ছোটবেলায় ডাক্তারের নাম শুনলেই গায়ে জ্বর আসত। আসলে ডাক্তার মানেই আমার কাছে ছিল ইনজেকশন, একগাদা পরীক্ষানিরীক্ষা আর বিচ্ছিরি সব তিতকূটে ওষুধ। মা পুরো মুখ হাঁ করে খাইয়ে দিতেন। ছোট থেকেই ডাক্তারের প্রতি আমার বেজায় রাগ। ছ’ মাস অন্তর বাড়ির সবার আবার মেডিক্যাল চেক-আপ হত। ছেলেবেলায় না পারলেও, বড় হতে হতে পড়ে, টিউশন, কলেজ এ সবের আছিলা দেখিয়ে পালাবার চেষ্টা করতাম। কিন্তু বিধি বাম! আমার দাদু ছিলেন ব্যাঙ্কের দুঁদে চেয়ারম্যান। অত্যন্ত রাগী আর অনুশাসনপ্রিয়। অতয়েব কলেজ গোল্লায় যেতে পারে, কিন্তু ডাক্তারের ক্লিনিকে হাজিরা দেওয়া বাতিল করা চলবে না। প্রতি বারই আমার যাবতীয় পরিকল্পনা মুখ থুবড়ে পড়ত। আর যেতে হত পারিবারিক ডাক্তার রাধু জেঠ্যুর কাছে। পুরো নাম রাধারমণ চট্টাপাধ্যায়। জ্যেঠুকে কম প্রলোভন দেখাইনি আমাকে নিস্তার দেওয়ার জন্য। কিন্তু উনি ছিলেন আমার দাদুর বড় ঘনিষ্ঠ, ফলে সেখানেও আমার ডাল মোটে গলত না। কুইনিন খাওয়ার মতো তেতো মুখ করে সব গিলতে হত। তাই বোধহয় ডাক্তারে আমার বড় অরুচি।
যাই হোক, আমার এই এত ভূমিকার কারণ কোনও অসুখ বা চিকিৎসা নিয়ে আলোচনা নয়। ইদানীংকালে ডাক্তারদের ঠাঁটবাট দেখে আমার তো চক্ষু চড়কগাছ। না না, বাস্তবের ডাক্তারদের থেকে এখনও আমি দূরে থাকি। কিন্তু বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে সিরিয়ালের ডাক্তারদের ভাল করে দেখেছেন? উফ! কী সুদর্শন তাঁরা। তাঁদের সুঠাম চেহারা দেখলে নায়কদের রীতিমতো কমপ্লেক্স হতে বাধ্য। আর সব সময় হাসছেন, গুরু গম্ভীর ভাব মোটে নেই। দেখি আর ভাবি, আমার ছোটবেলায় এমন ডাক্তার কেন পায়নি! এই সব ডাক্তাররা নেহাত আর রোগীর সেবায় নিয়োজিত থাকেন না। তাঁরা হলেন সুপার হিরো। যেখানে সেখানে যখন তখন পৌঁছে যেতে পারেন। ওষুধ নয়, ঘরোয়া টোটকায় এঁরা দারুণ বিশ্বাস করেন। এমনকী, আপনার রান্নাঘরে আরশোলা মারতেও ডাক্তার সাদা কোট পড়ে চলে আসতে পারেন। বাস্তবের ডাক্তারের সঙ্গে মিল খুঁজলে কিন্তু হবে না। হসপিটালের ডাক্তার আপনার নাই পছন্দ হতে পারে, কিন্তু এঁদের এই সদা হাসি খুশি মুখ আপনি এড়িয়ে যাবেন কী করে? মেডিসিনের ডাক্তার থেকে গাইনিকলোজিস্ট সবাইকে যাঁরা একেবারে নতুন অবতারে হাজির করেন, তাঁদের ভাবনাকে বাহবা তো জানাতেই হয়। তাই না? আমি বেছেবুছে আমার পছন্দের একটা তালিকা তৈরি করলাম এই সব ডাক্তারদের, দেখুন তো আপনাদের সঙ্গে মেলে কি না!
শিশু চিকিৎসক-আপনার বাচ্চার হাঁচি-কাশি, জ্বর বা নাক সুড়সুড় করলেই এঁরা সটান আপনার বাড়িতে চলে আসবেন। বলা ভাল আচমকাই আবির্ভূত হবেন। অনেকটা অ্যামাজনের হোম ডেলিভারির মতো। পেট ব্যথা থেকে শুরু করে সব সমস্যার একটাই সমাধান এঁদের কাছে আর তা হল ভাল করে লিক্যুইড সাবান দিয়ে হাত ধোওয়া। সঙ্গে করে নিয়েও আসবেন পছন্দের ব্র্যান্ডটি। আর গ্যারান্টিও দেবেন, ওই দিয়ে হাত ধুলে ৯৯% জীবানু আপনার সন্তানের ধারকাছ মাড়াতে পারবে না!
স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞ—বিজ্ঞাপনের দুনিয়া পুরুষদের আবার গাইনিকলোজিস্ট হতে নেই। সেখানে শুধুই মহিলাদের অবাধ গতিবিধি। এঁরা অবশ্য আপনার বাড়িতে আসেন না। চোখে চশমা এঁটে সাদা কোট পরে চেম্বারে বসে থাকেন আপনার অপেক্ষায়। আর আপনার যাওয়া মাত্র, দেওয়ালের সমস্ত আলো জ্বেলে আপনাকে বডি চার্ট দেখাতে বসে যান। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ক্যালশিয়াম সাপ্লিমেন্ট বা হেলথ ড্রিঙ্কের গুণগান করে আপনাকে নিস্তার দেন। বাকি সমস্যা নিয়ে এঁরা মোটেই বিচলিত নন।
ডেন্টিস্ট- এঁরা আবার দু’ধরনের, তবে ওষুধ বা অপারেশনের কথা কেউই বলেন না। দাঁতের উপর আলো ফেলে, নাড়াচাড়া করেন। দাঁতের অ্যানিমেটেড ভিডিও দেখিয়ে হয় টুথব্রাশ বদলাতে বলেন, নতুবা নতুন পেস্ট ব্যবহার করার সুপরামর্শ দেন। কোন পেস্টে নুন, লবঙ্গ, আয়ুর্বেদিক গুণ আছে, তা তাঁদের কণ্ঠস্থ। আর টুথব্রাশের ব্রিসল নিয়ে তো রীতিমতো পিএইচডি করেছেন। স্যাম্পলও এঁরা হাতের কাছেই রাখেন। এঁদের কাছে গেলে দাঁত তোলানোর কোনও ঝামেলাই কিন্তু পোহাতে হবে না। ভেবে দেখতে পারেন!
মে়ডিসিনের ডাক্তার-সবচেয়ে বেশি কাঠখড় পুড়িয়ে এঁরাই পড়াশোনা করেন। ডাক্তারদের মধ্যে এঁদের কদরও সবচেয়ে বেশি। কিন্তু রিল দুনিয়ায় এঁদের অবস্থা বড় করুণ। মশা-মাছির উপদ্রব, আরশোলার তাণ্ডব, ইঁদুরের দৌরাত্ম্যের মোকাবিলা করাই এঁদের একমাত্র কাজ। কয়েল, স্প্রে, ওষুধ দিয়ে এঁরা সব সমস্যার সমাধান করে ফেলেন। ডেঙ্গু ,চিকনগুনিয়া, বার্ড ফ্লু-এর সময় এঁদের যাতায়াত একটু বেশি বেড়ে যায়।
ত্বক বিশেষজ্ঞ-ত্বকের পোড়া দাগ কিংবা কাটা ছেঁড়া, সব সমাধানই এঁদের কাছে মজুত। ল্যাবরেটরিতে চোখ মাইক্রোস্কোপে রেখে এঁরা প্রচুর গবেষণা করেন। আর তারপর পকেট থেকে বার করেন নানা বিধ ক্রিম, লোশন। ত্বকের সব সমস্যা তো গায়েব হয়ই, বাড়তি পাওনা ধবধবে ফর্সা, মাখন মসৃণ ত্বক।
ডায়েটিশিয়ান-ডাক্তারের থেকে কোনও অংশে কম নন এঁরা। বাচ্চারা যে মোটে পুষ্টি পাচ্ছে না, তা নিয়ে এঁরা বেজায় চিন্তিত। কোন ড্রিঙ্ক, কোন কর্নফ্লেকস খেলে বাচ্চা বাড়বে সহজেই বলে দেবেন। বাড়ির খাবার যে বাচ্চারা খেতে ভালবাসে না এবং একমাত্র তাঁর পছন্দের চকোলেট মিল্ক খেলেই বাড়বে তাও জানিয়ে দেবেন। তবে শুধু বাচ্চা নন, আপনার শরীর স্বাস্থ্য নিয়েও এঁরা সচেতন। আপনার জন্যেও সাপ্লিমেন্ট বলে দেবেন।
সিরিয়াল দুনিয়ার ডাক্তাররা তো আরও এগিয়ে। এঁরা গান গাইতে পারেন, শিষ দিতে দিতে হাসপাতালের করিডোরে ঘুরে বেড়াতে পারেন, নিউরোসার্জন হার্ট ট্রান্স্প্ল্যান্ট করতে পারেন, এবং অবশ্যই জুনিয়র ডাক্তারের সঙ্গে প্রথমে ঝগড়া এবং পরে প্রেম করতে পারেন।
আহা! ডাক্তারদের জগৎ সত্যি বড় রঙিন। মেডিক্যাল সায়েন্স গোল্লায় যাক, গ্ল্যামারে কমতি থাকলে মোটেও চলবে না। আর আমরাও কী অনায়াসে এই মেকি, সাজানোগোছানো পৃথিবীর আকর্ষণ উপেক্ষা করতে পারি না। অথচ যাঁরা বাস্তবে নাওয়া-খাওয়ার সময় পান না, তাঁদের পান থেকে চুন খসলেই তুলোধনা করি। হায় রে দুনিয়া! ঝাঁ চকচকে কাচই যে এখন হিরে মনে হয় আমাদের!