২০১২ সালের দক্ষিণ দিল্লির মুনিরকা এলাকায় ঘটা এক ধর্ষণকাণ্ড, সারা ভারতকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। দেশ
জুড়ে শুরু হওয়া ধিক্কার আন্দোলনের জেরে, ধর্ষণের মতো অপরাধে শাস্তির পরিমাণ বাড়ানো থেকে শুরু
করে মৃত্য়ুদণ্ডের সংস্থান সত্ত্বেও, উত্তরপ্রদেশের উন্নাও ধর্ষণকাণ্ড আবারও প্রমাণ
করল, অপরাধীদের কাছে শাস্তির ভয় এখনও তেমন জোরালো হয়ে উঠতে পারেনি, বিশেষ করে তারা যদি
ক্ষমতাশালী হন।


২০১৭ সালের জুন মাসে, উত্তরপ্রদেশের উন্নাওতে বিজেপি বিধায়ক কুলদীপ সিং সেঙ্গার ও তার দলবল
এক নাবালিকাকে ধর্ষণ করে বলে অভিযোগ ওঠে। প্রথমেই পুলিশ, বিধায়কের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিতে
অস্বীকার করেন এবং পর দিনই বিধায়কের সহচররা নির্যাতিতার বাবাকে প্রচণ্ড মারধোর করেন। পুলিশ
এই ঘটনায় দোষীদের পরিবর্তে, মেয়েটির বাবাকেই গ্রেফতার করে। নির্যাতিতা রাজ্যের মুখ্য়মন্ত্রী যোগী
আদিত্যনাথের বাড়ির সামনে আত্মহত্য়ার চেষ্টা করলে চার দিকে শোরগোল পড়ে যায়। নির্যাতিতার
পরিবার এফআইআর দায়ের করতে না পেরে, আদালতের দ্বারস্থ হয়। তখন পুলিশ মুখরক্ষার খাতিরে চার
জনকে গ্রেপ্তার করেন।

২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে উন্নাও কাণ্ডের তদন্তভার যায় সিবিআই-এর হাতে। ১১ই জুলাই প্রথম
চার্জশিটে বিজেপি বিধায়কের নাম যুক্ত হয়। ধর্ষণের মতো অপরাধে, মূল অভিযুক্তের নাম আসতেই বছর
ঘুরে যায়। ১৩ই জুলাই এই কেসের দ্বিতীয় চার্জশিটে বিধায়ক, তাঁর ভাই, দুই পুলিশকর্মী এবং আর পাঁচ
জনের বিরুদ্ধে এই ধর্ষণকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়।
২০১৮-র অগস্ট মাসেই এই মামলার মূল সাক্ষীর রহস্য়জনক মৃত্য়ু হয় এবং নির্যাতিতার কাকার বিরুদ্ধে
রেল-ডাকাতি, খুনের চেষ্টার মতো বেশ কিছু অভিযোগ দায়ের করে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। নির্যাতিতার
জন্ম-তারিখে গন্ডগোল থাকা নিয়েও নির্যাতিতা, তাঁর মা ও কাকার বিরুদ্ধে এফআরআই দায়ের করা হয়।

এখানেই শেষ নয়, ২৮ জুলাই, ২০১৯-এ, যখন নির্যাতিতা তাঁর কাকিমা, বোন ও আইনজীবীর সঙ্গে
রায়বেরিলিতে কাকার সঙ্গে জেলে দেখা করতে যাচ্ছিলেন, সেই সময় একটি ট্রাক তাঁদের গাড়িকে ধাক্কা
দেয়। ঘটনাস্থলে কাকিমা ও তাঁর বোনের মৃত্য়ু হয়। নির্যাতিতা এবং তাঁর আইনজীবী এখনও হাসপাতালে
চিকিৎসাধীন।

২৯ জুলাই থেকে আপাতদৃষ্টিতে ঘটা “দুর্ঘটনা” নিয়ে দেশজুড়ে হইচই শুরু হলে, শীর্ষ আদালত নড়েচড়ে বসে।
স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সুপ্রিম কোর্ট মামলাটি গ্রহণ করার পর জানা যায়,নির্যাতিতার মা ও কাকা বার বার
চিঠি দিয়ে তাঁদের প্রাণনাশের আশঙ্কার কথা মহামান্য় বিচারপতিকে জানানোর চেষ্টা করলেও তা সুপ্রিম
কোর্টের রেজিস্ট্রারের কাছে গিয়েই আটকে যায়। প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ এই ঘটনায় অত্য়ন্ত
ক্ষুব্ধ হন এবং তাঁর নেতৃত্বে, বিচারপতি দীপক গুপ্ত ও বিচারপতি অনিরুদ্ধ বসুর বেঞ্চ ১লা অগস্ট
একের পর এক নির্দেশে জানাতে থাকেন– এই মামলায় প্রশাসন এবং তদন্তকারী সংস্থার কতটা গাফিলতি
রয়েছে | শীর্ষ আদালতের এ দিনের একগুছ নির্দেশের মধ্যে প্রথমটিই ছিল‚ এই ধর্ষণ কান্ডের পাঁচটি
মামলাই উত্তর প্রদশের থেকে সরিয়ে দিল্লির তিসহাজারি(পশ্চিম) জেলা বিচারক ধর্মেশ শর্মার আদালতে
নিয়ে আসতে হবে | দ্বিতীয়ত‚ গত রবিবার‚ কথিত দুর্ঘটনার তদন্ত সি বি আইকে সাত দিনের মধ্যে শেষ
করতে হবে | একমাত্র জরুরি পরিস্থিতিতে তারা এর সময়সীমা বৃদ্ধির আবেদন জানাতে পারবে | তৃতীয়ত‚
পাঁচটি মামলারই প্রতি দিন শুনানি হবে‚ এক-দেড় মাসের মধ্যে এর ফয়সালা হবে | চতুর্থত ‚ চব্বিশ ঘন্টার
মধ্যে নির্যাতিতাকে পঁচিশ লক্ষ টাকা আপৎকালীন ক্ষতিপূরণ দিতে হবে| পঞ্চমত‚ নিগৃহীতাকে‚ তাঁর
পরিবার ও আইনজীবীকে সুরক্ষা দেবে সি আর পি এফ | কম্যান্ড্যান্ট পর্যায়ের এক জন তাঁর রিপোর্ট
আদালতে জমা দেবেন | ষষ্ঠত ‚ নির্যাতিতার পরিবারকে যারা এত দিন ধরে শাসিয়ে আসছে তাদের বিরুদ্ধে
পুলিসি ব্যাবস্থা নিতে হবে | নির্যাতিতার পরিবারের চিঠি এত দেরিতে কেন প্রবীন বিচারপতির হাতে
পৌঁছালো সে ব্যাপারে শীর্ষ আদালতের রেজিস্ট্রারের কাছে রিপোর্ট তলব করা হয়েছে |

শীর্ষ আদালতের নির্দেশগুচ্ছের দিকে তাকিয়ে দেশবাসী আরও একবার বিচার ব্যাবস্থার ওপর আস্থা
রাখার কথা ভাবছেন | আবার একই সঙ্গে এই ন্যায়বিচারের বিলম্বের কারণে নির্যাতিতার পরিবারের
এতগুলি সদস্যের প্রাণ চলে যাওয়া আরোও এক বার প্রমাণ করল আইনের দীর্ঘসূত্রিতার ফাঁক গলে
ক্ষমতাবানদের অপরাধীর সাজা থেকে পালিয়ে বাঁচার রাস্তা এ দেশে এখনো খোলা রয়েছে |

বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কেন্দ্রে ক্ষমতায় ফিরে আসা বিজেপি এখন প্রবল অস্বস্তিতে | কুলদীপ
সিং সেঙ্গারকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে , অথচ তা লিখিতভাবে কোথাও জানানো হয়নি | আগেই
নাকি তাঁর সদস্যপদ খারিজ হয়েছিল, তবে ঠিক কবে‚ সেটা উত্তর প্রদেশের বিজেপি সভাপতি স্বতন্ত্র
দেব সিং জানেন না | এত ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরও শাসক দলের তরফে কোনও নেতা মন্ত্রীর মন্তব্য
জানা যায় না | শীর্ষ নেতৃত্বেরও মুখে কুলুপ | ক্ষমতাশীলরা এই নারকীয় অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে‚
সর্বোচ্চ শাস্তি পায় কী না, সেটা দেখার অপেক্ষাতেই রয়েছে আসমুদ্রহিমাচল।

banglalive logo

মৌলিক‚ ভিন্নধর্মী ও সময়োপযোগী - এমনই নানা স্বাদের নিবন্ধ পরিবেশনের চেষ্টায় আমরা। প্রতিবেদন বিষয়ে আপনাদের মতামত জানান 'কমেন্ট' বক্সে | নিয়মিত আপডেট পেতে ফলো করুন - https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *