বাঙালির ভোজ মেঝেতেই সুন্দর! বাংলার খাওয়া-দাওয়ার সংস্কৃতি নিয়ে লেখা সেরা বইগুলি নেড়ে-চেড়ে দেখলে সে কথাই মনে হয়। খাদ্যরত বাঙালি বাবুকে যখনই কোনো শিল্পী ধরতে চেয়েছেন, সচরাচর তাকে মেঝেতেই বসিয়েছেন। তা তিনি রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ই হোন বা পূর্ণেন্দু পত্রী – লেখায় টেবিল-চেয়ারের প্রসঙ্গ থাকলেও ছবিতে ভোজন রসিক বাঙালির ঠাঁই হয়েছে মেঝেতে।

পাত পেড়ে না খেলে আর খাওয়া কী! কলকাতার মধ্যবিত্ত বাঙালির এই ঐতিহ্য যদিও অনেক দিনই মাটিতে মিশে গিয়েছে। আর বাঙালি মাটি ছেড়ে চেয়ার-টেবিলে উঠে বসেছে। ‘ওবেসিটি’ নামক পশ্চিমি ধারণাটি ধেয়ে আসার ঢের আগেই, গেঁটে বাত ও বিস্ফারিত ‘মধ্যপ্রদেশ’ তাকে বুঝিয়েছে এই ভালো, এই ভালো। ফলে ‘ডাইনিং টেবিল’ ক্রমে হয়ে উঠেছে কলকাতাবাসীর প্রিয় আসবাব।

কিন্তু এর পর যদি শোনেন শহর কলকাতায় আজও রয়েছে এমন ‘হোটেল’ (বাঙালির হোটেল, মানে যেখানে খাবার পাওয়া যায়), যেখানে একেবারে পাত পেড়ে মেঝেতে বসে খেতে হয়, তা-ও আবার কাঁসার থালায়, মাটির ভাঁড়ে – তাহলে ‘বিষম’ কিংবা ‘খাবি’ ছাড়া খাওয়ার কী বাকি থাকে! যদিও চর্ব-চোষ্যের যাবতীয় ব্যবস্থাই এই ঠেকটিতে রয়েছে। আর তা গুণমানেও লা জবাব!

জগন্মাতা ভোজনালয়। সত্যি বলতে কী, পুরোনো কলকাতার এক টুকরো স্মৃতি। আজও জীবন্ত। উত্তর কলকাতার শ্রীমানি মার্কেটের কাছে কৈলাস বোস স্ট্রিটে অবস্থিত এই পাইস হোটেল। আজকের আধুনিক রেস্তোরাঁ মাফিক সুযোগ-সুবিধে এখানে কিস্সু নেই, কিন্তু মাটিতে বসে খাওয়ার সুযোগ আছে। এসি নেই, মোটা গাঁথনির দেওয়াল আছে, সুউচ্চ সিলিঙে কড়ি-বরগা আছে। তথাকথিত ‘হাইজিন’ বজায় রাখার ব্যবস্থাপনা নেই, ঝকঝকে কাঁসার থালা আর কলাপাতা আছে, ‘ইউজ অ্যান্ড থ্রো’ মাটির ভাঁড় আছে। কন্টিনেন্টাল, লেবানিজ ইত্যাদি নেই, পাতি বাংলা মিল আছে। ‘কুক’, ‘শেফ’ নেই। উড়ে বামুন আছে।

‘মাছ আর বাঙালি’ রচনাটির শুরুর দিকেই রাধাপ্রসাদ গুপ্ত লিখছেন – ‘মাছ ছাড়া বাঙালির জীবন ভাবা যায় না যেমন কালো ছাড়া কাক, সাদা ছাড়া বরফ ভাবা যায় না। পঞ্চাশ-ষাট বছর আগের সেই অগণতান্ত্রিক যুগে বাঙালিরা অবাঙালিদের বিশেষ করে হিন্দি আর ওড়িয়া-ভাষীদের নিয়ে নানারকম ঠাট্টা তামাশা করত। বলার দরকার নেই প্রতিপক্ষরাও ছেড়ে কথা কইত না। ছেলেবয়েসে আমরা যখন কটকে ইস্কুলে পড়তাম তখন কখনও কখনও রাস্তাঘাটে ঝগড়াঝাঁটি হলে ওড়িয়া ছেলেরা আমাদের ঠাট্টা করে চেঁচাত: ‘বাঙালি ট্যাংট্যাংলি খায় সড়া মাছ।’ অবশ্য ওড়িয়ারাও অতীব মৎস্যপ্রিয়। তাই তাদের এই ঠাট্টার আসল মানে ছিল বাঙালিরা মহানন্দে সড়া অর্থাৎ পচা মাছ খায় যা ওড়িয়ারা ছুঁতেও ঘেন্না করে।’ বাঙালি-ওড়িয়ার সেই জোড়া মৎস্যপ্রীতি আজও মূর্ত হয়ে ওঠে এই হোটেলে, বিশেষত দুপুরের দিকে! মূর্তিমান একেকটা ইলিশ, বাটা, ট্যাংরা, পমফ্রেট, চিংড়ি, রুই, মাগুর, ভেটকি, গুড়জাওলি, পাবদা, চিতল, শোল, কাতলা, তেলাপিয়া, মৌরলা…! সব, মানে সবই পাবেন। মাছের সাইজও বাটি কিংবা থালা ছাপিয়ে মেঝে ছুঁতে চাইবে! তার উপরে মাছের মাথা কিংবা কাঁটার বিশেষ ব্যবহারে অন্যান্য পদ, জম্পেশ খাসির মাংস, কাঁকড়া, এসব তো আছেই।

উৎকলবাসীদের গড়া এই জগন্মাতা ভোজনালয়ের বয়স আজ একশোর আশপাশে। বর্তমানে দায়িত্বে আছেন গঙ্গাধর মিশ্র। ওড়িশা থেকে ভাগ্যানুসন্ধানে কলকাতা এসে হোটেলটি চালু করেন তাঁর পূর্বপুরুষেরা। সেই সময়ের রান্নার ধারাই তাঁরা বজায় রাখার চেষ্টা করে চলেছেন যথাসাধ্য। গোটাটাই বাটা মশলায় রান্না, স্বভাবতই যা স্বাদে খাসা! আর তার সঙ্গে কর্মচারীদের যত্নআত্তি তো আছেই। এই বছর দশেক হল হোটেলের একাংশে কিছু চেয়ার-টেবিলেরও বন্দোবস্ত করা হয়েছে। বাকি অংশে আসন পেতে মাটিতে বসে খাওয়ারই আয়োজন। এই পাইস হোটেলে পুরোনো কলকাতাকে খুঁজে পেতে কোনো কৃত্রিম থিম বানিয়ে নিতে হয়নি; জগন্মাতা আজও স্বচ্ছন্দ, স্বাভাবিক। স্বাদে, রূপে। কেবল বেশি বেলা করে এলে খাসির মাংসটা পাবেন না, এ-ই যা!

দীর্ঘদিন সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত সুস্নাত এখন মুদ্রণশিল্পের ওপর মনযোগ দিয়েছেন। বোধশব্দ পত্রিকা ও প্রকাশনীর সম্পাদকের দায়িত্ব সামলে সময় পেলেই লেখালেখি করেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। বই প্রকাশের নানা দিক নিয়ে ওয়র্কশপ পরিচালনা করে থাকেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *