বাড়ির সবচেয়ে ছোট, সবচেয়ে আদরের সদস্যের মুখে এক ফোঁটা হাসি নেই। সারাক্ষণ কেমন একটা মনমরা ভাব। খেলতে যেতে ইচ্ছে করে না, রাতে দু’চোখের পাতা এক করলেও ঘুম আসতে চায় না। বাবা-মা ভাবেন সাময়িক ব্যাপার, ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু তাঁরা বুঝতেই পারেন না যে হয়তো তাঁদের বাচ্চা অ্যাংজাইটির শিকার। আসলে কী বলুন তো, বাবা-মা-রা ভাবতেই পারেন না যে বাচ্চাদেরও কোনওরকম স্ট্রেস, অবসাদ বা অ্যাংজাইটি হতে পারে। তারা যে নেহাতই ছোট, তাদের জীবনে আর চাপ কোথায়! সত্যি কি তাই? বাচ্চারা ছোট হতে পারে, বয়স তাদের কম হতে পারে, কিন্তু তারাও তো স্বয়ংসম্পূর্ণ মানুষ। তাদের অনুভূতিগুলো কোনও অংশে বড়দের থেকে কম নয়। আর চাপের কথা বলছেন, বাচ্চাদের চাপ কি কম? ছোট থেকেই ইঁদুর দৌড়ে সামিল হওয়া, সব সময় নিজের সেরাটা দেওয়া, ক্লাসে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কাছে, বাবা-মা কাছে নিজেকে নিরন্তর প্রমাণ করা, পড়াশোনা, পরীক্ষা, প্রজেক্ট, তাদের অল্প সময়ের মধ্যেই কত কিছুর সম্মুখীন হতে হয় বলুন তো! তার উপর বাবা-মায়ের আশা, আকাঙ্ক্ষা যে তাকে ঘিরেও, তাও কিন্তু সে ছোট থেকে বুঝতে শিখে যায়। আর এই এত চাপ অজান্তেই তাদের কচি মনের উপর প্রভাব ফেলে। তারই ফল অ্যাংজাইটি।

সম্প্রতিক সমীক্ষা বলছে বাচ্চাদের মধ্যে অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার ক্রমশ বাড়ছে। প্রায় ৩৫-৫০ % বাচ্চাদের মধ্যে এখন এই সমস্যা দেখা যায়। প্রফেসর এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাপ্লায়েড সাইকোলজি বিভাগের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান ড. সাধন দাশগুপ্ত জানালেন, “বয়ঃসন্ধির ক্লাস যেমন এইট, নাইন বা টেন-এর বাচ্চাদের মধ্যে তো বটেই, এখন ক্লাস থ্রি,ফোর, ফাইভ-এর বাচ্চাদের মধ্যেও উদ্বেগ দেখা যায়। এর পিছনে সবচেয়ে বড় কারণ অবশ্যই পড়াশোনার চাপ। সিলেবাসের অত্যধিক চাপ তো আছেই, তার সঙ্গে জুড়েছে প্রাইভেট টিউশনের উপর বাবা-মায়ের নির্ভরতা। নার্সারি, কেজির বাচ্চারাও রেহাই পাচ্ছে না। একাধিক লোকেদের কাছে টিউশনির জন্য ছুটছে। এর ফলে ওরা নিজেদের জন্য কোনও সময় বার করতে পারছে না। নিজেদের মতো করে পড়োশোনার সুযোগ পাচ্ছে না। খেলাধুলোর সময় পাচ্ছে না।” সত্যি যদি ভাল করে চার দিকে লক্ষ করা য়ায় তা হলে দেখবেন সিংহভাগ বাবা-মায়েরই ছোট বয়স থেকে বাচ্চাদের নাচ-গান, আঁকা, সব কিছুতে ভর্তি করে দেন। স্কুল থেকে ফিরে কোনও রকমে নাকে-মুখে গুঁজে ফের দৌড় শুরু। আজ সাঁতার, কাল গান, পরশু ক্যারাটে। সঙ্গে অবশ্যই কোচিং ক্লাস, গ্রুমিং ক্লাস। স্বাভাবিক ভাবেই এতে চাপ পড়ে বাচ্চাদের উপরে।

ড.দাশগুপ্তের মতে উদ্বেগের আরও একটা কারণ অভিভাবক ও সন্তানের মধ্যে দ্বন্দ্ব। একটা বয়সের পর ছেলেমেয়েরা নিজেদের মতকেই প্রাধান্য দিতে চায়, কিন্তু মত প্রকাশের অধিকার খুব কম ক্ষেত্রেই পায়। আগেকার দিনেও হয়তো বয়ঃসন্ধির সময় এই ধরনের দ্বন্দ্ব দেখা যেত কিন্তু এখন তা আরও বেড়ে গেছে। তার একটা বড় কারণ মিডিয়ার বাড়বাড়ন্ত। সোশ্যাল মিডিয়ায় বাচ্চারা এখন এতটা সময় কাটায় যে তার একটা নেতিবাচক প্রভাব তো পড়বেই। সবচেয়ে বড় কথা মা-বাবারাই কিন্তু নিজেদের সুবিদার্থে বাচ্চাদের মোবাইল ধরান, টিভিতে কার্টুন চালিয়ে দেন। এ বার কথা না শুনলে, পড়াশোনা না করলে তা বন্ধ করে দিতে চান। কিন্তু বাচ্চা তা শুনবে কেন! তখন বাবা-মায়ের কথা কর্তৃত্ব বলে মনে হয়। এই কারণেও বাচ্চাদের মনে উদ্বেগের সঞ্চার হয়। তার উপর আবার অনেক বাবা-মাই সন্তানের জীবনে বড্ড বেশি নাক গলান। তাদের ব্যক্তিগত জীবনে অনুপ্রবেশ করতে চান। তারা সামনে না থাকলে মোবাইল ঘেঁটে দেখেন, ফেসবুকে প্রোফাইলে গোয়েন্দাগিরি করেন আবার তা নিয়ে বিস্তর বকাঝকা করেন। এতে সন্তানের মনে হতেই পারে যে তার মা বা বাবা তাকে বিশ্বাস করে না। ফলে বাবা-মার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক ক্রমশ খারাপ হতে শুরু করে। অ্যাংজাইটি হওয়ার জন্য এই কারণ কী যথেষ্ট নয়! তা ছাড়া বাবা-মায়ের সম্পর্কের মধ্যে কোনও ফাঁক থাকে, তাঁদের বিবাহিত জীবনে কোনওরকম অনিশ্চয়তা থাকে, বাচ্চাদের উপরও তার প্রভাব পড়ে। তারা নিজেদের ভবিষ্যত নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। এ সবের ফলই কিন্তু  অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার।   

অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডারের লক্ষণ যে সব সময় ভীষণভাবে  জানান দেয়, তা কিন্তু নয়। অনেক সময় মা-বাবারা লক্ষণ যেহেতু বয়ঃসন্ধির সময়ও দেখা যায়, ফলে বাবা-মায়ের অতটা পাত্তা দেন না। ড. দাশগুপ্ত মনে করেন বাচ্চাদের ছোট ছোট আচরণের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। অ্যাংজাইটির অন্যতম লক্ষণ, খিটখিটে মেজাজ, ঘন ঘন মুডের ওঠানামা করা। এ ছাড়াও স্কুলে যেতে না চাওয়া, খেতে না চাওয়া, রাতে ঘুম না হওয়া, সারা ক্ষণ একা থাকা, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে খেলতে না চাওয়া, ওজন হঠাৎ করে কমতে থাকা, স্কুলের পারফর্মেন্স খারাপ হওয়া, সবই কিন্তু উদ্বেগের দিকে নির্দেশ করে। এই ধরনের আচরণগত পরিবর্তন দেখলে একেবারেই অবহেলা করবেন না। তখন কিন্তু বিশেষজ্ঞের মতামত নেওয়াটাই বাঞ্ছনীয়।

অ্যাংজাইটি মানেই খারাপ তা বলছি না। প্রতিটা বয়সের সঙ্গে অ্যাংজাইটি জুড়ে থাকে। এবং তা একেবারেই স্বাভাবিক। যেমন ৬-৮ মাস বয়সে অপরিচিতদের দেখলে অ্যাংজাইটি হতেই পারে। তার পর ২ বছরে প্রথম বার প্লে স্কুলে গেলে, বাবা-মা কে ছেড়ে থাকতে হবে জেনে সেপারেশন অ্যাংজাইটি হওয়া একেবারেই স্বাভাবিক। বেশিরভাগ বাচ্চা অন্ধকার কিংবা দত্যি দানবের কথা ভেবেও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। এই ধরনের উদ্বেগ নিয়ে ভাবার কোনও প্রয়োজন নেই। জীবনের প্রতিটা স্তরে কোনও না কোনও উদ্বেগের মোকাবিলা সব মানুষকেই করতে হয়। বাচ্চাদের ক্ষেত্রেও এই কথাটা খাটে।

অভিভাভাক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব কিন্তু অনেক বেশি। বাচ্চা যে সব সময় আপনাকে নিজের মনের কথা স্পষ্টভাবে বোঝাতে পারে, তা কিন্তু নয়। অনেক ক্ষেত্রেই তারা তাদের মনের কথা গুছিয়ে বলতে পারে না। আবার বললেও আমরা বড়রা, সে সব কথা ছেলেমানুষি ভেবে উড়িয়ে দিই। এটাই আমাদের প্রথম ভুল। মনস্তত্ববিদরা মনে করেন বাচ্চাদের ছোট ছোট কথা, আচরণ সব কিছুকেই গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। ওর কেন উদ্বেগ হচ্ছে এবং উদ্বেগ হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়, এইটা আপনাকে বুঝতে হবে। ওর কথায় যদি পাত্তা না দেন, তা হলে ওর আপনার প্রতি যে বিশ্বাস আছে তা টলে যেতে পারে। পরবর্তীকালে ও কিন্তু কোনও কথাই আপনাকে আর বলতে চাইবে না। এখানে দরকার সহমর্মিতার। প্রফেসর দাশগুপ্ত বললেন, “অ্যাংজাইটি কাটাতে বাবা-মাকে সচেতন হতে হবে। এই যে তাঁরা বাচ্চার উপর অজান্তেই অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করেন, তা থেকে বিরত থাকতে হবে। অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে তুলনা করা বন্ধ করতে হবে। আমি এমনও দেখেছি যে ছেলে পরীক্ষায় ১০০র বদলে অঙ্কে ৯৬ পাওয়ায়, মা বলছেন যে ওঁর হার্ট অ্যাটাক হয়ে যেবে। তা হলেই বুঝুন বাচ্চাদের উপর কতটা মানসিক চাপ সৃষ্টি করে ফেলি আমরা। আমি সব সময় পেরেন্ট অ্যাওয়ারনেস প্রোগ্রামের কথা বলি। সবাই যদি আমরা এই ভাবে ভাবি, তা হলে ছোটটদের ছোটবেলাটা কিন্তু হাসিখুশিতেই কাটতে পারে।

One Response

  1. খুবই সময়োপযোগি প্রবন্ধ। বর্তমান সময় বাবা-মায়েরা ও যে ধরনের মানসিক চাপে থাকে তা বলা বাহুল্য। এটাও ঠিক যে সন্তান দের সঙ্গে একটি ইগোর সমস্যা হয়। সন্তানের প্রতি সঠিক যত্ন , স্নেহ ও ভালোবাসা প্রয়োজন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *