কাশ্মীর নিয়ে কার্যত উল্টো মেরুতে দাঁড়িয়ে রয়েছে আমেরিকা ও ব্রিটেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন একাধিক বার ভারত-পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক বৈরিতা এবং কাশ্মীর সংকটে মধ্যস্থতা করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে, ব্রিটেনের অবস্থান তখন অনেকটাই সতর্ক। সাধারণত অধিকাংশ আর্ন্তজাতিক সংকটের ক্ষেত্রে একই সুরে কথা বলে আমেরিকা ও ব্রিটেন। কিন্তু কাশ্মীরের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি অনেকটাই আলাদা। এমনকি রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকেও আমেরিকা ও ব্রিটেন এক অবস্থান নেয়নি। দুই দেশের এমন ভিন্নধর্মী অবস্থানের নেপথ্যে রয়েছে ঠিক কী সমীকরণ?

মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে পাশে বসিয়ে দাবি করেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁকে কাশ্মীর সংকটে মধ্যস্থতা করতে আর্জি জানিয়েছেন। ট্রাম্পের সেই মন্তব্য নিয়ে বিশ্বজুড়ে শুরু হয় বিতর্ক। ভারতের বিদেশ মন্ত্রক সরাসরি জানিয়ে দেয়, মার্কিন রাষ্ট্রপতি সঠিক কথা বলেননি। কাশ্মীর ভারত-পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক বিষয়। এতে তৃতীয় কোনও পক্ষের হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই। এর পর গত সোমবার ট্রাম্প পরপর ফোন করেন মোদী এবং ইমরানকে। মঙ্গলবার হোয়াইট হাউজে সাংবাদিক বৈঠক করে ফের তিনি মধ্যস্থতার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।

আমেরিকার উল্টোপথে হেঁটে এখনও পর্যন্ত কাশ্মীর প্রশ্নে ভারত-পাকিস্তান দুই পক্ষের থেকেই সমদূরত্ব বজায় রেখেছে ব্রিটেন। রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ব্রিটেনের স্থায়ী প্রতিনিধির অবস্থান পাকিস্তানের পক্ষে আশাপ্রদ বলে দাবি কূটনীতিবিদদের একাংশের।। অন্য দিকে ইংরেজ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ফোনে কথা বলেছেন মোদীর সঙ্গে। সব মিলিয়ে কাশ্মীর বিষয়ে ব্রিটেন ভারসাম্যের পথে হাঁটতে চাইছে বলে মত আর্ন্তজাতিক রাজনীতির কারবারিদের।

মঙ্গল বার ঠিক কী বলেছেন ট্রাম্প? একাধিকবার মধ্যস্থতার প্রস্তাব দেওয়ার নেপথ্যে রয়েছে কোন ভাবনা? 

মার্কিন রাষ্ট্রপতি মঙ্গলবার বলেন, “কাশ্মীরে ভারত, পাকিস্তান দুই পক্ষই ভারী অস্ত্র ব্যবহার করছে। সমস্যা অত্যন্ত জটিল চেহারা নিয়েছে। আমার সঙ্গে দুই দেশের নেতৃত্বের সম্পর্কই অত্যন্ত ভাল। আমার ধারণা, আমরা বিষয়টি সমাধানের চেষ্টাই করছি।” এর পর তিনি ইঙ্গিত দেন, আগামী ২৬ অগস্ট ফ্রান্সের বিয়ারিৎজে  জি-৭ সম্মেলন চলাকালীন তিনি মোদীর সঙ্গে বৈঠক করতে পারেন। ট্রাম্পের কথায়, “কিছু দিন আগে ইমরান খান আমেরিকায় এসেছিলেন। আমার সঙ্গে তাঁর বিশদে কথা হয়েছে। চলতি সপ্তাহের শেষে আমি ফ্রান্সেে মোদীর সঙ্গে থাকব। ওঁর সঙ্গেও কথা হবে আমার।”মার্কিন রাষ্ট্রপতির সংযোজন, “ইমরান এবং মোদী দুজনেই আমার ভাল বন্ধু, চমৎকার মানুষ। দুজনেই নিজের দেশকে ভালবাসেন।”

একাধিক বার খানিকটা যেচেই মধ্যস্থতার প্রস্তাবের পিছনে আমেরিকার বৈদেশিক রাজনীতির ছাপ দেখছেন অনেকে। দীর্ঘ দিন ধরেই আফগানিস্থানে মোতায়েন মার্কিন সেনা সরানোর প্রচেষ্টা শুরু করেছে হোয়াইট হাউজ। সম্প্রতি সেই উদ্যোগ গতি পেয়েছে। পাশাপাশি তালিবানের সঙ্গে শান্তিপ্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানের সক্রিয় সহযোগিতা ব্যতিরেকে এই কাজ করা সম্ভব নয়। ওয়াশিংটনের আশঙ্কা, কাশ্মীর সংঘাতের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে পাকিস্তানের সেনা ভারতীয় সীমানাতেই ব্যস্ত থাকবে। ফলে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যহারের বিষয়টি পিছিয়ে যাবে। মন্থর হয়ে পড়বে তালিবানের সঙ্গে শান্তিপক্রিয়াটিও।

কাশ্মীর নিয়ে ব্রিটেনের অবদান অনেকটাই সতর্ক। কূটনৈতিক মহলের একাংশের দাবি, এই প্রসঙ্গে মেপে পা ফেলতে চাইছে ডাউনিং স্ট্রিট। আপাতত ভারত-পাকিস্তান কোনও পক্ষকেই অসন্তুষ্ট করতে চায় না লন্ডন। এর নেপথ্যে এক দিকে যেমন রয়েছে ব্রেক্সিট পরবর্তী ব্রিটেনের বাণিজ্যিক স্বার্থ, অন্য দিকে রয়েছে পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরানের ব্রিটিশ যোগ। তা ছাড়া বিপুল সংখ্যক ভারতীয় ও পাকিস্তানির বাস ব্রিটেনে। তাঁদের বিব্রত করতে চায় না বরিস জনসনের সরকার। বিশেষত পাকিস্তানি ভোট হাতছাড়া করতে নারাজ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী।

বুধবার ফোনে মোদীর সঙ্গে কথা বলেছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জনসন। মোদীকে জনসন জানান, লন্ডনে ভারতীয় হাইকমিশনের পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর পর ডাউনিং স্ট্রিট বিবৃতি দিয়ে জানায়, দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে আলোচনা হয়েছে। জনসন জানিয়েছেন, ব্রিটেন মনে করে কাশ্মীর ভারত-পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক সমস্যা। আলোচনার মাধ্যমেই এর সমাধান সম্ভব। আর্ন্তজাতিক রাজনীতি বিশেষজ্ঞদের একাংশের ব্যাখ্যা, ব্রেক্সিট পরবর্তী কালে নতুন দিল্লির সঙ্গে ব্রিটেনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নত করা অত্যন্ত জরুরি। তাই ভারতের পক্ষে অস্বস্তিকর পদক্ষেপ করতে চায় না লন্ডন। কনজারভেটিভ পার্টি চিরকালই ভারতপন্থী। ডেভিড ক্যামেরন, থেরেসা মে-র সময় থেকেই ডাউনিং স্ট্রিটের সঙ্গে নয়াদিল্লির সম্পর্ক ভাল। তাই কাশ্মীর প্রশ্নে ভারত বিরোধিতার পথে হাঁটবে না ব্রিটেন। অথচ, পাকিস্তানের বিরাগভাজনও হতে চায় না জনসনের সরকার। তাই নিরাপত্তা পরিষদে আমেরিকা বা ফ্রান্সের মতো ভারতের পাশে দাঁড়াননি ব্রিটিশ প্রতিনিধি। পরিবর্তে পরিষদকে বিবৃতি দিতে বলেছেন কাশ্মীর ইস্যুতে। জম্মু-কাশ্মীরে মানবাধিকারের প্রশ্নও তুলেছেন তিনি। এর নেপথ্যে ইমরানের ব্রিটিশ যোগের প্রভাব দেখছেন অনেকে।

পাক প্রধানমন্ত্রী অক্সফোর্ডের প্রাক্তন ছাত্র। তাঁর প্রাক্তন স্ত্রী জেমাইমা ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ জেমস গোল্ডস্মিথের কন্যা। জেমাইমার ভাই জ্যাক কনজারভেটিভ পার্টির সাংসদ এবং প্রধানমন্ত্রীর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। ফলে ব্রিটেনের রাজনীতিতে এই মূহুর্তে ইমরানের যোগাযোগ অত্যন্ত শক্তিশালী। তাই ব্রিটেনকে নিয়ে আশঙ্কা নেই ইসলামাবাদের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *