‘একটা মিনিটের জন্য নেটওয়ার্কটা চালু করে দিন না, আমি কেবল এক বার আম্মিকে ফোন করে বলে দেব যে, আমি ঠিক আছি, আমি আছি। না হলে আমার আম্মি সত্যিই হয়তো মরে যাবে। গত সাত দিনে কোনও কথা হয়নি আম্মির সঙ্গে। জানেন, গত পাঁচ দিন ধরে কাগজ বেরোয়নি, সমানে কারফিউ চলছে আর দিল্লির টেলিভিশনে বলছে যে কাশ্মীরে নাকি সব কিছু প্রায় স্বাভাবিক। আমি বিশ্বাস করি না দিল্লির টেলিভিশন চ্যানেলদের।‘ এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলছিলেন উত্তর বারামুলার এক যুবক, সাজ্জাদ। হোটেলে কাজ করেন। ছটফটিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু নিরুপায়। তাঁর অভিযোগ হয়তো সত্যি, হয়তো বা নয়, কিন্তু তাঁর আকুতি সত্যি, তাঁর অসহায়তা সত্যি। তাঁর ভয় সত্যি।

খবরটা পড়ে ছ্যাঁৎ করে উঠল বুকটা। কাবুলিওয়ালার লাইনটা মনে পড়ে যাওয়ায় সাজ্জাদ্দের মায়ের যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাওয়া মুখটা বেশ স্পষ্ট দেখতে পেলাম। সে-ও মা, আমিও মা। সাজ্জাদের মা ছেলেকে পাঠিয়েছে দূরান্তে চাকরি করতে। বিচ্ছিন্ন বা খুব অচেনা ছবি নয়তো। আমাদের সব বাচ্চাই তো এখন আঠারোয় পা দিতে না দিতে আঁচলের তাত পেরিয়ে পাড়ি দিচ্ছে দূরান্তে। আমারটিও যখন বড় হবে তখন সে-ও নিশ্চয়ই পারি দেবে। মন ধুকপুকিয়ে ওঠে, হৃৎপিণ্ডে দ্রুত চলাচল করে তীব্র অনিশ্চয়তা। পৃথিবী জুড়ে এখন অনিশ্চয়তা আর একক স্বরের এমন ট্রেন্ড চলছে যে, মনে কেবল একটাই প্রশ্ন সমানে ঘা দিয়ে চলেছে, যেখানেই সে যাবে, সেটা নিরাপদ হবে তো? বাছা আমার হিংসা, বিদ্বেষ, অন্যায়ের শিকার হবে না তো? সে দেশ, সে জায়গা, সে অঞ্চল সন্তানের জন্য আমার উদ্বেগকে ধারণ করতে পারবে তো, আড়াল করতে পারবে? আশ্রয় দিতে পারবে? ভরসা হয় না, কোনও ভরসা হয় না।

হয় না, কারণ, এখন তো সব জায়গায় কেবল কেটে, ছিঁড়ে, মনোমত মসৃণ, বোনলেস পিস তৈরি করার উদ্যোগ। যা কম আঁচেই বেশ সেদ্ধ হয়ে যাবে, যার নিজস্ব কোনও কাঁটা বা হাড় থাকবে না, যা ন্যূনতম বাধা দিতে পারে। অল্প চাপেই মিলিয়ে যাবে। কিংবা অস্তিত্বহীন লেই-এ পরিণত হবে। যা একেবারে এক রকম দেখতে, এক রকম চরিত্র, এক রকম স্থায়িত্ব আর এক রকম বশ্যতা।

সেই রকম একটা অদ্ভুত, আতঙ্ক ঘেরা পৃথিবীতে বড় হচ্ছে আমাদের সন্তানরা। আর সেই সঙ্গে একটা প্রশ্ন দিনে দিনে তীব্র হয়ে উঠছে, কী শেখাব আমার সন্তানকে, কোন আদর্শে বড় করব? বলব যে, যা হচ্ছে হতে দাও, তুমি এ সব নিয়ে ভেবো না, ভাবার জন্য অন্য সবাই আছে। তুমি তোমার কেরিয়ার, তোমার আখেরের দিকে মন দাও। না কি বলব, যে মতাদর্শে মত দিলে তুমি মূলস্রোতে থাকতে পারবে, সেটাকেই বেছে নাও। বেকার ঝঞ্ঝাট করো না, তাতে তোমার প্রাত্যহিকতা বিঘ্নিত হবে। না কি বলব, বোনলেস পিস হোয়ো না বাবা, কাঁটা আর হাড়গুলো নিজের মধ্যে সামলে রেখো। ওই কাঁটা আর হাড়গুলোই তোমার সম্বল, তোমার আদর্শ, তোমার মানবিতাকে ধরে রাখবে। তুমি সংবেদনশীল থেকো, তা-ই আসল মানুষের ধর্ম।

প্রসঙ্গত মনে পড়ল নাৎসি জমানার একটি গল্প। নাৎসিরা ইহুদিদের উপর যে অত্যাচার করেছিল, সে তো সবার জানা। কিন্তু তারা নিজেদের লোকজনের ওপর, কমবয়সী ছেলেদের ওপর যে মানসিক, শারীরিক অত্যাচার করেছিল, তা আমরা অনেকেই জানি না। বয়স তেরো-চোদ্দো হলেই তখন জামার্ন ছেলেদের নাৎসি ক্যাম্পে প্রকৃষ্ট উপায়ে অত্যাচার করার পাঠ নিয়ে হত। নিতেই হত। তার পর তাদের নাৎসি বাহিনীতে নিয়োগ করা হত। এক বার একটি ছেলে এক জন মরণাপন্ন ইহুদিকে পর পর ঘুষি মারতে অস্বীকার করেছিল। তার বন্ধুরা সেই মরতে বসা ইহুদিকে পরের পর ঘুষি মেরে তাদের দায়িত্ব পালন করেছিল। কিন্তু একটি জার্মান ছেলে বেঁকে বসে। সে বলে, আমি এক জন মরণাপন্ন মানুষকে আবার মারতে পারব না। এমনিতেই তো সে মরে যাবে, আর যন্ত্রণা দিয়ে কী লাভ!  এ কথা ওপরওয়ালাদের কানে যায়। এবং অত্যাচার না করার শাস্তি হিসেবে, সেই ছেলেটির ওপর নাৎসি বড়কর্তারা যে অত্যাচার করে, তা-ও অবর্ণনীয়। তার বন্ধুরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছিল, আদেশ অমান্য করার ফল। বন্ধুর জন্য বুক ফেটে গেলেও, মুখ ফোটেনি। সে ছেলের কী হয়, তা আর জানা যায়নি। কিন্তু সে ছেলে অল্প হলেও মানবিকতা দেখিয়েছিল, এই ছিল তার গুরুতর অপরাধ। এই গল্প আমাদের খুব অচেনা হওয়ার কথা নয়, তাই না?

তাই ভয় হয় প্রকৃত মানবিকতা, সংবেদনশীলতা, যুক্তির পাঠ পড়াতে। তাকে যদি বলি, মানবিকতাই তোমার ধর্ম, সে তোমাকে মানতেই হবে, সেই ধর্ম পালন করতে গিয়ে তার জীবন ছিন্নভিন্ন হলে কাকে দায়ী করব তখন?  কারণ তার জীবন তো সে বাঁচবে, আমি তো বেঁচে দেব না। সে যদি সমাজ থেকে বাদ পড়ে যায় তার ‘অন্যস্বর’-এর জন্য? সে যদি আর পাঁচ জনের মতো নয় বলে রোষে পড়ে যায় মূলস্রোতের, সে যদি টার্গেট হয়ে ওঠে বোনলেসদের, সে যদি মানবিকতা বজায় রাখতে গিয়ে বেদম পেটানি খায়, কিংবা তাকে যদি ‘মানবিকতার’ দোষে দোষী সাব্যস্ত হয়? আমি পারব তো সইতে? আমাকেও ফোনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না তো? আমি সন্তানের অসহায়তা দেখেও বলতে পারব তো, যা করেছ ঠিক করেছ, কখনও সহানুভূতিশীল মনোবৃত্তি থেকে সরে এসো না, কখনও সমষ্টির মতো বা সমষ্টির অন্যায় দিয়ে ব্যক্তিকে বিচার করো না।

এই সব মানতে গিয়ে সন্তান যদি তার ব্যক্তিগত জীবনে টালমাটালের মুখে পড়ে আর প্রশ্ন করে, আমায় এ সব শিক্ষায় শিক্ষিত করার মানে কী? আমারও তো নিজের ওপর অধিকার আছে, আমি অন্যের কথা ভাবতে গিয়ে, যুক্তি দিয়ে বিচার করে, সংবেদনশীল হতে গিয়ে, নিজের জীবনের শান্তি খোয়ালাম, তখন আমি কী জবাব দেব? কী বলব? যত কষ্টই হোক, মানবিকতার পন্থা থেকে সরে আসা চলবে না? আমি তার পাশে লৌহমানবী হয়ে দাঁড়াতে পারব তো?

শঙ্কা হয়, এ সব করার মতো, স্ব-বিরোধ, তর্ক, যুক্তি-প্রতিযুক্তির সেই জায়গা, সেই পরিসর আদৌ থাকবে তো? পরিস্থিতি এমন হয়ে উঠবে না তো, যেখানে আমার শিক্ষাই রাষ্ট্র আইন করে বন্ধ করে দেবে? তখন ভেতরে যা-ই থাক না কেন, বাইকে রাষ্ট্রকেই মানতে হবে। তা হলে, প্রাণসংশয়।

কিন্তু এ সব হতে হতে, শুনেছি, প্রতিবাদ হয়, প্রতিরোধ গড়ে ওঠে, এমনকি বিপ্লবও হয়। সে বিপ্লবের জন্য আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম একটা ঠিকঠাক আধার হয়ে উঠতে পারবে তো? সব জাতি বিপ্লব ধারণ করতে পারে না। প্রায় সব একনায়ক চূড়ান্ত ক্ষমতার দিকে বেশি লোক জোগাড় করতে পারে।    

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায় হাসিখুশি, এমনকী যখন সেই মোড-এ থাকেন না, নিজেকে ঠেলে হিঁচড়ে হিহিহোহো’তেই ল্যান্ড করানোর চেষ্টা করেন। জাপটে ভালবাসেন আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সিরিয়াল, গান, রাস্তায় নেড়িবাচ্চার লটরপটর কান। পড়াশোনার সময় ফিল্ড করেছেন, হাতুড়ি দিয়ে পাথর ভেঙেছেন, গ্রামবাসীদের তাড়া খেয়েছেন, এক বার পাহাড় থেকে অনেকটা হড়কে পড়ে মুচ্ছো গেছিলেন, উঠে দেখেন, কবর! এক বার ম্যানেজমেন্ট কোর্সের অঙ্গ হিসেবে চিন গেছিলেন, রাত্তির দুটোয় সাংহাইয়ের রাস্তায় হারিয়ে গিয়েও কাঁদেননি। ফিউজ সারাতে পারেন, পাখার কার্বন বদলাতে পারেন, কাগজের চোঙ পাকিয়ে গাড়িতে পেট্রল ঢালতে পারেন, চিনেবাদাম ছুড়ে দিয়ে মুখে নিপুণ লুফতে পারেন। ব্যাডমিন্টন খেলার ইচ্ছে খুব, কিন্তু জায়গা ও র‌্যাকেট নেই। অরোরা বোরিয়ালিস যারা দেখেছে, তাদের একাগ্র ভাবে হিংসে করেন। দেশের বাড়িটা উনি বড় হওয়ার পর ছোট হয়ে গেছে বলে, আর আমির খান এক বার কার্টুন এঁকে দিয়েছিলেন— সে কাগজ হারিয়ে গেছে বলে, জেনুইন কষ্ট পান। এক বার ঈগলের রাজকীয় উড়ান আগাগোড়া খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *