‘মেয়ের সামনে একদম কাঁদবে না’…আমার শাশুড়ি প্রায়ই এই কথাটা বলতেন। আমিও ভাবতাম, সত্যিই তো মেয়ের সামনে যদি ভেঙে পড়ি, তা হলে ওর কষ্ট হবে। বাবা-মার তো দায়িত্ব সন্তানকে সব সময় একটা হাসি-খুশি পরিবেশ উপহার দেওয়া। সে সংসারে যতই জটিলতা থাকুক, সন্তানের সামনে কাঁদা বা মুখ ভার করে বসে থাকাটা অন্যায়। কারণ ওরা তো আমাদের দেখেই শেখে। বাবা-মাই তো সন্তানের কাছে প্রথম রোল মডেল, তাদের সুপারহিরো। ফলে নিজেদের আবেগ, দুঃখ, কষ্ট তাদের সামনে প্রকাশ না করে মনের মধ্যে রেখে দেওয়াই ভাল। এতে তাদেরই মঙ্গল। কিন্তু সত্যি কি তাই? এই যে নিজেদের অতি মানবের ছবিটা আমরা সন্তানের সামনে মেলে ধরি, তা কি পরোক্ষে ওদের উপর প্রত্যাশার ভার চাপিয়ে দেয় না? ওরা তো ভাবতেই পারে আবেগ দেখানো মানে দুর্বলতা প্রকাশ করা, তাই মনের মধ্যে কষ্ট চেপে রাখাটাই উচিত। কিন্তু বাচ্চাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য তো এই পরিস্থিতি কখনওই কাম্য হতে পারে না। তার চেয়ে সন্তানের সঙ্গে স্বচ্ছ সম্পর্ক তৈরি করাই শ্রেয়। মাঝে মাঝে সন্তানের সামনে কাঁদা বা দুঃখ প্রকাশ করা কোনও অপরাধ নয়। বরং এতে সন্তানের সঙ্গে সম্পর্ক আরও মজবুত হয়।

একটা ছোট ঘটনার কথা বলি। গত সপ্তাহে একটি সিনেমা দেখছিলাম। করুণ দৃশ্য দেখে অজান্তেই আমার তিন বছরের মেয়ের সামনে কেঁদে ফেললাম। সে কিন্তু একটুও ভয় পেল না, বরং উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করল। বুঝলাম, আমরা বাচ্চাদের যতটা ছোট ভাবি, ওরা তার চেয়ে অনেক বেশি পরিণত। এই ছোট্ট আচরণেই ও বুঝিয়ে দিল, যে আমার আবেগ দেখে ও ভীত বা শঙ্কিত নয়। আমাদের সম্পর্কের ভিতটা বোধহয় সে দিন আরও একটু দৃঢ় হয়েছিল।

সুতরাং কখনও ভাববেন না, যে সন্তানের সামনে কাঁদলে, তার চোখে ছোট বা দুর্বল হয়ে যাবেন। শুধু বাইরের কাঠিন্য নয়, সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো কিন্তু বাচ্চাদের বোঝা এবং শেখা উচিত। বলছি না, সব সময় নিজের সব কষ্ট তার সামনে উজাড় করে দিতে হবে। কিন্তু মাঝে মধ্য়ে সন্তানের সামনে যদি কান্না পায়, তা চেপে রাখবেন না। এতে ও অন্যদের প্রতি সহানুভূতিশীল ও সহমর্মী হতে শিখবে। তবেই তো আপনার সন্তান পরিপূর্ণ মানুষ হতে পারবে। আসুন আর একটু বিশ্লেষণ করি।

বাবা-মা সুপারহিরো নয়

দুঃখ পাওয়া বা হতাশ হওয়া যে অস্বাভাবিক নয়, তা আপনার সন্তানের জানা প্রয়োজন। না হলে ও কোনও দিনই নিজের কষ্টের কথা খোলা মনে আপনাদের বলতে পারবে না। কাঁদা যে ভীরুতা বা দুর্বলতার প্রতীক নয়, তা সন্তানকে বোঝানোর দায়িত্ব আপনাদেরই। ও যদি দেখে আপনারা মোটে নিজেদের আবেগ প্রকাশ করেন না, তা হলে ও কিন্তু আপনাদের দেখাদেখি মনের কথা মনের মধ্যে চেপে রাখতে শিখে যাবে। তার চেয়ে ও যদি আপানাদের মাঝেসাঝে কাঁদতে দেখে, তা হলে বুঝতে পারবে, যে দুঃখ পেলে কাঁদাটা একেবারেই স্বাভাবিক। আর ভেবে দেখুন তো, সন্তানের কাছের মানুষ হয়ে ওঠাটা বেশি জরুরি, না কি নিজেদের ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ ছবি প্রতিপন্ন করাটা বেশি প্রয়োজন? উত্তরটা আশা করি বলে দিতে হবে না।

সম্পর্ক সুন্দর হবে

আপনার সন্তান যখন কাঁদে, আপনি তখন ওর পাশে থাকেন। ওর যে কোনও সমস্যার মুশকিল আসান আপনি। ঠিক একই ভাবে আপনার সন্তান কিন্তু আপনার শক্তি হয়ে উঠতে পারে। সন্তানকে আড়াল করে সব সময় কান্নাকাটি করবেন না। ওকে আপনার চোখের জল দেখতে দিন, আপনাকে সান্ত্বনা দিতে দিন। দেখবেন মনের কষ্ট অনেক হালকা হয়ে গেছে। এতে সন্তানের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক আর শক্ত পোক্তই হবে। তবে সন্তানের সামনে কাঁদলেও তাকে এই আশ্বাস দেওয়াটা জরুরি যে আপনার এই কান্নাটা নেহাতই সাময়িক, ওর চিন্তা করার কোনও কারণ নেই। সন্তানকে আপনার কান্নার কারণ যতটা সম্ভব সহজ সরল ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করুন। বাচ্চা যদি আপনার কষ্টের কারণটা এবং আপনি কীভাবে নিজের দুঃখের সঙ্গে মোকাবিলা করছেন, জানতে পারে, তা হলে ও নিশ্চিন্ত হবে। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে ও যদি একই রকম কোনও পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়, ও জানবে কীভাবে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

কী করবেন না

●আগেই বলেছি বাচ্চাকে আপনার কান্নার কারণ বোঝানো জরুরি। তবে বাচ্চার বয়স এবং বোঝার শক্তি বুঝেই কথা বলবেন। এমন কোনও কারণ সন্তানকে বলবেন না, যা বোঝার ক্ষমতা ওর এখনও তৈরি হয়নি। সাংসারিক খুঁটিনাটি, ঝুট ঝামেলার কথা উল্লেখ না করাই ভাল। দাম্পত্য কলহ বা শাশুড়ির সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েন আপনার কষ্টের কারণ হতেই পারে। কিন্তু এই ধরনের কথা আপনার সন্তানকে সরাসরি বলবেন না। এতে ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত বোধ করতে পারে। সহজ ভাবে যতটা বোঝানো যায়, ততটাই বলুন।

●সন্তানের সামনে ঘন ঘন ভেঙে পড়বেন না। হতেই পারে আপনি একেবারে সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছেন, মানসিকভাবে এতটাই বিপন্ন বোধ করছেন যে নিজেকে সামলানোর ক্ষমতা আপনার নেই। এই ধরনের পরিস্থিতিতে সন্তানের সামনে থেকে সরে যাওয়াই ভাল। আপনার এ হেন ইমোশনাল ব্রেকডাউন ওর পক্ষে মেনে নেওয়া কষ্টকর হতে পারে।  




Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *