শেষ কবে কাউকে চিঠি লিখেছিলেন মনে আছে? কিংবা ডায়েরিতে নিজের সারা দিনের ঘটনা ,ইচ্ছে-অনিচ্ছেগুলো লিপিবদ্ধ করেন কি এখন আর? বোধ হয় না। একটা সময় ছিল যখন যোগাযোগের এক মাত্র রাস্তাই ছিল চিঠি। ছেলে দূর দেশে গেলে, মা-বাবা তাঁর সাপ্তাহিক চিঠির জন্য মুখিয়ে থাকতেন। প্রেমিক প্রেমিকাকে যখন লুকিয়ে প্রেমপত্র পাঠাতো, তখন তার মধ্যে যা উত্তেজনা ছিল, তা আর মেসেজে কোথায়! আর এখন তো কম্পিউটর, ল্য়াপটপের যুগ। কি-বোর্ড টাইপিংই এখন মুখ্য হয়ে উঠেছে। হাতে লেখার পাঠ তো সেই কবেই চুকে গেছে। স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরলেই খাতা আর পেনের সঙ্গে সম্পর্ক প্রায় শেষ। অফিসের কাগজপত্রে একটু আধটু সই করা ছাড়া আর পেন-পেনসিলের প্রয়োজন নেই বললেই চলে।

কিন্তু বিজ্ঞান বলছে অন্য কথা। মন ভাল রাখতে, ম্মরণশক্তি জোরালো রাখতে লেখার কোনও বিকল্প নেই। মনোবিদরা বরাবরই বলেছেন যে ব্যক্তিগত আবেগপ্রবণ লেখা লিখলে, মানুষ নিজেদের আবেগকেও চিনতে পারেন। তাঁদের মনের মধ্যে কী চললে তা বুঝতে পারেন এবং তার সঙ্গে সমঝোতা করতে পারেন। ১৯৮০ সাল থেকে নানা গবেষণা, পড়োশানা করে বিজ্ঞানীরা বলেছেন যে, লেখার একটা থেরাপিউটিক দিক রয়েছে। তাঁদের ভাষায় ‘দ্য রাইটিং কিওর’। প্রতি দিন ১৫-৩০ মিনিট কেউ যদি নিজের আবেগের কথা লেখেন, তা হলে শরীর ও মন দুই’ই ভাল থাকে। স্ট্রেসের পরিমাণ কমে যায়, অবসাদে ভোগার সম্ভাবনা কমে যায়। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বেড়ে যায়। টাইপিং-এর চেয়ে হতে লেখার থেরাপিউটিক ক্ষমতা অনেক বেশি তা কিন্তু ইতিমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে।

‘জার্নাল অব ট্রম্যাটিক স্ট্রেস’-এর এক স্টাডি অনুযায়ী স্ট্রেস কমানোর ব্যাপারে হাতের লেখা অনেক বেশি কার্যকরী, টাইপ করার চেয়ে। নিজের মনে চেপে রাখা সমস্ত যন্ত্রণা এতে অনেক বেশি বেরিয়ে আসে। তবে যেহেতু এই গবেষণাটি ১৯৯৯ সালে, তাই প্রশ্ন উঠতেই পারে আজকের দিনেও কি এটি এতটই প্রাসঙ্গিক? এটা সত্যি যে আজকের যুগে কম্পিউটারের সঙ্গে বেড়ে ওঠে ছেলেমেয়েরা এবং টাইপ করে নিজের মনের কথা বলতে অভ্যস্থ তাঁরা। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, টাইপ করার সময় অনেক কিছু মনের ভিতরেই থেকে যায় যা লেখার সময় হয় না।

‘আমরা যখন কোনও অক্ষর লিখি, তার প্রতিটা উপাদান লেখার সময় ব্রেনের বিভিন্ন জায়গা স্টিমুলেট হয়। মস্তিষ্কের যে সমস্ত অংশ আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে, সেই অংশগুলো উত্তেজিত হয়ে যায়’, জানালেন ওয়াশিংটন ইউনিভর্সিটির এমেরিটা এডুকেশনের প্রফেসর ভার্জিনিয়া বার্নিঙ্গার। ওঁর মতে কি-বোর্ডে সমস্ত বর্ণ আগে থেকেই লেখা থাকে, আমাদের কোনও বাড়তি খাটনি নেই, শুধু টিপে দিলেই স্ক্রিনে লেখা ফুটে ওঠে। এর ফলে লিখলে মস্তিষ্কের যে সমস্ত অংশ উত্তেজিত হয়, সেগুলো টাইপ করলে হয় না।

হাতে লিখলে মানুষের স্মরণশক্তিও ভাল থাকে। যাঁরা হাতে লেখেন, তাঁরা নতুন তথ্য অনেক দ্রুত গতিতে প্রসেস করতে পারেন। ২০১৭ সালে এই সংক্রান্ত একটি গবেষণা হয়। ‘ফ্রন্টিয়ারস ইন সাইকোলজি’-তে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী মস্তিষ্কের যে অংশ আমাদের শিক্ষা বা পড়াশোনার জন্য দায়ী, সেগুলো টাইপ করার চেয়ে হাতে লিখলে অনেক বেশি কাজ করে। হাতে লখা কগনিটিভ ডেভলপমেন্টের জন্যেও ভাল। টাইপিং সে দিক থেকে দেখলে অনেক পিছিয়ে আছে।

টাইপিং-এর তুলনায় হাতে লিখতে অনেক বেশি সময় লাগে। ফলে ভাবার সময় অনেক বেশি পাওয়া যায়। ক্লাসে কোনও ছাত্র যদি যা পড়ানো হচ্ছে, তা হাতে লেখে, তা হলে পড়া আরে বেশি করে মাথায় ঢোকে বলেই দাবী বিশেষজ্ঞদের। টাইপ করা লেখার থেকে তুলনায় সহজ। যা পড়ানো হচ্ছে, তা অক্ষরে অক্ষরে টাইপ করতে অত সময় লাগে না, যতটা লিখলে লাগে। এবার অনেক সময় যা বলা হচ্ছে তা একেবারে হুবহু ঝড়ের বেগে লেখা সম্ভব হয় ওঠে না। অনেক সময় ভাষা পাল্টে লিখতে হয়। তথ্য গভীরভাবে মস্তিষ্কে না প্রবেশ করলে যা কিন্তু কোনওভাবেই সম্ভব নয়। সুতরাং হাতে লিখলে পড়া যে মাথায় বেশি ঢোকে তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

লেখার সঙ্গে পারস্পারিক সম্পর্কেরও একটা যোগাযোগ আছে। প্রত্যেকের লেখার ধরন আলাদা। এর মধ্য়ে একটা ব্যক্তিগত ছোঁয়া থাকে। সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য যা জরুরি। টাইপিং সেখানে একেবারেই যান্ত্রিক। প্রেম পত্রও দেখতে যেমন লাগে, অফিশিয়াল লেটারও তাই। লেখার সময় মনুষ যতটা ভাবেন তা টাইপ করার সময় করেন না। প্রতিটা শব্দ চয়নও তখন জরুরি হয়ে ওঠে। কিন্তু টাইপ করার সময়, গতি এত বেশি থাকে যে শব্দ নিয়ে অত ভাবার সময় থাকে না। সুতরাং সব দিক থেকে দেখলে হাতে লেখার মূল্য কিন্তু এখনও অনেক বেশি। আমরা যত তাড়াতাড়ি এই সত্যিটা উপলব্ধি করতে পারব, ততোই তা আমাদের জন্য ভাল।   

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *