কেরলের ছোট্ট একটি গ্রাম। রাস্তার উপর এক চিলতে চায়ের দোকান। নাম ‘বারান্দা’। বাঁশের খুঁটির উপর মোটা নীল কাপড় লাগানো। আর পাঁচটা চায়ের দোকানের মতোই দেখতে। একেবারেই সাধারণ। দোকানের মালিকও সেই রকম। আলাদা করে নজর কাড়েন না। নাম শুকুর পেডায়ানগোদে। বয়স বোধ করি ৫০-এর উপরেই হবে। সকাল থেকেই শুরু হয়ে যায় ওঁর ব্যস্ততা। দক্ষ হাতে সসপ্যান থেকে এক নাগাড়ে চা ঢেলে দিতে থাকেন গ্রাহকদের। কখনও দুধ চা, কখনও আবার চিনি ছাড়া কালো চা। মনে হতেই পারে চায়ের দোকানে তো এমনটাই হওয়ার কথা। ঠিকই তাই। কিন্তু এ যে কেবল চায়ের দোকান নয়। পেডাইগোডে গ্রামের এই চায়ের দোকান বিখ্যাত অন্য কারণে। কান্নুর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে এই গ্রাম এখন এই চায়ের দোকানের কারণেই বিখ্যাত। কারণ এ যে শুধুই দোকান নয়, সাহিত্য কেন্দ্রও! কেরল তো বটেই, প্রতিবেশী তামিল নাড়ু ও কর্নাটক থেকেও তাবড় তাবড় লেখকরা এখানে এসে বই নিয়ে আলোচনা করেন।

কিছুদিন আগেকার ঘটনা, বাভালি নদীর জলের তোড়ে বারান্দা প্রায় ভেসে গেছিল। কিন্তু পেডায়ানগোদে তাতে বিন্দুমাত্র ভেঙে পড়েননি। আবার নতুন করে দোকান বানিয়ে শুরু করেছেন চা বিক্রি। তবে তাঁর বেশি উৎসাহ পরের আলোচনা সভা নিয়ে। ২৯ সেপ্টেম্বর এই সাহিত্য় সভায় যোগ দিতে আসবেন স্বয়ং নামকরা তামিল লেখক পেরুমাল মুরুগান। তাঁর বই ‘পুঞ্চালি’ নিয়ে কথা বলবেন তিনি। সারা দোকানে পুঞ্চালির মালায়ালাম অনুবাদ সাজিয়ে রাখা আছে। দেখলে বোঝা দায়, কোনও চা দোকান না বইয়ের দোকানে এসেছেন।

পেডায়ানগোদে ছোট থেকেই বই পড়তে ভালবাসতেন। স্কুলের গণ্ডি পেরোতে পারেননি ঠিকই, কিন্তু বই নিয়ে চর্চা করাটা আজও তাঁর নেশা। প্রায় চার বছর আগে প্রতি মাসে ছোটখাটো লিটেরারি মিট আয়োজন করা শুরু করেন। সাহিত্য সভায় উপস্থিত সকলেই এই আলোচনা বড় উপভোগ করতে শুরু করলে, উনি আরও উদ্দীপ্ত হন এবং বড়ভাবে এই ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজন করা শুরু করেন। আজ পর্যন্ত উনি প্রায় ৩৪টি লিটেরারি মিটের বন্দোবস্ত করেছেন। পল জাকারিয়া, এম. মুকুন্দন,খাদিজা মুমতাজ, পি.এফ. ম্যাথিউস, কলপেট্টা নারায়ানন, রফিক আহমেদ-এর মতো মালায়ালাম লেখক ও কবিরা এই দোকানে এসেছেন। বই নিয়ে আলোচনা করেছেন। কন্নড় লেখক বিবেক শানবাগ আর তামিল লেখক বি. জিয়ামোহন এখানে এসেছেন।

৫০-এর উপর বয়স হলে কী হবে, পেডায়ানগোদে সোশ্যালি ভালই অ্যাক্টিভ। প্রতিটা আলোচনা সভার ঘোষণা উনি ওঁর ফেসবুক পেজে আগেভাগে করে দেন। সাধারণত এই ধরনের অনুষ্ঠানগুলো তিন ঘণ্টা ধরে চলে। যে কোনও শ্রেণীর দর্শকের জন্য এর দরজা উন্মুক্ত, তাও আবার বিনামূল্যে। দর্শক খুব কাছ থেকে তাঁদের প্রিয় লেখকদের দেখতে পারেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। তেলেগু, তামিল বা কন্নড় লেখকদের ক্ষেত্রে ভাষার সমস্যা হতে পারে বলে উনি সব সময় এমন কোনও বন্ধুকে আলোচনা সভায় রাখেন, যিনি ওই ভাষাটি জানেন। এতে দর্শক আর লেখকের মধ্যে সেতু বাঁধা সহজ হয়ে যায়।

বইয়ের প্রতি পেডায়ানগোদের প্রেম আজকের নয়। সেই ছোট থেকেই হাতের কাছে যে বই পেতেন, তাই মহা আনন্দে পড়তেন। পঞ্চম শ্রেণীতে ভাইকম মুহাম্মদ বশিরের ‘মুছেত্তুকালিক্কারান্তে’ পড়ার পর বইয়ের নেশা আরও চেপে ধরে। অঙ্ক করতে মোটে ভাল বাসতেন না। ক্লাস ফাইভ পাশ করার পর থেকে অঙ্ক ক্লাসে ফাঁকি দিয়ে লুকিয়ে অন্য জায়গায় বসে বই পড়তেন। তারপর স্কুল যাওয়াই ছেড়ে দিলেন।

তবে বাড়িতে বসে থাকার পাত্র উনি ছিলেন না। ছোটখাটো কাজ করে যা আয় করতেন পরিবারকে দিয়ে দিতেন। মাছ বিক্রিও করতেন নিয়মিত। সেই থেকে যা উপর্জন করতেন, তার থেকে কিছুটা অংশ দিয়ে বই কিনতেন। পড়া হয়ে গেলে আবার সেগুলো বিক্রি করে দিতেন। এমনকী বয়ঃসন্ধির সময় বড়লোক বন্ধুদের জন্য কবিতা লিখে দিতেন। তাঁরা আবার ওকে তার জন্য বই কিনে দিতেন। ওঁর বেশ কিছু কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে—’নিলাভিলিকালুদে ভাষা’, ‘ওনপাথু পেনানগাল’, ‘মাজাপ্পোল্লাল।’

ওঁর লেখা বইয়ের নামে চায়ের দোকানের নাম রেখেছেন বারান্দা। আর সত্যিই তো যেখানে উন্মুক্ত মনে আলোচনা করা যায়, একে অপরের সঙ্গে কথা সহজে ভাগ করে নেওয়া যায়, তার তো এমনই নাম হওয়া উচিত। ওঁর একটাই ইচ্ছে, সকলের মধ্যে বই পড়ার তীব্র ইচ্ছে তৈরি করা। আর তার জন্য এরকম একটা খোলামেলা পরিবেশ তো দরকার। সাধারণত এক এটা অনুষ্ঠানে ৩০-৫০ জন দর্শক অংশগ্রহণ করেন। প্রকাশনা সংস্থাগুলিও তাদের বই এখানে বিক্রি করার জন্য পাঠিয়ে দেন। সেই বই বিক্রির কমিশন থেকেউ উনি সাহিত্য সভাগুলির আয়োজন করেন। কান্নুরের স্কুলগুলিতেও বুক ফেস্টের আয়োজন করেন পেডায়ানগোডে। স্থানীয় কলেজে তো নিয়মিত ডাক পান কোনও রকম সাহিত্য সংক্রান্ত অনুষ্ঠান থাকলে। এখন নিজেও আর একটি বই লেখার কাজ করছেন। ইচ্ছে আছে খুব তাড়াতাড়ি তা প্রকাশ করার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *