গত দশকের মাঝমাঝি পর্যন্ত কলকাতার একটা জন্মদিন ছিল। ছিলেন এক জন প্রতিষ্ঠাতাও। কিন্তু প্রায় দেড় দশক ধরে আর সে সবের বালাই নেই তিলোত্তমার। কিন্তু ঠিক কী ভাবে জন্মদিন এবং জন্মদাতার থেকে আলাদা হল তিলোত্তমা?

২০০৩-০৪ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর ২৪ অগস্ট কলকাতার জন্মদিন পালিত হত শহরের বিভিন্ন প্রান্তে, মহাসমারোহে। সেই উদযাপনের অঙ্গ হিসাবেই স্মরণ করা হত জব চার্নককে। মনে করা হত তিনিই কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা। পাঠ্যপুস্তকেও লেখা থাকত কলকাতার জন্মবৃত্তান্ত। তা খানিকটা এই রকম : ১৬৮৬ খ্রিস্টাব্দের ২৪ অগস্ট চার্নক প্রথম পা রাখেন সুতানূটিতে। ৪ বছর পর ১৬৯০ সালের একই তারিখে তিনি আসেন কলকাতায়। তারপর থেকেই সুতানূটি, গোবিন্দপুর, কলকাতা নিয়ে জন্ম নেয় তিলোত্তমা। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৬ হাজার টাকার বিনিময়ে কলকাতায় ইউনিয়ন জ্যাক তোলার অধিকারী হয়। চার্নকই যে হেতু কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা, তাই যে তারিখে তিনি প্রথম পা রেখেছিলেন এই তল্লাটে, সেটিই মহানগরের জন্মদিন। কলকাতার ৩০০ বছর পূর্তিতে বড় উৎসব হয়েছিল শহরে।

কিন্তু আদৌ জব চার্নক কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা কি না, তা নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘ দিনের। ১৬৯০ সালকে আদৌ কলকাতার জন্মবর্য বলা যায় কিনা, সেই প্রশ্নও তুলেছিলেন ইতিহাসবিদদের একাংশ। তাঁদের যুক্তি ছিল, ১৬৯০ সালের অনেক আগে থেকেই কলকাতা নামক এই জনপদের অস্তিত্ব ছিল। ব্রিটিশরা কলকাতাকে আর্ন্তজাতিক মানচিত্রে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছেন ঠিকই, কিন্তু কলকাতার প্রতিষ্ঠা তাঁরা করেননি। ১৯৯১ সালে প্রকাশিত কলকাতা বিচিত্রা বইতে রাধারমণ মিত্র একের পর যুক্তি দিয়ে দেখান, চার্নক কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা নন। তিনি দেখান, ১৪৯৫ খ্রিস্টাব্দে বিপ্রদাস পিপলাই রচিত মনসাবিজয় কাব্যে কলিকাতার উল্লেখ আছে, মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গল কাব্যেও উল্লেখ রয়েছে কলিকাতার। যদিও এই দুই ক্ষেত্রেই বিতর্ক রয়েছে। ঐতিহাসিকদের একাংশের যুক্তি, এই দুই কাব্যেই কলিকাতা শব্দটি প্রক্ষিপ্ত, অনেক পরে যুক্ত। তবে রাধারমণ আরও দেখান, ইংরেজদের লেখায় ক্যালকাটা নামটির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১৬৮৮ সালে। একটি চিঠিতে। তা ছাড়া চার্নক ১৬৯০ সালের আগে আরও দু বার পা রেখেছিলেন কলকাতায়। তাই কোনোভাবেই তাঁকে কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা এবং ২৪ অগস্টকে কলকাতার জন্মদিন বলা যায় না।

২০০১ সালে এই নিয়ে মামলা হয় হাইকোর্টে। বাদী পক্ষে ছিলেন সাবর্ণ রায়চৌধুরি পরিবার পরিষদের তিন প্রতিনিধি এবং রাধারমণ মিত্র-সহ ৯ জন। তাঁদের আইনজীবী ছিলেন অজিত পাঁজা ও স্মরজিৎ রায়চৌধুরি। অন্য দিকে, প্রতিবাদী পক্ষে ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার, কলকাতা পুরসভা, কলকাতা পুরসভার মহানাগরিক, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিক্ষাবিভাগের সচিব, ভারত সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের সচিব। প্রতিবাদী পক্ষের আইনজীবী ছিলেন দুঁদে উকিল বলাই রায়।

দুই পক্ষের বক্তব্য শোনার পর আদালত ৫ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। কমিটির সদস্যরা প্রত্যেকেই ছিলেন নামজাদা ইতিহাসবিদ। বরুণ দে, সুশীল চৌধুরি, নিমাইসাধন বসু, প্রদীপ সিংহ এবং অরুণকুমার দাশগুপ্তের ওই কমিটি ২০০২ সালের নভেম্বরে রিপোর্ট পেশ করেন। তাতে বলা হয়- কলকাতার কোনও নির্দিষ্ট জন্মদিন থাকা সম্ভাব নয়, চার্নক আসার অনেক আগে থেকেই কলকাতার অস্তিত্ব ছিল। পরের বছর বলাই রায় আদালতে জানান, রাজ্য সরকার কমিটির রিপোর্ট মেনে নিয়েছে। এর পর আদালত নির্দেশ দেয়, পাঠ্যপুস্তক-সহ কোনও জায়গাতেই কলকাতার জন্মতারিখ উল্লেখ করা যাবে না। কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে চার্নকের নামও লেখা যাবে না।

তখন থেকেই কলকাতার কোনও জন্মদিন নেই, নেই প্রতিষ্ঠাতাও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *