এর আগে এমন ঈদ দেখেননি সোহেল। ব্যবসার কাজে প্রায় কোনও বছরই বাড়িতে ফিরতে পারেন না ঈদের সময়। রিপন স্ট্রিটের ছোট্ট একচিলতে ঘরে বন্ধুদের সঙ্গে ভাগ করে নেন উৎসবের আনন্দ। কিন্তু ফোনে প্রতিদিন কথা হয় শ্রীনগরে থেকে কয়েক মাইল দূরের আধা শহরে ছেলের অপেক্ষায় বসে থাকা মা তাবসুম আর স্ত্রী সুফিয়ার সঙ্গে। তিন বছরের একরত্তি সন্তানের আধো আধো বুলি ভেসে আসে চলভাষে। এই বছর সব বন্ধ। গত কয়েক দিন যাবত মা, স্ত্রী, সন্তান, পড়শি- কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না কাপড়ের ব্যবসায়ী সোহেল খান। ঈদের দিন সকালে নতুন পোশাক পরেছেন ঠিকই, কিন্তু মুখের ভাঁজে লেপ্টে থাকা চাপা আতঙ্কটা কিছুতেই ঢাকতে পারছেন না বছর ত্রিশের যুবক। জানালেন, গোলমালের জন্য পরিবারে ঈদের উপহারও পাঠাতে পারেননি এই বছর। সাধারণত প্রতি মাসেই ১০ তারিখের মধ্যে স্ত্রীর অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দেন নেট ব্যাঙ্কিংয়ের মাধ্যমে। এই মাসে পারেননি। চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে সোহেল বললেন, “কীসের ঈদ! কীসের আনন্দ! আমাকে নিয়ে ভাবি না, কিন্তু বাড়ির কী অবস্থা বুঝতে পারছি না। টাকাপয়সাও নিশ্চয় ফুরিয়ে এসেছে। কী করে চালাচ্ছে কে জানে!”

নিজেকে নিয়ে ভাবতে বাধ্য হচ্ছেন এমন কাশ্মীরির সংখ্যাও অবশ্য কম নয় কলকাতায়। সন্তোষপুরের সার্ভে পার্ক এলাকার বাসিন্দা বশির আহমেদ যেমন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের পড়ুয়া বশির আরও ৩ সহপাঠীর সঙ্গে ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকেন। কেমন কাটছে ঈদ? বশিরের কথায়, “ভয়াবহ পরিস্থিতি। একদিকে বাড়ির সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই। টাকাপয়সা ফুরিয়ে আসছে। অন্যদিকে এই প্রথম এক ধরনের আতঙ্ক কাজ করেছে। আমাদের দেখেই কাশ্মীরি বলে চেনা যায়। ইদানিং মনে হচ্ছে, কেউ রাস্তাঘাটে বিরূপ মন্তব্য করবেন না তো! সবমিলিয়ে, ঈদের আনন্দ এই বছর তিলমাত্র নেই।”

বশিরের আতঙ্ক কি আদৌ অমূলক? নাগেরবাজারের তিন দশকের বাসিন্দা ইমতিয়াজ খানের মতে, একেবারেই নয়। ঈদের দিন সকালে পেশায় মোবাইল ফোনের ব্যবসায়ী ইমতিয়াজ জানালেন, গত কয়েক বছরে বেশ খানিকটা বদলে গিয়েছে তাঁর প্রিয় শহর। আগে যে ধরনের অভিজ্ঞতার কথা তাঁরা ভাবতে পারতেন না, এখন তেমনই কিছু ঘটনার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। বাজারে, রাস্তায় উড়ে আসছে নানাবিধ কটাক্ষ, আপত্তিকর মন্তব্য। তাঁর কথায়, “আমি এত বছর ধরে কলকাতায় রয়েছি। আমার ভোটার কার্ড, আধার কার্ডে কলকাতার ঠিকানা। আমার দাদা কাশ্মীরে ন্যাশনাল কনফারেন্সের সঙ্গে যুক্ত। তারপরও কেন আবার দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন উঠবে!আমাদের প্রতি সার্বিক অবিশ্বাসের এই পরিবেশে আদৌ ঈদে আনন্দ করা সম্ভব!” কথাবার্তার ফাঁকে ইমতিয়াজ নীচু গলায় মনে করিয়ে দিলেন, পুলওয়ামার ঘটনার পরে তিলোত্তমার বুকেই হেনস্থার শিকার হতে হয়েছিল এক কাশ্মীরি চিকিৎসককে। সেইন আতঙ্কের রেশ এখনও তাড়া করে তাঁদের অনেককে।

ইমতিয়াজের পরিবারের বাস শ্রীনগরেই। বাড়িতে বৃদ্ধা মা ছাড়া রয়েছেন তিন ভাই। স্কুল পাশ করার পর ইমতিয়াজ ভর্তি হয়েছিলেন তৎকালীন প্রেসিডেন্সি কলেজে। তারপর থেকে এই শহরেই আছেন। ঈদের আগে তাঁর উদ্বেগ ভাইপোদের নিয়ে। বলছিলেন, “শ্রীনগরের পরিস্থিতি বলে বোঝানো সম্ভব নয়। পাথর ছোড়া, টিয়ার গ্যাস, গুলি- সর্বক্ষণের বাস্তবতা। কোনও খবর পাচ্ছি না। ফোন করা যাচ্ছে না, ইন্টারনেট বন্ধ। ভাইপোদের উঠতি বয়স, জানি না কী করছে!”

সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের পর থেকেই বদলে গিয়েছে কাশ্মীরের পরিস্থিতি। বর্হিবিশ্ব থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন ভূস্বর্গ। নানা ধরনের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সমীকরণ যখন উদ্বেগ তৈরি করছে, তখনই একদম উল্টো পথে হেঁটে কাশ্মীরি মুসলিমদের জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঈদের দাওয়াতের আয়োজন করেছেন কাশ্মীরি পণ্ডিতদের একাংশ। রাজধানী দিল্লি-সহ একাধিক শহরে কাশ্মীরের হিন্দু-মুসলিম একসঙ্গে ভাগ করে নেবেন উৎসবের আনন্দ। কলকাতাতেও ছোট পরিসরে শুরু হয়েছে এমন উদ্যোোগ। উদ্যোক্তাদের পক্ষে জয়রাজ ভট্টাচার্য জানালেন, তাঁরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছেন কলকাতার বাসিন্দা কাশ্মীরিদের পাশে থাকতে, তাঁদের আতঙ্কে বন্ধুত্বের প্রলেপ দিতে।

অবিশ্বাস, সন্দেহ আর হিংসার আবহে কেমন আছেন শহরের কাশ্মীরি পণ্ডিতরা? ঈদের প্রাকলগ্নে কী ভাবছেন তাঁরা? পার্ক সার্কাস মোড়ের কাছে ভাড়া থাকেন রমেশ কাক। আদতে কাশ্মীর উপত্যকার বাসিন্দা রমেশরা ১৯৯৩ সালে চলে আসেন জম্মুতে। কিন্তু সেই স্মৃতি মনে রাখতে চান না তিনি। তাঁর কথায়, “ইতিহাস মনে রাখা জরুরি, কিন্তু ইতিহাসের ভার যদি প্রতিদিনের সহজ, স্বাভাবিক জীবনযাত্রার গতিরোধ করে, তাহলে কিন্তু সমস্যা আরও বাড়বে। বিভিন্ন কারণে আমাদের জম্মুতে চলে আসতে হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু আমরা তার জের টেনে চলতে চাই না। আমরা মনে করি, কাশ্মীর ভারতে অবিচ্ছেদ্য অংশ, সেখানে শান্তি ফিরুক। আমি চাই না আমার কোনও প্রতিবেশিকে সেনা অথবা সন্ত্রাসবাদীদের বন্দুকের সামনে দাঁড়াতে হোক।”

রমেশ জানালেন, প্রতিবছরই ঈদের দিনে নেমন্তন্ন পান তিনি। এই বছরও ব্যবসার কাজ সামলে ডিনার করতে যাবেন এক বন্ধুর বাড়িতে। ঘটনাচক্রে বন্ধুটি কাশ্মীরি মুসলিম। রমেশের কথায়, “আমরাও ওঁদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ডাকি, ওঁরাও আসেন। এর মধ্যে কোনও সচেতন প্রয়াস কিন্তু নেই।”

বেড়া কি তাহলে একেবারেই নেই শহরের কাশ্মীরিদের মধ্যে? ঈদের আগে শহর চষতে গিয়ে অবশ্য সেই বেড়ার দেখাও মিলল। লেক গার্ডেন্সের বাসিন্দা সত্তরোর্ধ্ব সুষমা শর্মায় গলায় এখনও ঝাঁজ! বললেন, “আমি ৩৭০ অনুচ্ছেদ তুলে দেওয়া সমর্থন করি। আমাদের তিন পুরুষের বাস ছিল কাশ্মীরে। একবস্ত্রে চলে আসতে হয়েছিল দিল্লিতে। সম্প্রীতির কথা বলা ভাল, কিন্তু তার জন্য সবকিছু ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়।” সুষমার মেয়ে প্রীতি বাইপাস সংলগ্ন নামজাদা বেসরকারি কলেজে ম্যানেজমেন্ট পড়ান। তিনি কিন্তু মায়ের সঙ্গে একমত নন। তাঁর কথায়, “আমাদের প্রজন্মে ওই বিষয়গুলির খুব গুরুত্ব নেই। আমরা চাই জম্মু ও কাশ্মীর দুই জায়গাতেই শান্তি প্রতিষ্ঠা হোক। উন্নয়ন হোক। তাহলেই সমস্যার সমাধান সম্ভব।”

সত্যিই সম্ভব! মানতে নারাজ যাদবপুরের ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির তৃতীয় বর্ষের কাশ্মীরি ছাত্র। কথা বলতে রাজি হয়েও শর্ত দিলেন, নাম লেখা যাবে না তাঁর। ঈদের দুপুরে এইটবি মোড়ের রেস্তোরায় লাঞ্চ করার ফাঁকে সদ্য যুবকের চোখে অন্য আগুন। “আমরা আজাদি চাই, দাদা। স্বাধীনতা চাই। না ভারত, না পাকিস্তান, আমরা চাই আজাদ কাশ্মীর। সেই কারণেই মানুষ গুলির মুখে বুক পেতে দিচ্ছে।” কিন্তু তাতে কি খিদে মিটবে উপত্যকার মানুষের, নাকি অস্ত্রের জবাবে আরও অস্ত্রের ঝনঝনানিতে কবর খোঁড়া হবে মনুষ্যত্ব, মানবিকতা, গণতন্ত্রের? কুড়ি বছরের তরুণ উত্তর দিলেন না। ঈদের দুপুরে তাঁর হাত থেমে রইল বিরিয়ানির প্লেটে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *