‘হুসেনের বেদনা ছাড়া আমার হৃদয়ে আজ যেন আর কোনও দুঃখের স্থান না থাকে।’ লিখেছিলেন দিলগীর লখনউয়ি। এটি ছিল তাঁর ছদ্মনাম। আসল নাম মুনশি চুন্নুলাল বা ঝুন্নুলাল। অল্প বয়সেই কবিতা এবং গজল লেখা শুরু করেছিলেন, কবি ও গীতিকাররা যেমনটা করে থাকেন সাধারণত। কিন্তু ক্রমশ তাঁর চিন্তাভাবনা, ধ্যানজ্ঞান অধিকার করল ইসলামের ইতিহাস, নবীর কাহিনি, কারবালার মর্মান্তিক ইতিকথা। বিশেষ করে হাসান-হুসেনের করুণ পরিণতির স্মরণে রচিত শোকগীতি ‘মারসিয়া’। তিনি কেবল অন্য সব সৃষ্টি ছেড়ে মারসিয়া রচনায় মন দিলেন না, নিজের পুরনো সব লেখা ছিঁড়ে জলে ভাসিয়ে দিলেন। ইতিহাস তাঁকে মনে রেখেছে অসামান্য সব মারসিয়ার স্রষ্টা হিসেবে। আজও সেগুলি গাওয়া হয় এই মহরমের সময়।

আঠারো শতকের লখনউয়ের মানুষ চুন্নুলাল ধর্মে হিন্দু। জন্মসূত্রে পাওয়া সেই ধর্ম তিনি বদলাননি, বদলানোর কোনও প্রয়োজনও বোধ করেননি। তখন ধর্মের পরিচয় মানুষের পারস্পরিক মিলনে বাধা দিত না, বরং পরস্পরের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা এবং অনুভূতির দিগন্তকে আরও প্রসারিত করতে সাহায্য করত। সেই প্রসার যে কতখানি, তা বুঝে নেওয়া যায় ওই একটি লাইন থেকেই, যখন এক জন হিন্দু মানুষ প্রার্থনা করেন, (মহরমের দিনে) কারবালার বিষাদসিন্ধুর কল্লোলি যেন তাঁর একমাত্র বেদনা হয়, আর কোনও দুঃখ যেন সেই গভীর বেদনার উপলব্ধিতে ভাগ বসাতে না পারে। চুন্নুলাল একা নন, বেশ কিছু হিন্দুর লেখা মারসিয়া গীতি আছে, আজও গীত হয়ে সেগুলি। সত্যি বলতে কী, একটু ভাবলেই আমরা দিব্যি বুঝতে পারি, এতে অবাক হয়ে যাওয়ার কোনও কারণ নেই। মানুষ মানুষের দুঃখে কাঁদবে, এর মধ্যে ধর্ম আসবে কেন? ধর্ম যে আসে, এসে আমাদের গভীরতম দুঃখকেও আমরা-ওরায় ভাগ করে দেয়, সেটা আমাদেরই কীর্তি। কুকীর্তি।

মহরম গভীর বেদনার স্মারক। আমাদের সভ্যতায় সেই বেদনার অনুরণন ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক গণ্ডি মানেনি, অ-শিয়া তো বটেই, অ-মুসলমান বহু মানুষও কারবালার কাহিনি স্মরণ করে এবং সেই কাহিনির স্মরণে মহরম পালনের দৃশ্যাবলি দেখে চোখের জল মুছেছেন। একেবারে সেই আদি পর্ব থেকেই। শুধু বেদনার ভাগীদার হওয়া নয়, ধর্ম অতিক্রম করে আত্মবিসর্জনের ইতিহাসও একেবারে শুরু থেকেই লেখা হয়েছে। তার এক অসামান্য উদাহরণ হল হুসেনি ব্রাহ্মণরা। এই নামটির সঙ্গে আজ আমাদের পরিচয় কম, কিন্তু ইতিহাসটি সত্যিই অবিস্মরণীয়। ইতিহাস বলতে অবশ্য প্রধানত প্রচলিত ইতিহাস, যার কতটা সম্পূর্ণ সত্য আর কতটা লোককথা, তা নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে নানা মত আছে। কিন্তু সংখ্যা বা মাত্রা নিয়ে মতভেদ থাকলেও মূল কাহিনি নিয়ে বিশেষ সংশয় নেই।

মূল কাহিনি সপ্তম শতাব্দীর শেষের দিকের। ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে কারবালার সেই যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন রাহিব (বা রাহাব সিং) দত্ত এবং তাঁর সাত ছেলে। তাঁরা ছিলেন মহিয়াল নামক গোষ্ঠীর হিন্দু। এবং ব্রাহ্মণ। তাঁদের বাস ছিল এখনকার পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে। তখন পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গে ওই এলাকার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। খলিফা প্রথম ইয়েজিদের সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য ইমাম হোসেন সাহায্য চেয়ে পাঠিয়েছিলেন নানা অঞ্চলের বন্ধুভাবাপন্ন জনগোষ্ঠীর কাছে। আবেদন পেয়েছিলেন রাহিব দত্তের গোষ্ঠীও। তাঁদের সঙ্গে হজরত মহম্মদ ও হজরত আলির সুসম্পর্ক ছিল। তাঁরা স্থির করলেন, এই যুদ্ধে তাঁরা ইমাম হোসেনকে সাহায্য করবেন, কারণ তিনি ন্যায়ের পক্ষে। খলিফা যে অনেক বেশি শক্তিশালী, সে কথা অজানা ছিল না কারওই, কিন্তু ন্যায়যুদ্ধে শক্তির মাপ কষতে নেই। তাই রাহিব দত্ত সাত ছেলেকে নিয়ে যুদ্ধে গেলেন। তিনি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরতে পারলেন, কিন্তু সাত ছেলেরই প্রাণ গেল। সেই কাহিনি শুনে ইমাম হোসেনের বোন অভিভূত হলেন এবং তাঁদের হুসেনি ব্রাহ্মণ অভিধায় সম্মানিত করলেন। এই কাহিনির কতটা ইতিহাস, কতটা লোককথা, বলা কঠিন। কিন্তু এই কাহিনির মধ্যে যে আশ্চর্য সভ্যতার ইতিহাস লুকিয়ে আছে, সেটা মহরমের স্মৃতিচারণায় খুব গুরুত্বপূর্ণ। হুসেনি ব্রাহ্মণরা আজও আছেন ভারতের নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে। বহন করছেন এক গৌরবদীপ্ত সংহতির ঐতিহ্য।

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায় হাসিখুশি, এমনকী যখন সেই মোড-এ থাকেন না, নিজেকে ঠেলে হিঁচড়ে হিহিহোহো’তেই ল্যান্ড করানোর চেষ্টা করেন। জাপটে ভালবাসেন আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সিরিয়াল, গান, রাস্তায় নেড়িবাচ্চার লটরপটর কান। পড়াশোনার সময় ফিল্ড করেছেন, হাতুড়ি দিয়ে পাথর ভেঙেছেন, গ্রামবাসীদের তাড়া খেয়েছেন, এক বার পাহাড় থেকে অনেকটা হড়কে পড়ে মুচ্ছো গেছিলেন, উঠে দেখেন, কবর! এক বার ম্যানেজমেন্ট কোর্সের অঙ্গ হিসেবে চিন গেছিলেন, রাত্তির দুটোয় সাংহাইয়ের রাস্তায় হারিয়ে গিয়েও কাঁদেননি। ফিউজ সারাতে পারেন, পাখার কার্বন বদলাতে পারেন, কাগজের চোঙ পাকিয়ে গাড়িতে পেট্রল ঢালতে পারেন, চিনেবাদাম ছুড়ে দিয়ে মুখে নিপুণ লুফতে পারেন। ব্যাডমিন্টন খেলার ইচ্ছে খুব, কিন্তু জায়গা ও র‌্যাকেট নেই। অরোরা বোরিয়ালিস যারা দেখেছে, তাদের একাগ্র ভাবে হিংসে করেন। দেশের বাড়িটা উনি বড় হওয়ার পর ছোট হয়ে গেছে বলে, আর আমির খান এক বার কার্টুন এঁকে দিয়েছিলেন— সে কাগজ হারিয়ে গেছে বলে, জেনুইন কষ্ট পান। এক বার ঈগলের রাজকীয় উড়ান আগাগোড়া খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *