দু’রকম মশলা দেখেছি। এক রান্নায়, আর দুই বাড়ি বানাবার সময় রাজমিস্ত্রির টিনের গামলায়- সিমেন্ট, বালি, সুরকি আর জলের ঠিকঠাক মিশেলে। এ দু’টো ক্ষেত্রেই, ঠিকঠাক পরিমাপে যথার্থ ব্যবহার না হলেই, ধস নামবে – হয় পেটে, না হলে বাড়ির গাঁথনিতে। ছোটবেলায় এ দু’টোই মিলে যেত, যখন ভাঙা পাঁচিলের গলতা থেকে চুন সুরকি খসিয়ে আমরা রান্নাবাটি খেলতাম। জাদুময় এই খেলাই বোধ হয় সম্পর্কের মশলা – টক, ঝাল, মিষ্টি এবং তেতো ও তিতকুটে। সবগুলোর মিশেল হলে সম্পর্কের বিচারে তা – ‘ভালোয় মন্দে’। আর তা না হলেও, যে কোনও একটা আবেশও যথেষ্ট। মন থেকে তা আর কিছুতেই মুছবে না। আবার এমনও হয়, যে মন থেকে তাড়াতেও হয় কখনও কোনও কোনও সম্পর্কের সেই তীব্র ঝাঁজ। তবে, যা কিছু পানসে তার জোর কম। স্মৃতি-বিস্মৃতির মধ্যে এক আধো ছায়া – আছে আবার নেইও। ওই ‘negligible offence’ গোছের, যাতে সম্পর্কের আঁট বন্ধন কম। ফোড়নের গন্ধই যেমন স্বাদ এবং তার চেনায়, তেমনই মশলার তীব্রতায় সম্পর্কের জাল। এর কমা বাড়া হলেও নির্মূল কিছুতেই হয় না।
আমার বাবারা তিন-বন্ধু ছিলেন, তিন রাজ্যের মানুষ – রাঁচি, বালেশ্বর আর খড়দা। পরবর্তীকালে যোগাযোগ বলতে চিঠি। কিন্তু সে বন্ধুত্ব এতই গভীর, যে আজ চার পুরুষেও অমলিন। তাঁদের তিনজনেরই বড় মেয়ে মানে, যশোধরা দিদি, খুকুদি আর আমি একবার তাল তুলে , একজোট হয়ে তিনদিন–দু’রাত্রি এক করে আড্ডা মেরেছিলাম। ওই একবারই। কিন্তু সে এক অপূর্ব আঁট হল। বন্ধুতার মন-মশলা একটা পরম্পরা গড়ে দিল। আর সবচেয়ে অবাক করে যশোদি জানতে চাইল, ‘লালু কে?’ বাংলায়, তার বাবাকে লেখা যার অনেক চিঠি সে পেয়েছে, যাতে সরাসরি প্রেম নেই, কিন্তু খুবই রোম্যান্টিক। খুকুদিও বলল, রাঁচিতে তার বাবার কাছেও লালু পিসির চিঠি আসত। ভারি ভাল লাগল, দাদার দুই বন্ধুর সঙ্গে ছোটপিসির এই মধুর সম্পর্কের কথা জেনে। দুই ছেলেমেয়ের মা, জাঁদরেল উকিলের বউ হয়েও, তিনি তাঁর কচিবেলার নরম মন দিয়ে, সমানেই আদান প্রদান চালিয়ে গিয়েছেন। আহা! এই জন্যেই আশি বছর বয়সে মৃত্যুর সময়েও তাঁর চুলে পাক ধরেনি। আর নানা দুর্বিপাক সত্ত্বেও, এ বিশ্বাসেও চিড় ধরেনি, যে জীবন বড় সুন্দর।
আমার বাবার আর এক বন্ধু ছিলেন, আমাদের কলকাতার জেঠু। আমৃত্যু আমাদের ঘিরে ছিলেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুতে ওই পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। সম্প্রতি আবিষ্কার করি, আমার ফ্ল্যাটের মুখোমুখি অন্য একটা ফ্ল্যাটেই থাকেন জেঠুর ছোট মেয়ে, বুলাদি। চার দশক পার করে দেখা হলে কী করে আর চেনা যাবে! কিন্তু সঙ্কোচ কাটিয়ে কথা বলা শুরু হতেই এখন তো রোজই আলুর ঝালুর গপ্পো। আমার মেয়ে-জামাই আর ওঁর দুই ছেলেমেয়ে হতবাক হয়ে শোনে এবং দেখে কোন দুই ‘বাবার বন্ধুত্ব’ কেমন তাদের মায়েদের সেঁটে দিয়েছে মুখোমুখি দু’টো বারান্দায়। রাত করে শুতে যাওয়া এই দিদি, তার গাওয়া একটা করে গানের অডিও আমার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে পাঠায়। আর ভোরবেলা ঘুম ভেঙে আমি উপহারে শুনি সেই গান। এক নতুনতর অভিমানে বন্ধুত্ব গড়ছি আমরাও।
ছোটবেলার এই বন্ধুত্ব প্রসঙ্গে মনে আসছে আমাদের ইশকুল বন্ধুদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের কথা। ছিয়াত্তর সালের পর, এই আবার যোগাযোগ, আর সে কি উতরোল! ষাট ছুঁই ছুঁই বয়সেও সবাই যেন সেই ষোলো বা সতেরো। সেই সময়ের কথা, গান, প্রেম, দুঃখ, আড়ি-ভাব, উন্মাদনা – সখিভাবে যেন সব উজাড় হয়ে এল। তখন অদ্ভুত মানুষজন দেখলেই আমরা মজা করে বলতাম, ‘তোর শ্বশুর’ বা ‘আমার শাশুড়ি’। এখন আমাদের সকলের ঘরেই সত্যি সত্যি বর, শ্বশুর, শাশুড়ি। ছেলেমেয়ে ছাপিয়ে আমরা তো কেউ ঠাকুমা না হয় দিদিমা। আর বাড়িগুলোও তো সব ‘বাপের বাড়ি।’ সেই সময় যা ছিল কল্পনার মজা, এখন সেগুলোই সম্পর্কের জাল। এখন তাই ওই বালিকা বয়সটাকেই মনে হয় যেন সত্যি নয়, স্বপ্নই ছিল। আজ আবার, এই যে এমনি এমনি আবার সেই কথার রাশি, কথা কাটাকাটি, দল বাঁধা, এর কোনও ব্যাখ্যা নেই। আমাদের সকলের বাড়ির লোকেরাও তো এই উচাটন দেখে অবাক! তাদের কাছে একদল বুড়ির মতিভ্রমের উদাহরণ মাত্র। কিন্তু আমাদের কাছে যে তা হিরে জহরত! কোনওদিন সবাই মিলে মনে করা- গার্লস গাইডের নানা ভাষার গানগুলো , শিমুলতলায় সেই বিরাট বাহিনীর বেড়াতে যাওয়া, কোনওদিন দিদিমণিদের গপ্পো, কোনওদিন নিছক খুনসুটি, কোনওদিন এই মারে কি সেই মারে ! তার সঙ্গে ঝরঝর করে বৃষ্টির মতো সাদা কালো ফটো, আমাদের হিলহিলে বালিকা বয়সের।
আর আমরা এ ভাবেই জড়িয়ে নিলাম ইশকুল বন্ধু গৌরী আর শকুন্তলার হঠাৎ-মৃত্যুও। এই বন্ধু-দলের আদরটুকু তারাও মেখে গেল। আর এবার এই লক-ডাউনে, পঁচিশে বৈশাখ সারাদিন ধরে দফায় দফায় অডিও আর ভিডিও পাঠিয়ে, রবীন্দ্রনাথ স্মরণ। আর যাঁদের মা-বাবারা বেঁচে আছেন, তাঁদের ঘিরে ছবি। আমাদের দেখা সেই যৌবনময় বাবা মায়েরা এখন বার্ধক্যের কিনারে। তবু তাঁদের দেখেই শান্তি। এই মনের টানের কোনও যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা হয় না। কিন্তু এই আমরা, আমাদের ভালো লাগাকে যাপন করছি শুধু মনের বন্ধনে। পরস্পরকে সময় দিয়ে কী যে খুশি লাগছে বলার নয়। আর সে কি যে-সে সময়! প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে মনের মধ্যে ঘর গড়ে বালিকা-মন সাজিয়ে রাখা।
‘আমপান’ ঝড়ের প্রচণ্ড তাণ্ডবে ছবি-সহ খবর ভেসে এলো, যে বাগবাজারে আমাদের ইশকুল চত্বর তছনছ হয়ে গিয়েছে। পাঁচিল ভেঙে , কাচ ফেটে বিধ্বস্ত এক দশা। উপড়ে গিয়েছে সমস্ত গাছ। ফেসবুকে দিতেই একাল-সেকাল নির্বিশেষে ছাত্রীরা যার যার নিজের ওয়ালে শেয়ার করে চলল। একজন বড় সুন্দর করে লিখল, ‘ওরাও তো আমাদের সহপাঠি ছিল।’ সেই গুলঞ্চ ঘেরি, সেই কৃষ্ণচূড়া আর সেই জারুল! গাছ লাগাবার অনুষ্ঠান থেকে তাদের বেড়ে ওঠার সঙ্গে তো একটা সময়েরও বেড়ে ওঠা। অথচ ওই ইশকুলে কেউ তো আর নতুন করে ফিরে যাবে না। এমনও নয় যে রোজকার জীবনে কোনও সমস্যা তৈরি হল। কিন্তু সম্পর্কের বন্ধনে ইশকুলের গাছগুলো এক নিবিড় বেদনা নিয়ে এল। কাচ লাগানো যাবে, পাঁচিলও মেরামত হবে, কিন্তু ওই ওপড়ানো গাছগুলোকে আর কোনওদিন ফিরে পাওয়া যাবে না। এই বেদনাবোধের ব্যাখ্যা নেই। ব্যাখ্যা নেই এই সম্পর্কের গূঢ় টানেরও। যার মনে বাজল, সে পেল সংযোগের এক বিরল বৈভব।

এই ইশকুল বন্ধুদের বাইরেও আরও যারা, তারাও আজ নতুনত্ব নিয়ে হাজির। একজন পরিচিত মানুষ, প্রায় আমারই সমবয়সী, ফোন করে দীর্ঘ সময় নেয় এবং দেয়। কী ভালোই না লাগে এই কথা বলাবলি! মাঝে মাঝে অনাবশ্যক বিস্তর ঝগড়াও, যেন এখনও সেই সতেরো আর উনিশ। দু’একবার ফোন না ধরে, তাকে বাদ করেই দেওয়া যায়। কিন্তু ওই যে, কোন সম্পর্কে কোথায় যে দায় আর মাধুর্য থাকে, তা সবসময় নিজেও বোঝা যায় না। ইশকুল বয়সে কোনওদিন কথাই বলিনি। পরেও যোগাযোগও ছিল না কোনও। পঞ্চাশ বছর পর যোগাযোগে তো আর ছেলেমানুষি করে এড়িয়ে যাওয়া যায় না! আবার নতুন করে যে কিছু গড়ে ওঠে, তা-ও নয়। ফলে, সম্পর্ক রাখার ইচ্ছে থাকলেও, নানা সঙ্কোচ আর বিষয়াভাবে তা আর জমে না।
তাকে বললাম, তার পাড়ার আড্ডা, কলেজের গপ্পো, আরও কিছু এটা সেটা – যেমন যা মনে আসে, ছোট ছোট অডিও করে পাঠাতে, যেখানে জড়িয়ে আছে আমাদের বড় হয়ে ওঠার সময়টা। ম্যাজিকের মতো কাজ হল। সে তার সুবিধে মতো পাঠায়, আমিও আমার সুবিধে মতো শুনে কখনও মতামত দিই, কখনও আবার আমার হেসে লুটিয়ে পড়ার পাল্টা অডিও পাঠাই। ব্যক্তিগত কথা, চেনা অচেনা বহু মানুষের স্মৃতিচারণ, স্মরণীয় সব নাটকের সংলাপ, নাটকের গান, তার মাস্টার মশাইদের নিয়ে, পাড়ার দাদাদের নিয়ে, নকশাল আন্দোলন নিয়ে একের পর এক গপ্পে – সে এক বিপুল এবং অপ্রত্যাশিত উপহার। তাকে না বললেও প্রতিদিন অপেক্ষা করে থাকি। ভাবি আজ সে উপহারে কী পাঠাবে! এরও তো কোনও ব্যাখ্যা নেই। যে কেউ শুনলেই বলবে, দু’জনেরই মাথা খারাপ। নামীদামি শিল্পীদের এত গান, এত কবিতা, এত শ্রুতি নাটক ছেড়ে, শেষে এই বাতুলের প্রলাপ! কিন্তু এই হল সম্পর্কের মজা, যা ‘গোপনে গোপনে পরাণ রাঙায়।’ বুঝলাম যে ব্যক্তিগত সম্পর্কের বাইরেও এ এমন এক সম্পর্ক, যাতে জুড়ে আছে সময়। বছরের পর বছর ধরে সময় যাপনের এক অনন্য বিলাস। নিখাদ ভালোলাগা আর মনের শুশ্রূষা ছাড়া এর না আছে পরিণতি , না আছে কোনও আদান প্রদান। তবু অন্যান্য চালু সম্পর্কগুলো ধরে রাখতে এ এক ভিন্ন পথের আয়োজন। হয়তো মুক্তি এই যে, এর কোনও পরিণতি নেই। শুধু, অসময়ে সময়কে মিলিয়ে দেওয়া মাধুর্যে।
আমার আর এক পরিচিত কবিতা-পাগল মানুষ, সেই সত্তরের দশকেই আমেরিকা চলে গিয়েছিল। এখন সে সফল বিজ্ঞানী, দামি গবেষক এবং নামী অধ্যাপক। সব থেকে দামি তার সময়। সেই সাফল্যের সঙ্গেই জুড়ে আছে তার কিছু কান্না, অবসাদ এবং সম্পর্কের আক্ষেপ – যা সবাই জানলেও, সে কাউকে বলতে পারে না। তার বিলাসী শহুরে জীবনের ফাঁকে তাই সে চলে যায় তার হ্রদ-বসতে একা একাই ছুটি কাটাতে, প্রিয় কুকুরটাকে সঙ্গী করে। এখন আর না সে বাংলা কবিতা পড়ে, না আর লেখে। তবু, আমার লেখার লিঙ্ক বা নতুন কোনও কবিতা বা কোনও আঁকা ছবি, তাকে আমি নিয়মিত পাঠাই। নামমাত্র শব্দে উত্তর আসে, কখনও বা দীর্ঘ নীরবতা। তবু পাঠাই, আমার ভাল লাগে বলে। লক-ডাউনে সেদিন দারুণ এক উপহার এল তার কাছ থেকে। আমার একটি দীর্ঘ কবিতা পাঠ করে, অডিও পাঠিয়েছে। সঙ্গের মন্তব্যে লিখেছে, ‘আর দেরি করা ঠিক হবে না বলে।’ এ জীবনে বহু যুগ পর তার নির্ধারিত ছকের বাইরে এসে, সে বোধহয় এমনি এমনি কিছু করল। জানি না একে কী বলব! আমার সঙ্গে সম্পর্ক, নাকি কবিতার সঙ্গে, নাকি সময়ের সঙ্গে, না দু’জনের স্বপ্নগুলোকে এক করে আভাসে মিলিয়ে দেখা! শুনে মুগ্ধ হয়ে লিখলাম, ‘ঈশ্বরী সময়।’ মুহূর্তে তার যুক্তিবাদী উত্তর – ‘লিখলে তুমি, পড়লাম আমি আর শিরোপা পেলেন ঈশ্বর!’
আর সেই আরও একজন! দিদির বিয়ের বাসরে আমাকে দেখে, যার সেই মুগ্ধতা! এ থেকে আর বেশি দূর এগোয়নি। কয়েক দশক পার করে, তার মেয়েকে আমার কলেজে ভর্তি করতে এসে দেখা করে গেল। আবার দেখা হল, ওই দিদিরই মেয়ের বিয়েতেই। কোথাও কিছুই নেই, তবু কী যেন গচ্ছিত আছে তার সেই দৃষ্টিতে। নামী মানুষ, তাই খবর হয় তার গতিবিধি। শুনলাম, কোন হাসপাতালে ভর্তি। বাঁচার আশা নেই। হিসেব মতো বছর দশেকের বড় আমার থেকে। একদিন আমি ঘটনাচক্রে এক আত্মীয়কে দেখতে ওই হাসপাতালেই। তার কথা আমার মনেও ছিল না। পরিচিত মুখের বিশিষ্টজনেদের ওই হাসপাতাল চত্বরে আনাগোনায় মনে পড়ল এবং এও বুঝলাম যে, সে আর নেই। ভিজিটিং আওয়ার্স শেষ হতে খোলা চত্বরে বেরিয়ে দেখি, ফুল মালায় সেজে, কাচের গাড়িতে। কী মনে হল, একটু দাঁড়িয়ে গেলাম। গাড়িটা আমার সামনে দিয়েই বেরল। নমস্কার করিনি। আশ্চর্য হয়ে ভেবেছি, কী সেই সম্পর্ক, যে শেষযাত্রায় আমি তাকে মনে মনে হাত নেড়ে টাটা করে দিলাম! বুঝতে পারলাম, যে সেই ষোলো থেকে এই বাষট্টি পর্যন্ত আমার মনের গভীরে, কেমন পুরোটাই সে জুড়ে ছিল। তার সেই শেষ যাত্রায় দাঁড়িয়ে ওই অদ্ভুত সম্পর্কের গল্পটা ওই দিন শেষ হল।
একটি সাইকিয়াট্রিক সেন্টারে নিয়মিত কাজের সূত্রে, সম্পর্কের বড় মধুর দু’টি ছবি দেখেছিলাম। প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে একদল মনোরোগীকে মূল সেন্টার থেকে সরিয়ে এদেরই একটি সাব সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এরা সকলেই আমার ‘এস্থেটিক থেরাপি’ বিভাগের শিল্পী। শুধু বন্ধুদলই নয়, শিল্পীদলও তো ভাগ হয়ে গেল। অথচ তারা কেউ কাঁদল না, ক্লাসে শেখা গানগুলো একসঙ্গে গেয়ে, গেটের কাছে দাঁড়িয়ে বিদায় জানাল। এই রকমই গান ওরা গেয়েছিল, ওদের আর এক প্রিয় আবাসিকের মৃত্যুতেও। এখান থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেলেও এখানকার সাজানো বাগান, নাচ-গানের ক্লাস, নানা অনুষ্ঠান ওরা ভুলতে পারে না। এখান থেকে ছুটি হয়ে গেলে, বলা যায় না আবার এসো। তবু যাবার সময় ওরা বলে যায়, মন কেমন করবে খুব। ওরা কি বুঝল, এই মন কেমনটাই আসলে সব সম্পর্কের শেষ কথা এবং এক চূড়ান্ত সুস্থতা!
ফেসবুক এর শর্তই তো বন্ধুত্ব – লাইক-কমেন্টের স্বাধীনতা-সমেত। হারিয়ে যাওয়া বন্ধু আর চলমান সময়কে এক সুতোয় গেঁথে, এ এক সজীব মোহময় ক্যানভাস। এখন এই লক ডাউনের ফলে তা হয়ে উঠেছে যেন এক ঘর লাগোয়া বারান্দা। কত নতুন সমস্যা, আর কত অভিনব সব সমাধান। সব মানুষের জীবনে একই দুর্বিপাক, একই রকম চরম অসহায়তা, তাই একই রকম ভাবে জড়িয়ে জাপটে থাকা। বিশেষত সোশ্যাল মিডিয়া এবং অনলাইন ম্যাগাজিন নিয়ে এল এমন এক নতুন খোঁজ, যাতে অন্তত কিছু মানুষ সাময়িক হলেও নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্তি পেল। ঘরের মানুষগুলি এবং চেনা মানুষগুলির বাইরেও তৈরি হয়ে গেল, বিশ্বজোড়া সম্পর্কের এক সফল প্রতিশ্রুতি। ‘জানা শোনা’ – এই শব্দ দুটির ব্যপ্তি এখন সীমা ছাড়াল। এ সম্পর্কের নাগাল নাই বা পেলাম, নাই বা থাকল সময় অপচয়ের কাঠগড়া। এ তো, প্রাপ্য ছাপিয়ে সম্পর্কের এক বিশাল প্রাপ্তি! এবং অবকাশ যাপনও তো, যেখানে একটু ফুলের ছবি পাঠিয়েই মন ভাল থাকে!
বয়স যখন অল্প থাকে তখন আমরা কিছুটা প্রথাগত ভাবেই সংসার সাজাই, চাকরি করি, বন্ধু পাতাই। কিন্তু বয়স না বাড়লে বোঝা যায় না, এর বাইরেও কত চাওয়া, পাওয়া আর ভালোলাগা লুকিয়ে থাকে। শাসন, গর্জন, চোখরাঙানির বাইরে এক নিবিড় নিভৃতি। কোন লোকটা বেশি পাজি বা সুবিধের নয়, এসব না ভেবে একটু অন্য ভাবেও দেখা। এতে না লাগে বাড়তি খরচ, না জোটে উৎপাত। এই কিছুদিন আগেও আড্ডা তো এ রকমই ছিল। পাড়ার ছেলেরা মিলেমিশে একসঙ্গে চাঁদা তুলত, দল বেঁধে যেত শবযাত্রায়, রাস্তার ল্যাম্পপোস্টে স্পিকার লাগিয়ে দল বেঁধে শুনত খেলার কমেন্টারি, ছাদে ঘুড়ি ওড়াত। ছেমো ছেমো আধপাগলা ‘পচা’র সঙ্গে অনায়াসে একই রকে বসে আড্ডা মারত ডাক্তারি-ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া ডাকসাইটে সব মেধাবী ছেলেরা। ইশকুল ছুটির পর আমাদের মেয়েদের জটলায় যখন তারা গভীর চাহনিতে তাকাত, সেই সঙ্গে তো ‘পচা’ও। আর আশ্চর্য এই যে, সেই ছেলের দলের সবাইকে আমাদের এখন আর মনে না থাকলেও, ‘পচা’কে কিন্তু আমরা কেউ ভুলিনি! সবাই তাকে মনে রেখেছি বলেই, আজও হাসির ছররা। আর মেয়েদের আড্ডা ছিল ক্লাসরুমে, ছাদের আলসেতে, পাড়ার পুজোয় দল বেঁধে সাজানো, আলপনা দেওয়া, ফল কাটা এসবে। গার্লস গাইড আর বয়েস স্কাউটের সূত্রে একসঙ্গে ফ্রেন্ডশিপ ক্যাম্প, ইন্টারন্যাশনাল জ্যাম্বোরি– সে সব সম্পর্কে পাওয়া বন্ধুদল তো আজও মন মাতায়। সময়ের বিচারে মেরেকেটে সাত আটটা দিন একসঙ্গে থাকা, কিন্তু তার রেশ তো আজও। আস্তে আস্তে এল কলেজ ফেস্ট, সহকর্মী, বেড়ানোর দল আর নানা গোত্রের ভিন্ন ভিন্ন বন্ধু-স্বজন। কিছু বাধ্যত, কিছু বা মনের টানে। তাই এও তো এক সম্পর্কের উত্তাল জোয়ার। যাকে রাখি, সেই থাকে। রিয়েল আর ভারচুয়াল মিলেমিশে একাকার।
শুধু মানুষ কেন, আরও কত সম্পর্কের জাল যে আমাদের জড়িয়ে রাখে! নদীর পর নদী, গাছের পর গাছ, পাখি, কাঠবিড়ালি, বেজি, পোকামাকড় কত কী! সম্পর্কের বাঁধনে কত না অনুষঙ্গ ! কখনও এক গোছা দোলনচাঁপা, কখনও যমুনার নীল আবেশ। কখনও একটা লেবুতলা, কখনও বা একটা অন্ধকার কুয়োপাড়। এই মুহূর্তে, ব্যক্তিগত ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও আমার মনে আরও এক পোঁচ এই যে বিষাদ, তার কারণ জানলা-জোড়া রাধাচূড়াটা হুড়মুড় করে উপড়ে গেল। বে-আব্রু হয়ে গেল সকালের আলো আর রাতের অন্ধকার। পাঁচিলের ওপারের বাড়িগুলো সটান সেঁটে গেল শার্সিতে। হলুদ ফুলে সবুজ পাতার সমারোহ আর মরচে রং বিজের ঝুরি– সব লোপাট হয়ে এখন যা, তা শুধুই শহর। এই শূন্যতা এড়াতে বসবার চেয়ারটা ঘুরিয়ে নিয়েছি অন্য দেওয়ালে। জানলাটায় সারাক্ষণ পর্দা টেনেই রাখি। এ কি কাউকে বলার, যে কী সম্পর্ক ছিল ওই রাধাচূড়া গাছটার সঙ্গে?
সম্পর্কের একমাত্র মশলা বোধ হয় মন। কখন যে তা মেঘের মতো ছেয়ে দেয়, আর কখনই বা বৃষ্টি হয়ে ঝরে তার হদিশ বোধহয় মনও জানে না। ভাগ্যিস!
আড্ডা আর একা থাকা,দুটোই খুব ভাল লাগে।
লিখতে লিখতে শেখা আর ভাবতে ভাবতেই খেই হারানো।ভালোবাসি পদ্য গান আর পিছুটান।
ও হ্যাঁ আর মনের মতো সাজ,অবশ্যই খোঁপায় একটা সতেজ ফুল।
ফ্রিজের মধ্যে রান্না করে রাখা খাবারকে যারা বাসি বলে নাক সিঁটকোয়, তাদেরকে জীবনব্যাঞ্জনের প্রকৃত স্বাদ বোঝাবে এই লেখাটি।
সত্যিই তো! এভাবেও ভাবা যেতে পারে। ধন্যবাদ তন্ময়।