উচ্চতায় মাত্র সাড়ে চার ফুট। কিন্তু কীর্তিকলাপে বাঘা বাঘা লোকেদের ছাপিয়ে গেছেন। সেক্স ট্র্যাফিকিং রোখার অন্যতম কাণ্ডারি ইনি। মাত্র ১৫ বছর বয়সে ধর্ষিতা হয়েছিলেন। কিন্তু তাতেও মনোবল ভাঙেনি এক ফোঁটাও। আজ সবাই এই মানুষটিকে সম্মান করেন। পেয়েছেন বহু পুরস্কার এবং স্বীকৃতি। ইনি সুনীতা কৃষ্ণন। প্রজ্জ্বলা সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা।

সুনীতার জন্ম বেঙ্গালুরুতে, ১৯৭২ সালে। বাবা রাজু কৃষ্ণনের অত্যন্ত আদরের মেয়ে ছোট থেকেই বেশ ডাকাবুকো ছিলেন। “ আমি ছোটখাটো মানুষ। নিজের উচ্চতা নিয়ে বেশ লজ্জা পেতাম। কিন্তু বাবা একদিন বলেছিলেন মানুষের বাইরেটা দেখে কোনওদিন বিচার করতে নেই। ‘তোমার উচ্চতা কম হতে পারে, কিন্তু সে দিকে মন দিও না। মনের দিক থেকে বড় হওয়ার চেষ্টা কর’। বাবার এই কথাটা একদম গেঁথে গেছিল মনের ভিতরে”, জানালেন সুনীতা। তারপর থেকেই যাঁরা সমাজে বঞ্চিত, অবহেলিত তাঁদের জন্য কিছু করার কথা ভাবেন। মাত্র আট বছর বয়সেই মানসিক প্রতিবন্ধী বাচ্চাদের নাচ শেখাতে শুরু করেন। ১২ বছর বয়সে বস্তিতে গিয়ে বাচ্চাদের পড়াতেন। ১৫ বছর বয়সে দলিত সম্প্রদায়কে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা বোঝানোর জন্য নিও লিটেরাসি ক্যাম্পেন-এর আয়োজন করেন। তাঁর এই পদক্ষেপ সহ্য করতে পারেননি কিছু মানুষ। তাঁদের মনে হয়েছিল, একজন মহিলা হয়ে কৃষ্ণন কী করে এতটা ‘বাড়তে’ পারেন। আট জন বিকৃতমনষ্ক মানুষ নৃশংসভাবে ধর্ষণ করে সুনীতাকে। এত বাজে ভাবে তাঁকে মারধর করে যে একটি কানে আজও প্রায় ভালভাবে শুনতে পান না সুনীতা।

“প্রথমে বুঝতেই পারিনি, আমার সঙ্গে কী হচ্ছে। যখন বুঝলাম, তখন খুব বিপন্ন বোধ করেছিলাম। একদম গুটিয়ে গেছিলাম। বাবা-মাও আমার পরিস্থিতি বুঝতে পারেননি। আমি খুব সাধারণ নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। ফলে বাবা-মার মনে লোক লজ্জার ভয় সৃষ্টি হয়েছিল। তাঁরা আমাকে খুব একটা মানসিকভাবে উদ্দীপ্ত করতে পারেননি।” তবে এত কিছুর পরও সুনীতা থেমে যাননি। মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিলেন বাকি জীবনটা কীভাবে কাটাবেন। প্রথম দিকে বাবা-মায়ের থেকে বল ভরসা না পেলেও পরবর্তীকালে তাঁরা বুঝে গেছিলেন যে এই মেয়েকে বাড়িতে বসিয়ে রাখা যাবে না। ওঁর মতাদর্শ থেকে টলানো যাবে না। তার পর আর তাঁরা বাধা দেননি।

“জানেন, ধর্ষণের মতো ঘটনা আমাক ভাঙতে পারেনি, বরং আরও বেশি মানসিক জোর দিয়েছিল। বুঝতে পেরেছিলাম যে আমার রাস্তাটা ভুল নয়। আমার ভিতরে এমন এক রাগ জন্মেছিল, যে তার আগুন এখনও দাউ দাউ করে জ্বলছে। আর তাই আমার এনজিও-র নাম রেখেছি প্রজ্জ্বলা। এই আগুন আমি কোনওদিনও নিভতে দেব না।” স্কুল শেষ করার পর ম্যাঙ্গালোর থেকে সুনীতা সোশ্যাল ওয়র্ক নিয়ে পড়াশোনা শেষ করেন। আর তার পর শুরু হয় তাঁর আসল যুদ্ধ।

১৯৯৬ সাল থেকেই সুনীতা রীতিমতো সামাজিক কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তার জন্য জেলও যেতে হয়েছিল তাঁকে। সুনীতা বুঝে গেছিলেন যে তাঁর এই জীবনযাপন বাবা-মা মেনে নিতে পারছেন না। তাই উনি বেঙ্গালুরু ছেড়ে হায়দরাবাদ চলে যান। “ বাবা-মার সঙ্গে আমার কোনও বিরোধ নেই। ওঁরা আমাক সমর্থন যেমন করেননি, বাধাও দেননি। কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম আমি যে লড়াইটা শুরু করেছি, তাতে হয়তো তাঁদের আমার পাশে পাব না। হায়দরাবাদ চলে যাই। এখনও আমার বাবা-মা আমার কাছে থাকেন না। আমার মা মাঝে মধ্যে আসেন। আমাকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করেন। কিন্তু মেনে নিয়েছেন এই একরোখা, জেদি মেয়েকে পাল্টানো যাবে না।”

 ১৯৯৬ সালেই হায়দরাবাদের রেড লাইট এরিয়া ‘মেহবুব কি মেহেন্দি’ থেকে সমস্ত বেশ্যাদের উৎখাত করে দেওয়া হয়। সুনীতা তাঁদের আশ্রয় দিতে সেখানেই একটি ট্র্যানসিজন স্কুল খোলেন, যাতে বেশ্যাদের পরবর্তী প্রজন্মের এই একই দশা না হয়। সেই থেকে প্রজ্জ্বলার পথ চলা শুরু। “ প্রথম দিকে প্রজ্জ্বলার খরচ চালাতে আমি নিজের সমস্ত গয়নাগাটি, বাড়ির জিনিসপত্র বিক্রি করে দিয়েছিলাম। এখন আমরা স্বনির্ভর হতে পেরেছি। তবে এখনও অনেক কিছু করা বাকি।” প্রজ্জ্বলা আজ পর্যন্ত ১২০০০-এরও বেশি মেয়েদের নারী পাচারকারীদের হাত থেকে উদ্ধার করেছে। তাঁদের সমস্ত রকম আর্থিক, মানসিক, আইনি, সামাজিক সাহায্য দেয় প্রজ্জ্বলা। “ আমরা তাঁদের পড়োশানো শেখাই, হাতের কাজ শেখাই যাতে তাঁরা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে। তবে সবচেয়ে কঠিন কাজ নারী পাচারের ভিক্টিমদের আবার নিজেদের জগতে ফিরিয়ে দেওয়া। তাঁরা যে মানসিক এবং শারীরিক অত্যাচারের শিকার হয়েছেন, তার থেকে তাঁদের বার করে আনতে অনেক সময় লাগে। অনেকে আবার এই জীবন মেনে নিতে চান না। তাঁদের মনে হয় ওই জীবনই ভাল ছিল কারণ সেখানে তাঁরা আর্থিক স্বচ্ছলতা ছিল। এই মানসিকতা বদলাতে অনেক কাঠ খড় পোড়াতে হয়।”

প্রজ্জ্বলায় এখন প্রায় ২০০জন কাজ করেন। সুনীতা অবশ্য এর থেকে একটি টাকাও নেন না। ওঁর স্বামী রাজেশ সুনীতাকে সব সময় শক্ত থাকতে বলেন। রাজেশ পেশায় ফিল্মমেকার। প্রজ্জ্বলার জন্যেও সিনেমা বানিয়েছেন। “রাজেশ আমার সবচেয়ে বড় চিয়ারলিডার। আমি যখনই দুর্বল হয়ে পড়ি, তখনই আমাকে সাহস জোগায়। এক বার রাতারাতি প্রজ্জ্বলার এক ট্র্যানসিজন সেন্টারে এসে দুষ্কৃতিরা সবাইকে উৎখাত করে দেয়। এতগুলো মানুষ কোথায় যাবে ভেবেই পাচ্ছিলাম না। রাজেশই বলে জমি কিনে সেন্টার বানাতে। তা হলে আর কেউ যখন তখন আমাদের উঠিয়ে দিতে পারবে না”

সুনীতার উপর আজ পর্যন্ত প্রায় ১৪ বার আক্রমণ হয়েছে। কিন্তু এত কিছুর পরও সুনীতা তাঁর লক্ষ্য থেকে সরে আসেননি। পুরস্কার, সম্মান পেয়েছেন প্রচুর। পদ্মশ্রী পুরস্কার ওঁর জীবনের অন্যতম সেরা প্রাপ্তি। “আমার পুরস্কার কিন্তু আসলে ওই বাচ্চা মেয়েগুলোর হাসি। ওঁরা যখন ধর্ষনের আতঙ্ক, ক্ষত, অপমান ভুলে, অন্ধকার জীবন থেকে মুক্তি পেয়ে আবার নতুনভাবে বাঁচার আশ্বাস পায়, তখন মনে হয় এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি বোধহয় আর কিছু হতে পারে না।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *