেরিয়ে। বুঝলাম, দালাল। ‘চাই না’ বলে এগিয়ে যেতেই শুনি, “এরা যাবে না রে, ছেড়ে দে…” বিদ্যুচ্চমক খেলে গেল যেন! ঘুরে তাকিয়ে সামনের লোকটিকে, যার মুখে জ্যামিতিক স্ট্রাগল, হালকা দাড়ি, তাকে বললাম, “আপনারা কোথাকার?” কিছু ক্ষণ সবাই চুপ, তার পর আমতা আমতা উত্তর – “রংপুর। সরি স্যর।” আলাপ হল তার পর, শুনলাম ভাগ্যান্বেষণে সব ছেড়ে, পাসপোর্টহীন, ভিনদেশে ভিড়ে মিশে যাওয়া জীবনের কথা। দেশে মা-বাবা-ভাই-বোন সকলেই, তবু ফিরে যাওয়া হবে না আর কোনও দিন। কোনও দিন! এও এক জীবন, জীবন কী ভাবে কোথায় ঘোরে, কোথায় গিয়ে পড়ে, কেউ তা জানে না। বেঁচে থাকা মিশে থাকে অস্ফুট রহস্য-ইশারায়। রংপুর, রংপুর, কলকাতা থেকে কত দূর? অন্য দেশ, অন্য নদী, তবু মাদ্রিদে সেই রাতে বাংলা ভাষার সেই ব্রিজ, আজও মনে আছে।
এই সময়ে যাঁরা বাংলা কবিতা লিখছেন , তাঁদের মধ্যে সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায় অন্যতম। সৌভিকের কাব্যভাষা স্বকীয় ও স্বতন্ত্র - নাগরিক বিষন্নতা , সমাজসচেতনতা , মাঝে মাঝে কালো ঠাট্টা বা শ্লেষ ও নস্টালজিয়া তাঁর কবিতায় নানাভাবে ফিরে ফিরে আসে। লিখেছেন ছোট-বড় প্রায় সমস্ত বাণিজ্যিক ও লিটল ম্যাগাজিনে। এ পর্যন্ত প্রকাশিত কবিতার বইয়ের সংখ্যা তেরো, ২০২২ সালে প্রকাশিত হয়েছে 'কবিতাসমগ্র ১'। কবিতার জন্যে ভাষানগর-মল্লিকা সেনগুপ্ত পুরস্কার, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতি পুরস্কার সহ পেয়েছেন আরও একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। গদ্যকার হিসেবেও উজ্জ্বল, এখনো পর্যন্ত প্রকাশিত গদ্যের বইয়ের সংখ্যা তিন । বড় পর্দাতে অভিনেতা হিসেবেও তাঁকে মাঝে মাঝে দেখা যায়।
ভীষণ ভীষণ সুন্দর। গদ্যের আঙ্গিক ও বর্ণনাভঙ্গির শৈলী ভীষণ অদ্ভুত, ভীষণ ভালো।