মেডিক্যাল কলেজকে ডান হাতে রেখে সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউ দিয়ে একটু এগিয়ে বাঁ দিকে বেঁকে ঢুকে পড়তে হবে কলুটোলা স্ট্রিটে। সারবাঁধা পুরনো বাড়ি আর কড়ি-বড়গার আপিসঘর দেখতে দেখতে খানিকটা এগোলেই আসবে একটা জমজমাট মোড়। সেখানে হলদেটে আলো মেখে ছোট ছোট ভ্যানের উপর হাঁড়িভর্তি হালিম নিয়ে বসে থাকা সৌম্যদর্শন বৃদ্ধদের জিজ্ঞাসা করলেই অ্যাডামস কাবাব শপের খোঁজ পাওয়া যাবে। ফিয়ার্স লেন, চুনা গলি। রংচটা লুঙ্গি আর ফতুয়া গায়ে সেই দোকানের একচিলতে ছোট্ট ঘরে অপেক্ষা করছেন বছর ষাটেকের মহম্মদ সালাউদ্দিন। তাঁর ঠাকুরদার তৈরি করা দোকান। বসার জায়গা নেই। থার্মোকলের প্লেটে কাবাব নিয়ে দাঁড়িয়ে খেতে হবে। দু’পা হাঁটলেই হাজি আলাউদ্দিনের মিষ্টির দোকান। তার বয়স শতক পেরিয়েছে। সেখানে মোট আট রকমের হালুয়া পাওয়া যায়। সালাউদ্দিনের হাতের সুতা কাবাবের স্বাদ নিয়ে কথা বলার মতো ভাষাজ্ঞান নেই আমার। মুখে দিলেই গলে যায়, টাকরায় ছড়িয়ে পড়ে পোড়া মাংসের আদর।

অ্যাডামস কাবাব শপ তৈরি হয়েছিল প্রায় ১০০ বছর আগে। সালাউদ্দিনের ঠাকুরদা ১৯২১ সালে কলুটোলার ফুটপাথে ভাজাভুজির দোকান দিয়েছিলেন। তার পর পসার একটু জমলে ধীরে ধীরে কাবাব বানাতে শুরু করেন। ত্রিশের দশক থেকেই স্থানীয়দের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সুতা কাবাব। স্থানীয় বাসিন্দা ৯২ বছরের বৃদ্ধ শোয়েব মহম্মদ কলুটোলায় আছেন ১৯৩০ সাল থেকে। তাঁর বাবা কাজ করতেন এক চিনা দাঁতের ডাক্তারের সহকারী হিসাবে। ছিলেন মুসলিম লিগের সক্রিয় কর্মী। কথায় কথায় বৃদ্ধ শোয়েব শোনালেন পুরনো দিনের গল্প। তাঁর কথায়, এই এলাকায় মুসলিম লীগ, কংগ্রেস, কমিউনিস্ট পার্টি- এই তিন দলেরই দফতর ছিল। রাজনৈতিক কর্মীরা প্রতি দিন সন্ধ্যায় কাবাব কিনে নিয়ে যেতেন এই দোকান থেকে। তা ছাড়া স্থানীয় বাসিন্দাদের বড় অংশই যেহেতু মুসলিম, তাই বিক্রিতে কখনও ভাটা পড়েনি।

কাবাবশিল্পী সালাউদ্দিনের সামনে কয়লার আগুন জ্বলে একটানা। গোরুর মাংসের সুতা কাবাবের দাম পঁচিশ টাকা আর বটি কাবাব ত্রিশ টাকা। বটি কাবাব বানাতে দশ মিনিট মতো সময় লাগে। সালাউদ্দিন মেজাজি মানুষ, জাস্ট পাত্তা দেন না খদ্দেরকে। কথা বলার চেষ্টা করে তেমন সুবিধা হয় না। সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না, পেলেও ছাড়া ছাড়া। বৃষ্টিতে ভিজে চুপ্পুস হয়ে যাওয়া সন্ধ্যায় তিনি বোঝালেন, লম্বা লোহার শিক থেকে মাংস যাতে পড়ে না যায়, সেই জন্যই সুতোর ব্যবহার। সুতো ধরে রাখে মাংসকে। সালাউদ্দিনের কাবাব তৈরির দিকে একটানা তাকিয়ে থাকলে ঠাকুমা-দিদিমাদের সোয়েটার বোনা দুপুরের কথা মনে পড়ে।

কাবাব তৈরি হতে হতে আপনার সঙ্গে পরিচয় হবে জাকারিয়া স্ট্রিটের ন্যাপথলিন ব্যবসায়ী ইসমাইল, চশমার দোকানদার অবিনাশ বা কলুটোলার বাড়ির দালাল শোয়েবের। আপনি শুনবেন কী ভাবে তোলা দিতে হয়, ব্যবসার হাল কেমন, বৃষ্টিতে জল জমে কি না- এই সব। নম্বর দেওয়ানেওয়া হবে। নিছক আড্ডা মারতেই পর দিন বিকেলে আপনি আবার হাজির হবেন ফিয়ার্স লেনে। বন্ধুত্ব বাড়বে। কথায় কথায় ক্রমশ আড্ডার বাঁক বদল হবে। ধর্মের পাঁচিল ডিঙিয়ে যাবে মানুষী উষ্ণতা আর ভাল খাবারের টান। তবে সে সব অন্য গল্প।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *