শক্তিপুত্র পরাশর
মহাভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হলেন পরাশর। বশিষ্ঠ-অরুন্ধতীর পৌত্র তিনি। পিতা শক্ত্রি (শক্তি) তাঁর ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগে নিহত হন। শক্ত্রি বশিষ্ঠের পুত্র, তাঁকে ভক্ষণ করে কল্মাষপাদ নামের এক রাক্ষস, যিনি পূর্বে রাজা ছিলেন। শুধু শক্ত্রিকে নয়, বশিষ্ঠের শত পুত্রকেও সেই রাক্ষস ভক্ষণ করে ফেলে। পুত্রশোকে বশিষ্ঠ আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। দুঃখে, শোকে ও সন্তাপে আশ্রমে ফিরে তিনি বেদপাঠের ধ্বনি শুনতে পান। কে পাঠ করছে বেদের মন্ত্র? তিনি পিছন ফিরে দেখলেন, তাঁকে অনুসরণ করছে শক্ত্রির বিধবা পত্নী অদৃশ্যন্তী, আওয়াজ আসছে তাঁর কাছ থেকেই। অদৃশ্যন্তীর গর্ভস্থ শিশুই সেই বেদ পাঠ করছেন। কালক্রমে অদৃশ্যন্তী যে পুত্র-সন্তানের জন্ম দেন, তিনিই হলেন পরাশর। পরাশরের মাতামহের নাম চিত্রমুখ, যিনি ছিলেন বৈশ্য। সেই হিসাবে পরাশর হলেন ব্রাহ্মণ ও বৈশ্যকন্যার সন্তান। মনুর যে অনুলোম বিবাহের নিয়মকানুন, সেই অনুযায়ী পরাশর সংকর, তাঁকে অম্বষ্ঠ বা বৈদ্য বলাই নিয়ম। কালক্রমে পরাশর ও মৎস্যগন্ধ্যা (ধীবরকন্যা/ক্ষত্রিয়কন্যা)-র মিলনে জন্ম নেন কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস, যিনি মহাভারতের রচয়িতা ও মহাভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র।
পরাশর হলেন ব্যাসদেবের পিতা। তিনি বৈদিক ঋষি। বেদের অনেক মন্ত্র তিনি রচনা করেছেন। তাঁর রচিত সংহিতার নাম ‘পরাশর-সংহিতা’। বিষ্ণুপুরাণ, হোরাশাস্ত্র প্রভৃতি পুরাণ ও শাস্ত্রের জনক তিনি। কৃষিবিদ্যা ও বৃক্ষসংক্রান্ত বেশ কিছু তত্ত্বের জনক বলে তাঁকে মনে করা হয়।
ছেলেবেলায় পিতামহ বশিষ্ঠকে ‘পিতা’ বলে ডাকতেন পরাশর। একদিন মা অদৃশ্যন্তী বললেন, বশিষ্ঠ তোমার পিতামহ, তোমার পিতাকে রাক্ষসে ভক্ষণ করেছে। পরাশর রাক্ষসদের উপর বিরূপ হলেন এবং সংকল্প করলেন রাক্ষস-সত্র করবেন। সে যজ্ঞ হল রাক্ষসদের নিধনযজ্ঞ। আগুন জ্বলল। তাতে একের পর রাক্ষস দগ্ধ হতে লাগল। তখন অত্রি, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু প্রমুখ উপস্থিত হলেন রাক্ষসদের বাঁচানোর জন্য। পুলস্ত্য বললেন, তুমি যাদের হত্যা করছো, এরা তোমার পিতার নিধন বিষয়ে কিছু জানে না, তোমার পিতার হত্যায় কোনও ভাবেই এরা দায়ি নয়। যে রাক্ষস তোমার পিতাকে ভক্ষণ করেছে সে ক্ষত্রিয় রাজা কল্মাষপাদ। একদিন চলার রাস্তা নিয়ে গোলমাল হয়। তোমার পিতা শক্ত্রি বলেন, ব্রাহ্মণকে পথ ছেড়ে দেওয়া রাজার সনাতন ধর্ম। তৃষ্ণার্ত রাজা তোমার পিতাকে কশাঘাত করে। তখন শক্ত্রি অভিশাপ দেন, তুমি নরমাংসভোজী রাক্ষস হও। কল্মাষপাদ রাক্ষসে পরিণত হয়ে তোমার পিতাকে ভক্ষণ করে। অবশ্য এই সব চক্রান্তের পেছনে আছেন বিশ্বামিত্র। পিতামহ বশিষ্ঠের সঙ্গে বিশ্বামিত্রের দ্বন্দ্ব বহু পুরনো। সবটাই ব্রাহ্মণ বনাম ক্ষত্রিয়ের লড়াই। আর এক ভাবে দেখলে সম্পত্তির লড়াইও বটে। নন্দিনীর মালিকানা নিয়ে কম ঝামেলা হয়নি দুজনের। শেষ পর্যন্ত অষ্টবসু সেই কামধেনুকে চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেলেন। তার পর অভিশপ্ত হয়ে শান্তনু ও গঙ্গার পুত্র হয়ে জন্মালেন। সাত জন পুত্রকে জন্মানো মাত্র একে একে হত্যা করলেন গঙ্গা। কিন্তু দ্যু নামক বসু, যিনি ছিলেন নন্দিনী-চুরির প্রধান অপরাধী, তাঁকে গঙ্গা হত্যা করতে গেলে পিতা শান্তনু বাধা দিলেন। সেই দ্যু বসু হলেন দেবব্রত, হস্তিনার যুবরাজ। ক্ষত্রিয়রাজা শান্তনুর একমাত্র পুত্র। শান্তনু স্ত্রীপরিত্যক্ত।
পুলহ বললেন, তোমার পিতাকে হত্যা করেছে ক্ষত্রিয় রাজা কল্মাষপাদ। তুমি অকারণ ক্রোধের বশবর্তী হয়ে রাক্ষসনিধনে ব্রতী হয়েছ। রাগ হল মূর্খের ধর্ম।
সব শুনে পরাশর রাক্ষসযজ্ঞ বন্ধ করলেন। নিরীহ রাক্ষসদের হত্যা করার জন্য অনুতপ্ত হলেন বটে কিন্তু সেই সত্রের আগুন নিভল না। পিতৃহত্যার বিষয়টি মাথা থেকে গেল না তাঁর। যুবক পরাশর ঘুরে বেড়াতে লাগলেন দেশ থেকে দেশান্তরে। হস্তিনার রাজপ্রাসাদেও তাঁর যাতায়াত ছিল। তখন যে বিধিগ্রন্থ হস্তিনায় চালু ছিল তাকে কালের নিয়মে সরিয়ে নতুন বিধিগ্রন্থ বা সংহিতা চালু করার কথা ভাবলেন পরাশর। তিনি রচনা করতে আরম্ভ করলেন পরাশর-সংহিতা—সেখানে নতুন নতুন সব বিধি রাখলেন, কেননা সমাজ পালটাচ্ছে, বদলে যাচ্ছে বার্তা বা অর্থনীতি, দণ্ডনীতি বা রাজনীতিও বাঁক নিচ্ছে অন্য খাতে। পরিবার জীবনেও আসছে পরবর্তন। বিধবা, লম্পট পুরুষের স্ত্রী, ক্লীবের পত্নী, স্বামী পরিত্যক্তা নারীর পুনর্বিবাহের বিধিও রচনা করলেন।
নষ্টে মৃতে প্রবৃজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ
পঞ্চসাপৎসু নারীনাং পতিরণ্যে…
কিন্তু কীভাবে হস্তিনায় চালু হবে সেই নতুন সংহিতা? ভাবতে লাগলেন ঋষিপ্রবর পরাশর। সে তো সহজ কথা নয়। রাজা শান্তনু তাতে মত দেবেন বলে মনে হয় না। পরাশর চিন্তিত।
রাজা উপরিচর বসুর সন্তান ধারণ করেছিল অদ্রিকা নামের এক অপ্সরা। অদ্রিকা ব্রহ্মশাপে মৎসীরূপে জলে বাস করত। ধীবরের জালে ধরা পড়ার পর তার পেট চিরে একটি পুত্র ও একটি কন্যা পাওয়া গেল। পুত্রটিকে রাজা নিয়ে চলে গেলেন। কন্যাটি ধীবরের কাছে থেকে গেল। সেই কন্যা মৎস্যজীবীদের সঙ্গে বাস করত বলে তার নাম হয় মৎস্যগন্ধা। পরমাসুন্দরী কন্যাটি যমুনা নদীতে খেয়া পারাপার করত ও পারানির কড়ি নিত। একদিন তীর্থ পর্যটন করতে করতে মৎস্যগন্ধার কাছে উপস্থিত হলেন পরাশর। তিনি জিগ্যেস করলেন, এই নৌকার কাণ্ডারী কোথায়? মৎস্যগন্ধা জবাব দিল, ধীবরের পুত্র না থাকায় আমিই সকলকে পারাপার করি। পরাশর তার নৌকায় উঠে বললেন, চারুহাসিনী! আমি তোমার জন্মবৃত্তান্ত জানি। আমি তোমার কাছে বংশধর পুত্র চাইছি, তুমি আমার কামনা পূর্ণ করো সত্যবতী! মৎস্যগন্ধা লজ্জিত হয়ে উত্তর দিল, তাই হয় নাকি, দুই পারের লোকেরা আমাদের দেখতে পাবে যে! তখন পরাশর যোগের প্রভাবে কুয়াশার সৃষ্টি করলেন, সব দিক অন্ধকার হয়ে গেল। সত্যবতী বলল, আমার কুমারিত্ব নষ্ট হবে, আমি বাড়ি যাব কীভাবে, সমাজে মুখই বা দেখাব কী করে! পরাশর জানালেন, তাঁর সঙ্গে মিলিত হলে কুমারীভাব নষ্ট হবে না। পরাশরের আশীর্বাদে মৎস্যগন্ধা পদ্মগন্ধা হলেন। তাঁর দেহের সৌরভ অনেক দূর থেকে পাওয়া যেতে লাগল। গর্ভবতী পদ্মগন্ধা পুত্রসন্তান প্রসব করলেন একটি দ্বীপে। সেই পুত্রের নাম কৃষ্ণ। দ্বীপে জন্মেছিলেন বলে দ্বৈপায়ন। পরে সেই পুত্র কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদবিভাজন করে বেদব্যাস নামে খ্যাত হন। পুত্রকে নিয়ে যুবক ঋষি পরাশর চলে গেলেন।
কৃষ্ণদ্বৈপায়নকে নানাবিধ শিক্ষায় পারদর্শী করে তুললেন পরাশর। তাঁকে দিলেন ত্রয়ী, বার্তা, দণ্ডনীতি ও আন্বীক্ষিকীর পাঠ। আর নিজে পড়ে রইলেন জ্যোতিষ, বৃক্ষবিদ্যা ও কৃষিসংক্রান্ত নানাবিধ বিদ্যার চর্চায়। ও দিকে সত্যবতী হয়েছেন হস্তিনার রাণি। বৃদ্ধ স্ত্রীপরিত্যক্ত শান্তনুর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়েছে। ঠিক হয়েছে, সত্যবতী শান্তনুর ঔরসে যে পুত্রের জন্ম দেবেন, সেই হবে হস্তিনার পরবর্তী শাসক। গঙ্গাপুত্র দেবব্রত-ভীষ্ম কথা দিয়েছেন যে তিনি রাজা হবেন না এবং বিবাহও করবেন না। কালক্রমে সত্যবতী দুই পুত্রের জন্ম দেন—চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য। চিত্রাঙ্গদ যুদ্ধ করতে গিয়ে মারা গেল আর বিচিত্রবীর্যও দুই বিধবা স্ত্রীকে অপুত্রক অবস্থায় রেখে রোগভোগে প্রয়াত হলেন।
পরাশরের পুত্র কৃষ্ণদ্বৈপায়ন হস্তিনায় প্রবেশ করলেন মা সত্যবতীর আদেশ ও অনুরোধে। তিনিই ওই দুই বিধবার গর্ভে পুত্র উৎপাদন করবেন। করলেনও। সে আখ্যান ভিন্ন।
ওদিকে পরাশর শিষ্যদের নানবিধ পাঠদানে ব্যস্ত রইলেন। তাঁর বিশ্বাস, পিতার সমস্ত অপূর্ণ কাজ সমাপ্ত করবেন পুত্র কৃষ্ণদ্বৈপায়ন। তিনিই এখন হস্তিনার প্রধান পরামর্শদাতা। দেবব্রত ভীষ্ম ও কৃষ্ণদ্বৈপায়ন দুই ভাই বটে কিন্তু বড় জটিল সেই ভ্রাতৃসম্পর্ক। দেবব্রতর পিতা শান্তনু ও মাতা গঙ্গা, কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের পিতা পরাশর ও মাতা সত্যবতী। বিচিত্রবীর্যের সহোদর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন। তাঁরা দুজনেই সত্যবতীর সন্তান। বিচিত্রবীর্য ও দেবব্রতের পিতা (শান্তনু) অভিন্ন। গঙ্গাপুত্র দেবব্রত টকটকে ফর্সা, দীর্ঘ, আর্যবীর, শাস্ত্র ও শস্ত্রবিদ্যায় পারঙ্গম। যমুনায় খেয়া পারাপারকারী মৎস্যগন্ধার পুত্র দ্বৈপায়ন কৃষ্ণবর্ণ, এক মুখ পিঙ্গল দাড়ি, জটা রয়েছে মাথায়, গায়ে দুর্গন্ধ কিন্তু পাণ্ডিত্যে অতুলনীয়, শাস্ত্রজ্ঞ; কিন্তু শস্ত্রবিদ্যায় তাঁর কেবল তত্ত্বজ্ঞান আছে।
পরাশর সারা জীবন পরিব্রাজকের মতো জীবন কাটিয়েছেন। বৃদ্ধ অবস্থায় শিষ্যসমেত তাঁকে নেকড়ে আক্রমণ করে। খঞ্জ অবস্থায় বেশ কিছু দিন অতিবাহিত করার পর তিনি নেকড়েদের জন্য এই পৃথিবীকে রেখে প্রয়াত হন।
ঋষি-পরম্পরার তিনি তৃতীয় পুরুষ। বশিষ্ঠপুত্র শক্ত্রি বা শক্তি তাঁর পিতা। তিনি পিতার ক্ষমতা বা শক্তি পেয়েছিলেন, তেমনি পেয়েছিলেন মাতা বৈশ্যকন্যা অদৃশ্যন্তীর যাবতীয় গুণ। তাঁর অদৃশ্য অঙ্গুলিহেলনে চলত ক্ষমতাতন্ত্র। পরাশরের প্রপিতামহ স্বয়ং ব্রহ্মা। আবার তিনি (পরাশর) দুর্যোধনাদি কৌরবদের প্রপিতামহ। ঋগ্বেদের ১.৬৫—১.৭৩ মন্ত্রের রচয়িতা পরাশর, যেখানে তিনি অগ্নির স্তুতি করেছেন। আর একটি মন্ত্রে সোমের প্রশংসা করেছেন পরাশর। ‘বৃহৎ পরাশর হোরাশাস্ত্র’ তাঁর রচনা বলে মনে করা হয়। এটি হল জ্যোতিষশাস্ত্রের মূল গ্রন্থ। বৃক্ষায়ুর্বেদ ও কৃষি-পরাশরের জনকও তিনি। পরাশরের হাত ধরে কৃষি ও বাণিজ্য নতুন ধারা পেয়েছিল বলে মনে করা হয়। সেই নিয়ে দ্বন্দ্বও শুরু হয় অচিরেই। কুরু-পাণ্ডবের যুদ্ধ আসলে পরাশরের প্রপৌত্রদের যুদ্ধ।
শামিম আহমেদ বাংলা সাহিত্যের এক পরিচিত নাম। লেখালেখি ছাড়াও পেশাগতভাবে তিনি অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত। সাত আসমান, মহাভারতে যৌনতা, ফেয়ারলনে মধুবালা, ওঁর কিছু জনপ্রিয় বই। ভালোবাসেন রান্না করতে এবং ইতিহাসের অলিগলিতে ঘুরে বেড়াতে।