কফি হাউস-এর সেই আড্ডাটা নেই, নেই তার স্রষ্টাও। কিন্তু তাঁর গান আজও একইভাবে অমলিন। গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের মৃত্যুদিনে তাঁর স্মৃতিচারণ করলেন ৭০ ও ৮০-র দশকের বাংলা যাত্রা ও সিনেমার বিখ্যাত সুরকার প্রশান্ত ভট্টাচার্য।

‘’গৌরীপ্রসন্ন মজুমাদার ওরফে গৌরীদার সঙ্গে আমার পরিচয় অনেক দিনের। জীবনের প্রথম থেকেই প্রায় ওঁকে চিনতাম। তবে কাজ করার সুযোগ ঠিক হচ্ছিল না। তার পর উনি এক দিন ডেকে আমায় বললেন, ‘কী আমার সঙ্গে কাজ টাজ করবে না নাকি?’ এমনটাই খোলামেলা মনের মানুষ ছিলেন উনি। সহজ কথা সহজ ভাবে বলতে পারতেন। যাই হোক তখন একটা ছবির কাজের কথা হচ্ছিল। ওঁকে বললাম গান লিখতে। উনিও রাজি হয়ে গেলেন। এক দিন গান লিখবেন বলে আমাকে নিয়ে গেলেন অশ্বীনি দত্ত রোডে। যেতে যেতে হঠাৎ বললেন পেন কিনতে হবে। আমি তো অবাক পেন তো সঙ্গেই আছে। উনি বললেন প্রতিটা নতুন গান নাকি উনি নতুন পেন দিয়েই লেখেন। তারপর বললেন ওঁর একটা গদি চাই। আমি মনে মনে প্রমাদ গুনছি। পেন, গদি, এর পর আর কিছু না চেয়ে বসেন। যাই হোক গদি পেয়ে উনি গুছিয়ে লিখতে বসলেন। তার পর পকেট থেকে দেখি একটা লম্বাটে বাক্স বার করেলেন। তার ভিতর থেকে বের হল চশমার ফ্রেম। কিন্তু তাতে কোনও হ্যান্ডল ছিল না। আমি কিছু বলার আগেই দেখি লম্বাটে দুটো ভাঁজ করা ডান্ডা বার করে লাগিয়ে নিলেন ফ্রেমে। বুঝলাম ফোল্ডিং চশমা। এর আগে আমি কখনও এই ধরনের চশমা দেখিনি। আমার মুখে বিস্ময় দেখে নিজেই বলে উঠলেন, ‘এটা ফোল্ডিং চশমা বুঝলে। বিদেশ থেকে আনিয়েছি। ভারী ভাল লাগে পরতে।’ এতটাই শৌখিন ছিলেন গৌরীদা। খুব আমুদে, হইহল্লা করতে পছন্দ করতেন।

আর একটা ঘটনার কথা খুব মনে পড়ে। একটা ছবিতে সুর দিচ্ছি। গৌরীদা গীতিকার। উনি গান লিখে দিয়েছেন। সুরের উপর কাজ করছি। হঠাৎ মনে হল কোথাও একটা খামতি থেকে যাচ্ছে। ফোন করলাম ওঁকে। উনি সুরটা ফোনে শুনে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বলে দিলেন ‘আমি তোমার, তুমি আমারই,’’ কথাগুলো যোগ করে দিতে। দেখলাম একেবারে সুরের সঙ্গে মিলে গেল। এতটাই প্রতিভাসম্পন্ন মানুষ ছিলেন উনি। ফোনে এ ভাবে সুরের সঙ্গে কথা মিলিয়ে দিতে আমি আর কাউকে দেখিনি। পড়াশোনাতেও তুখোড় ছিলেন উনি। একাধিক ভাষায় মাস্টার্স করেছিলেন। কিন্তু তাই নিয়ে ওঁর কোনও অহঙ্কার ছিল না।

গৌরীদা সবাইকে খুব আপন করে নিতে পারতেন। একটা ঘটনার কথা বলি। হঠাৎ করে এক দিন বাড়িতে জরুরি তলব। আমি তো পড়িমড়ি করে ছুটেছি। গিয়ে জানতে পারলাম আমাকে খাওয়াবেন বলেই ডেকেছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে বউদিকে খাওয়াদাওয়ার আয়োজন করতে বললেন। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই হাজির হয়ে গেছিল গরম গরম লুচি, আলুর চচ্চড়ি আর মিষ্টি। খুব যত্ন করে খাইয়েছিলেন। তারপর ওঁর স্ত্রী গাড়ি চালিয়ে আমাদের গৌরীদার অফিসে ছেড়ে দিয়েছিলেন।

গৌরীদার সঙ্গে আমার সম্পর্ক এতটাই সহজ ছিল যে কিছু বলার আগে দু’বারও ভাবতে হত না। উনিও আমাকে খুব স্নেহ করতেন। মনে আছে পান পরাগ খাওয়ার জন্য আমার আর ঢুলু দা-র (পরিচালক অরিন্দম মুখোপাধ্যায়) কাছে প্রচণ্ড বকুনি খেতেন। পরে গৌরীদা মোটামুটি বম্বে চলে যান। প্রমোদ চক্রবর্তী, শক্তি সামন্তের সিনেমায় গান লিখতেন। ওঁর সঙ্গে কাজের সুযোগ আর সে ভাবে হত না। কিন্তু যোগাযোগটা থেকেই গেছিল। যেদিন ওঁর মৃত্যুর খবর পাই, সে দিন খুব কষ্ট হয়েছিল। বার বার ওঁর প্রাণোচ্ছ্বল, হাসি খুশি চেহারাটাই মনে পড়ছিল। এখনও আমি সেভাবেই গৌরীদাকে মনে রাখতে চাই।  

রবীন্দ্র পরবর্তী যুগে গৌরীদা আমার দেখা শ্রেষ্ঠ গীতিকার এবং এটা আমার সৌভাগ্য যে ওঁকে এত কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম আমি।‘‘

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *