আগের পর্বের লিংক: [] [] [] [] [] [] [] [] [] [১০]
[১১] [১২] [১৩] [১৪] [১৫] [১৬] [১৭] [১৮] [১৯] [২০] [২১] [২২] [২৩]

খুলনার এক মুখ আমার বাবার ছেড়ে যাওয়া বাড়ি। শহরে আসতে আসতে দিনের আলোয় সেটির যতটুকু-যা দেখেছি তা মিলিয়ে নিতে গিয়ে মনের চোখে ভাসছে শুধু আমার পিত্রালয়। সন্ধের অন্ধকারে দেখা। চোখের জলে চিকচিক করা। 

এর পরের দৃশ্যটা আরও অন্ধকারে নদীর জলে ভাসা। খুলনার রূপসা নদী। দেখার প্রথম মুহূর্তটাই রোমাঞ্চের অতীত রোমাঞ্চকর। বন্দরের আলো বলতে সামান্য কটা আলো, তাতে ওদিককার নদীটা আরওই অন্ধকার। আমরা গাড়ি থেকে নেমে পোর্টের ভেতরে পা টিপে টিপে ঢুকতেই হঠাৎ করে লাফিয়ে উঠল ওই দৃশ্য। ক’দিন আগেই খবরের কাগজের পাতায় ভাসছিল যে-ছবি। খুলনা বন্দরে হেলে পড়ে ডুবছে এক পাক যুদ্ধজাহাজ। যাকে বলে ফ্রিগেট। ভারতীয় বিমানবাহিনীর এক সফল হানাদারির সাক্ষ্য। একটা মস্ত ডুবন্ত ফ্রিগেট যে কী রোমহর্ষক দৃশ্য তা চাক্ষুষ না করলে অনুভব করা সম্ভব ছিল না। আমরা সবাই হাঁ হয়ে কতক্ষণ যে সে দৃশ্য গিললাম মনে নেই। ঘোর ভাঙল যখন বন্দরেরই এক কর্তা এসে মনে করালেন রূপসা নদী দেখার জন্য আরও একটা প্ল্যাটফর্ম আছে। 

প্ল্যাটফর্ম বলতে আরেকটা গেট এবং আরও কয়েক ধাপ। ঘুরে গিয়ে সেই সিঁড়ি দিয়ে নামতেই চোখে এল অন্ধকারে এক বিস্তীর্ণ নদী যেখানে বাবা, কাকারা কতকাল আগে এসে মাছ কিনেছেন। ওঁদের মুখে রূপসা বলতে শুধু একটা নদী নয়, পরিবারেরই চঞ্চলা, উদ্দাম মেয়েই যেন। অন্ধকারেই চেয়ে রইলাম অনেকক্ষণ। এক সময় জল তুলে কপালে ছোঁয়ালাম। আর তখনই ঘোর ভাঙল ধীরেনবাবুর হাঁকে, “কী গো, ইলিশ কিনবে না?”

ঘুরে দেখি বন্দরের একধারে ছড়িয়ে বসে আছে মাছের বাজার। সঠিক বললে ইলিশের বাজার। তাই তো! পূর্ববঙ্গে এসে ইলিশ না নিয়ে ফেরে কেউ? সিঁড়ি দিয়ে উঠে বাজারে দাঁড়াতে শুনি বরুণ বলছেন, “এই সাইজের ইলিশ শেষ কবে দেখেছি মনে নেই।” ধীরেনবাবু বললেন, “এ তো ইলিশ নয়, বালিশ।” ইয়াব্বড় বড় ইলিশ দেখে ভাবছি এসব কাটাব কী করে। তা মুখ ফুটে বলার আগেই মাছওয়ালা বলা শুরু করেছে, “বাবুরা, গোটা গোটা নেন, কাটাকাটির মধ্যে যেয়েন না। ইন্ডিয়া যাইবেন তো? হাতে ঝুলায়ে নেন, শুধু তো খাওনের নয়, দ্যাখনের জিনিস। এই নেন।” বলে গোটা গোটা মাছ ছুড়তে লাগল আমাদের হাত তাক করে। আমার হাতে পড়ল দুটো পাঁচ পাঁচ সেরের ইলিশ। যেন জল থেকে লাফিয়ে হাতে। দাম কত? না, পাঁচ পাঁচ দশ ইন্ডিয়ান টাকা!

সবাই একটা একটা করে নিল, আমি দু-দু’টো। একে ইলিশ, তাও বাবার দেশ খুলনার নদী রূপসার পাড় থেকে। জিপভর্তি মাছ নিয়ে রাতের অন্ধকারে নির্জন হাইওয়ে ধরে হু হু করে ফিরছি যখন কলকাতা সারাদিনের ক্লান্তি কোথায় উবে গেছে সবার। কারও চোখে ঘুম নেই, গলা ছেড়ে কথা বলে যাচ্ছে সবাই। ভোর হয়-হয়, তখনই একটু ঢুলুনি এল ধীরেনবাবুর। ড্রাইভারের পাশে বসে ঘুমনো ঠিক না বলে উনি চলে এলেন পিছনের সিটে আর আমি গিয়ে বসলাম ওঁর জায়গায়। আর কিছুক্ষণ পর শুনি আমাদের দলের ফটোগ্রাফার চাপা স্বরে গুনগুন করে যাচ্ছে, ‘নিঝুম সন্ধ্যায় পান্থ পাখিরা বুঝি বা পথ ভুলে যায়’! বরুণ আর না বলে পারলেন না, ‘এই ভোরের মুখে তুমি নিঝুম সন্ধ্যা কোথায় পেলে গো?’ যুবক গান থামিয়ে দিব্যি বলে দিল তখন, ‘স্যার, ভোর আর সন্ধে একেক সময় একই রকম হয়ে যায় যে।’

Hilsa Fish
আমার হাতে পড়ল দুটো পাঁচ পাঁচ সেরের ইলিশ

সকাল সকাল বাড়ি ফেরার সেই অভিজ্ঞতা আজও ভুলিনি। সাদা টুইডের কোট পরে নামলাম দু’হাতে দুটো পেল্লায় ইলিশ নিয়ে। মা আর দিদি তো স্তম্ভিত। দিদি জিজ্ঞেস করল, ‘তুই সুট পরে বাজার করলি?’ বললাম, ‘যে সে বাজার নয়। খুলনার পোর্টে বসে ইলিশ বাজার।’ শান্তশিষ্ট মা’র ছোট্ট প্রশ্ন, ‘খুলনা কেমন দেখলে?’ বললাম, ‘অপূর্ব!’

ইলিশ রান্নার কী বাহার সেদিন! জনে জনে ডেকে ইলিশ দিলেন মা। আর যা রান্না হল শুধু সেই ইলিশের তিন পদ দিয়েই সাপটে খাওয়া ধরল সবাই। ডাল, তরকারি পড়ে রইল, চালু রইল ইলিশ ফেস্টিভ্যাল। মা শুধু একবার বলল, ‘পদ্মার মতো রূপসার ইলিশও বড় সুন্দর খেতে।’

বাহান্ন বছর পর আজ একটা কথা কবুল করতে বাধা নেই। ওই খুলনা সফরই কেমন একটা দুর্বলতা তৈরি করে দিল সাংবাদিকতার প্রতি। ওই শহর, ওই নদী আর ওই বন্দর ঝুলে রইল মনের পর্দায়। বেশ একটা আবেগ তৈরি হল ফের পূর্ববঙ্গে যাবার। বাংলাদেশ নামকরণ আনুষ্ঠানিকভাবে তখনও হয়নি। ইংরেজি রিপোর্টে সারাক্ষণ লিখছি ‘erstwhile East Pakistan’। পূর্বতন পূর্ব পাকিস্তান। এই পূর্বতন পূর্ব পাকিস্তানকে যেদিন বাংলাদেশ বলে লিখতে পারলাম সে এক অপূর্ব অনুভূতি! ভারতীয় হয়েও যেন কোথাও একটা দেশ খুঁজে পাওয়ার আবেগ। রবি ঠাকুর ঠিকই লিখেছিলেন, দেশে দেশে যত ঘর আছে মোর, আমি সেই ঘর নিব খুঁজিয়া।

1971 Instrument of Surrender
১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে জয়ের পর ভারত পাক জেনারেল চুক্তি

পাকিস্তানিরা পরাস্ত হয়ে হঠে গেল ঠিকই, কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রাহমান তখনও পাকিস্তানের জেলে বন্দি। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পরপরই পাকবাহিনী পূর্ববঙ্গ জুড়ে সেই যে খুনখরাবি, তোলপাড় শুরু করেছিল তখনই শেখ সাহেবকে বন্দি করে পশ্চিম পাকিস্তানে সরিয়ে নিয়ে যায় দেশদ্রোহিতার মামলায় ফাঁসিয়ে। বাংলাদেশীরা গোটা যুদ্ধই লড়েছে মুজিব সাহেবকে প্রস্তাবিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি পদে বৃত করে, যদিচ অনুপস্থিত। অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে বাংলার জয়ের পর শেখ সাহেবকে মুক্তি দিল পাকিস্তান এবং তিনি লন্ডন হয়ে ঢাকায় এসে পৌঁছলেন ১০ জানুয়ারি, ১৯৭২-এ। পাক বন্দিশালা থেকে লন্ডন হয়ে তাঁর ঢাকা এসে পৌঁছনো একটা রোমাঞ্চকর ঘটনাক্রম। মুজিবকে পাকরা কোথায় সরাচ্ছেন, কোত্থেকে কোথায়, সত্যিই কি তাঁকে মুক্ত করা হচ্ছে, করলে কখন কীভাবে? এহেন শতেক প্রশ্নে সারাদিন সে কী উত্তেজনা! রয়টার্স, এএফপি, এপি, পিটিআই, ইউএনআই পাল্লা দিয়ে বার্তা দিয়ে যাচ্ছে, টেলিপ্রিন্টার উপচে পড়ছে। 

গোবরডাঙা শরণার্থী শিবির রিপোর্ট করে, পরে সদ্যমুক্ত বাংলাদেশ ঘুরে এসে একটা বাংলা কানেকশনই বুঝি তৈরি হয়ে গিয়েছিল আমার। তাই মুজিবভাইয়ের মুক্তির পর্ব অভীকবাবু এসে আমার ওপরই ন্যস্ত করলেন। ডেপুটি নিউজ এডিটরও খেয়াল রাখলেন যাতে মুজিবর সংক্রান্ত সমস্ত creed যেন আমার কাছেই জমা পড়ে। অভীক সরকার মশাই এও বলে দিলেন স্টোরিটার একটা জমিয়ে ভূমিকাও লিখে দিতে হবে। সারা সন্ধে বসে সেটাই করলাম, কোন শহর থেকে মুজিবভাই কোন শহরে গেলেন, কতক্ষণ রইলেন সেখানে, তারপর ক’টার সময় কোন প্লেনে চড়ে কোথায় এলেন। বলতে গেলে পরাধীনতা থেকে নিজের স্বাধীন দেশে ফেরার minute to minute reporting। উফ্! কী যে এক ফূর্তি ওই স্টোরি সামলে। তারপর ইন্ট্রো লিখে কপির হেডলাইন চাপানো—Twenty-four hours to freedom.

Young Sheikh Mujibur Rahman
শেখ মুজিবর রহমান- অল্পবয়সে

কপি শেষ করে সেদিন বাড়ি ফিরেছিলাম রাত বারোটায়। কিন্তু ক্লান্তির ছায়া নেই শরীরে। পরদিন অফিসে গিয়ে বসতেই ম্যানেজিং এডিটর অভীকবাবু এসে হেসে বললেন, “সুন্দর কাজ হয়েছে। তবে একটা ভুলও আছে।”

জিজ্ঞেস করলাম, “কী ভুল অভীকবাবু?”

হেসে উত্তর এল, “ওই যেখানে মুজিবরের ঢাকায় ফেরার লাইনে লিখলে gem of a news. খবরটা নিশ্চয়ই খুশি করার মতো। But that’s a personal feeling. কিন্তু জার্নালিস্টকে সারাক্ষণ থাকতে হবে neutral. ‘Gem’ শব্দটা সাংবাদিকের ব্যবহার করার নয়।”

অভীক সরকারের থেকে পাওয়া এই শিক্ষাটা আমার দীর্ঘ সাংবাদিক জীবনের এক সেরা শিক্ষা।

(চলবে) 

*পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
*ছবি সৌজন্য: Wikipedia, StarSunfolded, Fishofillet,

Sankarlal Bhattacharya Author

শংকরলাল ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট, কলকাতায়। ইংরেজি সাহিত্যে স্বর্ণপদক পাওয়া ছাত্র শংকরলাল সাংবাদিকতার পাঠ নিতে যান প্যারিসে। তৎপরে কালি-কলমের জীবনে প্রবেশ। সাংবাদিকতা করেছেন আনন্দবাজার গোষ্ঠীতে। লিখেছেন একশো ত্রিশের ওপর বই। গল্প উপন্যাস ছাড়াও রবিশংকরের আত্মজীবনী 'রাগ অনুরাগ', বিলায়েৎ খানের স্মৃতিকথা 'কোমল গান্ধার', হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিমালা 'আমার গানের স্বরলিপি'-র সহলেখক। অনুবাদ করেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা থেকে সত্যজিৎ রায়ের চিত্রনাট্য পর্যন্ত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *